আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিয্যবাহী রকেট সার্ভিসঃ

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিয্যবাহী রকেট সার্ভিসঃ ঢাকা-বরিশাল, কিম্বা ঢাকা-খুলনা নৌপথে যারা জার্নী করেন-তারাই জানেন এই রুটের রকেট সার্ভিসের(ষ্টীমার সার্ভিস) খানদানী ঐতিয্যের কথা। স্টুডেন্ট লাইফে এবং কর্ম জীবনেও অনেক জার্নী করেছি এই রুটের রকেট সার্ভিসে। ২০/২৫ বছর পুর্বে এই দুই রুটে রকেট সার্ভিস ব্যতীত ভ্রমন করা সকল যাত্রীদের জন্য ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই রুটের নিয়মিত যাত্রীরা ছাড়াও দেশী বিদেশী পর্যটকগণ শুধু মাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্যই এবং রকেট সার্ভিসের সুস্বাদু খাবারের লোভে তথা আতিথিয়েতা লাভের জন্যই রকেট সার্ভিসের শরনাপন্ন হতেন। দক্ষিনাঞ্চলের অগনিত মানুষের নদীপথের প্রিয় বাহন রকেট/ ষ্টীমার সার্ভিস।

বহু বহু বছর পর গত মাসে ঢাকা-বরিশাল রকেট সার্ভিসে জার্নী করি। ২ দিনের জন্য বরিশাল যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং সেই সঙ্গে আমার ছোট ছেলেকে আমাদের দেশের এক কালের নদীপথের ঐতিয্য রকেট সার্ভিস দেখানোর উদ্দেশ্যেই রকেট সার্ভিসের দ্বারস্থ্য হওয়া। এক কথায় এই জার্নী করে আমি খুব হতাশ হয়েছি-রকেট সার্ভিসের দৈন্যদশা দেখে। আমাদের বর্তমান ঢাকা-বরিশাল জার্নীকে ভ্রমন নাবলে ভোগান্তি বলাই বাহুল্য।

আমার ১৪ বছরের ছেলে বলেছে-"ভোগান্তি আর দুর্দশার নাম যদি হয় ঐতিয্য-তাহলে ঠিক আছে"! আমার ছেলের কথার বিপরীতে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের একটিও পয়েন্ট নেই। যেহেতু বর্তমানে রকেট/ ষ্টীমার সার্ভিসে কোনই ভালো দিক নেই-তাই তার খারাপ দিক বর্ননাও অপ্রাসাংগীক। এম ভি অস্ট্রিচ নামক স্টীমারে আমরা প্রথম শ্রেনীর যাত্রী। ১৮৮৪ সনে প্রথম বরিশাল-খুলনা রুটে যাত্রী পরিবহনে ষ্টীমার সার্ভিস চলাচলা শুরু হয়। তখনকার দিনে ষ্টীমার যোগে বরিশাল থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী খুলনাতে নেয়া হতো।

খুলনা থেকে সেইসব পন্য বাই রোড/ ট্রেন যোগে কোলকাতা নেয়া হতো। নৌ পথের এই ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় ১৮৯৬ সনে বৃটিশ সরকারের ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন এন্ড রিভার ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী তদানিন্তন বাংলায় যৌথ ভাবে অনেকগুলো রুটে ষ্টীমার সার্ভিস চালু করে। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের পর বৃটিশ সরকারের রেখে যাওয়া ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন এন্ড রিভার ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানীর সকল দায়-দেনা সহ গঠন করা হয় পাকিস্তান ষ্টীমার্স সার্ভিস। বৃটিশদের রেখে যাওয়া এই সংস্থার অধীনে এম ভি গাজী, এম ভি অস্ট্রীচ, এম ভি টার্ন, এম ভি কিউই, এম ভি শেলা, এম ভি লালী, এম ভি সান্দ্রা, এম ভি মেঘলা, এম ভি মাসউদ, এম ভি লেপচা নামক ১০ টি ষ্টীমার নিয়ে চালু হয় পাকিস্তান ষ্টীমার্স সার্ভিস। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনে গঠিত হয় বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন(বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ জলপরিবহন সংস্থা)।

স্বাধীনতার পরে এই সংস্থায় এম ভি সোনারগাঁও নামে আরো একটি জাহাজ যোগ হয়। এই জাহাজগুলোর বৈশিস্ট হলো জাহাজগুলো সবই প্যাডেল হুইল চালিত এবং কয়লায় চালিত। পরবর্তীতে কয়েকটি জাহাজ কয়লা থেকে ডিজেলে চালানোর জন্য রুপান্তরিত হয়েছিল। প্রায় শতবর্ষী এই জাহাজগুলোর নির্মাতা ডেনমার্ক শিপিয়ার্ড। ইঞ্জিনও প্রস্তুত করেছে ডেনমার্ক।

চুক্তি মোতাবেক বিভিন্ন সময় জাহাজের ইঞ্জিন ওভারহলিং করেছে ডেনমার্ক সরকার। এই সংস্থার এম ভি গাজী, কিউই এবং এম ভি অস্ট্রীচ নামক জাহাজ তিনটির সুখ্যাতি অবিভক্ত বাংলা এবং বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশ জুড়ে। অনেক অনেক দেশের রাস্ট্র নায়ক থেকে শুরু করে বেশীর ভাগ রাস্ট্রীয় অতিথিদের মুগ্ধ করেছে এই তিনটি জাহাজ। ছেলে বেলায় দেখেছি ঐ দুটি স্টীমারে প্রথম শ্রেনীর বেশীর ভাগ যাত্রী বিদেশী। বর্তমানে এম ভি গাজী শুধুই সৃতি।

লেপচা, অস্ট্রীচ, মাসউদের অবস্থাও তথোইবচঃ! এইসব জাহাজের খাবারের মান, পরিবেশনের মান ছিল ভোজন রশিকদের প্রধান আকর্ষন। এখন তা শুধুই ইতিহাস! আমার কৌতুহলী ছেলের প্রশ্ন-"আব্বু, এই সার্ভিসটি রিভার ক্রুইস নাম নাহয়ে "রকেট সার্ভিস" নাম হলো কেনো"? এতো বছরে আমার মনেও এমন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল-কিন্তু জবাব জানাছিলনা। "রকেট সার্ভিস" নামের তাতপর্য জানার জন্য আমি ছেলেকে নিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করার জন্য "মাস্টার ব্রীজ" যাই। এই জাহাজের ক্যাপ্টেন(ওরা বলে পাইলট) নাম মিঃ মনসুর। বয়স ৫৭ ছুঁইছূঁই।

আর কয়েক মাস পরেই অবশরে যাবেন। তাঁকে প্রশ্ন করি-"এই সার্ভিসের নাম "স্টীমার সার্ভিস" নাহয়ে "রকেট সার্ভিস" নামকরনের কারন কি"?ক্যাপ্টেন মনসুর জানালেন-"যাত্রা থেকে শুরু করে শেষ স্টেশনে পৌঁছতে যেসব স্টীমার ২৪ ঘন্টার বেশী সময় লাগে-সেইসব সার্ভিসকে বৃস্টিশরা 'রকেট সার্ভিস' নাম দিয়েগিয়েছে-এখনও সেই নাম প্রচলিত আছে। আই ডব্লিউ টি এ'র ঢাকা-খুলনা রুটের স্টীমার সার্ভিসের যাতায়াত সময় ২৪ ঘন্টার বেশী বলেই এই সার্ভিসের নাম 'রকেট সার্ভিস'। আমি প্রশ্ন করি-"আপনাদের কিছু কিছু জাহাজের দুই পাশে হুইল/প্যাডেল আছে-যেমন-এম ভি গাজী, এম ভি অস্ট্রিচ,এম ভি কিউই, এম ভি টার্ণ,এম ভি মাসউদ ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু জাহাজে হুইল/প্যাডেল নেই-যেমন-এম ভি শেলা, এম ভি লালী, এম ভি সান্দ্রা, এম ভি মেঘলা, এম ভি লেপচা-ইত্যাদি।

এই দুই ধরনের জাহাজের নামের সাথে কি রকেট/স্টীমার এর কোনো পার্থক্য রয়েছে?" ক্যাপ্টেন মনসুর জানালেন-"না, যাহা স্টীমার তাহাই রকেট"। একসময় বরিশাল-ঢাকা রুটে প্রতিদিন বিলাশবহুল এই স্টীমার সার্ভিস চলাচল করলেও বর্তমানে সপ্তাহে ৬ দিন ঢাকা-বরিশাল রুটে এবং সপ্তাহে ৪ দিন খুলনা-ঢাকা রুটে প্রায় যাত্রীশুণ্য অবস্থায় এই সার্ভিস অনেক জোড়াতালি দিয়ে চলছে বয়োবৃদ্ধ কয়েকটি জাহাজ। যা সেডিউল মোতাবেক কোনদিন গন্তব্যে পৌঁছেতে পারেনা। বর্তমানে বরিশাল-ঢাকা রুটে অনেক বেসরকারি মালিকানাধীন অত্যাধুনিক বিলাশবহুল যাত্রীবাহি লঞ্চ চলাচলের কারনে ধীরগতির স্টীমারে যাত্রী ওঠেনা বললেই চলে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.