আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপরাধী সৃজন প্রকল্প



হাসান মশহুদ চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে, কিংবা বলা যায় অনেকটা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তিনি সৎ ও যোগ্য হিসেবে মিডিয়ায় পরিচিতি লাভ করেছেন, সুতরাং তার বিদায়ে সাধারণ মানুষ বিষন্ন, আবেগাক্রান্ত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সময়ে দুদক পুনর্গঠিত হলেও সেটার কার্যক্রম যতটা দুর্নীতিবিরোধী ছিলো, তার চেয়েও বেশী ছিলো বিরাজনৈতিকরণ ভিত্তিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক ভুল পদক্ষেপের সহযোগী ছিলো দুদক। সেটা বিবেচনায় রেখেই বলছি হাসান মশহুদ চৌধুরীর প্রস্থানে বিলাপ করবার কিছু নেই, তিনি থাকলেও বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন হওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণই ছিলো।

তার একটা পরিচয় হয়তো হতে পারে তিনি রাজনীতিমুক্ত, কিংবা তার সাথে বিএনপি, জামায়াত কিংবা জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নেই, সে বিবেচনায় রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বিশেষ কোনো দলকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সম্ভবনা হয়তো ক্ষীণ ছিলো, তবে গত ২ বছরের কার্যক্রম এবং সাম্প্রতিক প্রবনতা দেখে আমার নিজের ধারণা দুদক শেষ পর্যন্ত একটা অর্ণামেন্টাল অর্গানাইজেশন হিসেবেই টিকে থাকতো বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে নির্বাচিত সাংসদদের অধিকাংশই অপরাধী, শুধুমাত্র রাজনৈতিক যোগাযোগের জোড়ে যাদের ফৌজদারী আইনে সাজার বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও তারা নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে পারছেন এবং নির্বাচিত হচ্ছেন জনতার মুখপত্র হিসেবে, সেই দেশে দুর্নীতিদমন কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। আইন, বাস্তবতা হলো সবার জন্য সমান নয়। ক্ষমতাবানদের জন্য আইনের নমনীয় ব্যবহারটাই বাস্তব সত্য। আইন প্রয়োগে এবং প্রয়োগের কঠোরতার তারতম্যে অনেক রকম বিবেচনা থাকে, সেটা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং ক্ষমতা এবং আইনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দেশ-কালের বিভাজন নেই।

সব দেশেই সামাজিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ এবং সাধারণ মানুষের জন্য আইন আলাদা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানতম ভুল ছিলো বিরাজনৈতিকরণের পদক্ষেপ গ্রহন, তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহন করতে চেয়েছিলেন, ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিতে চেয়েছিলেন, এবং এই প্রচেষ্টার বলি হয়েছিলো দুদক। দুদকের তৎকালীন প্রধান হিসেবে হাসান মশহুদ এর দায় এঁড়াতে পারেন না। দুদক যেই ৫০০ জনের প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছিলো, তারা সবাই হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের সবারই অন্ধকার অতীত আছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই হয়তো ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রচলিত আইনকে নিজের সুবিধামতো ব্যবহারের, উৎকোচ প্রদান, এবং সরকারী কাঠামোকে কলুষিত করবার অভিযোগ বাস্তব সত্য- তবে সম্পূর্ন প্রচেষ্টাটাই সঠিক পথে না গিয়ে হঠকারী পদক্ষেপ হয়েছিলো বলেই সাফল্য আসে নি কোনোটাতেই, যেমন ডঙ্কা বাজিয়ে শুরু হয়েছিলো দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, শেষার্ধে এসে ততটাই মিইয়ে গিয়েছিলো এই কার্যক্রম। এবং বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সময় সেটা কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছিলো।

উদ্দেশ্য সৎ হলে এবং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকলে দুদককে কার্যকর দেখতে আগ্রহী এমন বাংলাদেশী জনগণের সংখ্যা কম নয়, তবে দুদকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই সৎ উদ্দেশ্যের প্রমাণ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। দুদক এবং এর সহযোগী হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানটি ছিলো, তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহনের অভিযোগ আছে, আছে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ, সেসব অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় নি। এবং শুরু হবেও না কোনো দিন। দুর্নীতির বিরোধিতা রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংস চরিতার্থ করতেই দুর্নীতি বিরোধী হবে সরকারী দল। শ্বেতপত্র প্রকাশিত হবে, রাজনৈতিক বক্তৃতায় ব্যবহৃত হবে বিভিন্ন উপাত্ত।

সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে কিংবা ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে চায় এমন সচিবদের কল্যানে সরকারী দল এবং বিরোধী দল সরকারের অনেক দুর্নীতির প্রতিবেদন পায় নিয়মিতই। সেসব উপাত্ত সরকারে দপ্তরে অভিযোগ আকারে জমা পড়ে না, সেসব উপাত্ত রাজনীতির হাতিয়ার। সরকারী দপ্তর, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত, সচিব থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সবাই দুর্নীতিআসক্ত। রাজনৈতিক দলের নেতা ,পাতি নেতা সমর্থক, কর্মী সবাই রাজনৈতিক প্রভাবেই পুলিশের হয়রানি থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। আইন ও বিচার ব্যবস্থা কাগজে কলমে স্বাধীন হলেও এখনও সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়।

সেখানেও তদবির চলে, চলে উপরতলার ফোনের কারসাজি, কারা জামিন পাবে, এবং কারা জামিন পাবে না, কাদের ফাঁসি হবে এবং কাদের ফাঁসি হবে না, এইসব সিদ্ধান্ত যখন নির্বাহী বিভাগ থেকে আসে তখন সেখানে বিচারকের স্বাধীন সিদ্ধান্ত বলে কিছুই থাকে না। বিচার বিভাগ পৃথক করবার পরে কি পরিস্থিতি বদলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগকে পৃথক করেছিলো কাগজে কলমে, তবে তারাই প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়েছে সবচেয়ে বেশী। এটা নিয়ে বিভিন্ন স্তরে কথা উঠলেও সেটা নিয়ে বিব্রত হয় নি দুদক, গুরুতর অপরাধ নির্মূল কমিটি, সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাগণ এবং তাদের আচরণ নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জিত নন সে সময়ে মেট্রোপলিটন আদালতে কার্মরত বিচারকগণ। মদ রাখবার অভিযোগে মওদুদকে আটক করে, তার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করে, সারওয়ারকে একই রকম অভিযোগে আটক করে ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করে দুদকের দুর্নীতির তদন্ত কি সঠিক আইন মেনে হয়েছে? সচিবালয় থেকে সহায়তা পায় নি দুদক, সেটাও যেমন সত্য তেমনই সত্য তাদের অন্যায় আব্দারে সমর্থন জানানোর কোনো নৈতিক প্রয়োজন ছিলো না সচিবালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের। ১০টা বিশেষ আদালত স্থাপন করেও অভিযুক্ত ৮০ জনের বিচার শেষ করতে পারে নি দুদক।

বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রখ্যাত আইনজীবি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে দুদকের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও তারা কেউই সঠিক আইনি পরামর্শ দিয়ে দুদককে ঋদ্ধ করতে পারেন নি। দুদকের উদ্দেশ্য, এর প্রধান হাসান মশহুদের উদ্দেশ্য হয়তো সৎ ছিলো, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরণে এবং সংশ্লিষ্ট আইনজীবিরা নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরণে দুদককে বিকৃত ভাবে ব্যবহার করে এর কার্যকারিতা অনেক আগেই নষ্ট করে ফেলেছেন, সেটার চুড়ান্ত সমাপ্তি ঘটলো দুদক প্রধানের পদত্যাগের মাধ্যমে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদই ফৌজদারি মামলার আসামী। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই নানাবিধ গুরুতর অভিযোগ আছে, দলীয় প্রধান এবং কতিপয় সৎ ও নির্ভেজাল নেতা বাদ দিলে অধিকাংশ নেতাই উঠে এসেছেন রাজপথে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলীর কর্মী ও নেতাকে নাজেহাল করে, অপদস্ত করে এবং তাদের উপরে হামলা চালিয়েই। তারা সব সময়ই নিজের রাজনৈতিক বিবেচনা ব্যবহার না করে শাররীক শক্তি ব্যবহার অভ্যস্ত।

এবং প্রতিটা সরকারই তাদের এইসব নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে এবং পুলিশি তদন্ত স্থগিত করেছে, কারণ তাদের বিবেচনায় এইসব অভিযোগ রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, আদতে শক্তি প্রদর্শন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে দুর্বলের উপরে অত্যাচারের অতীত নিয়েই সংসদে এসেছে অধিকাংশ সাংসদ। সংসদে বিশেষ জেলখানা বসানো হয়েছিলো, সেখানে অন্তরীণ ছিলেন শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া, তত্ত্বাবধায়ক কালে, তবে সংসদে নির্বাচিত সাংসদের আইনী রেকর্ড ঘেটে সেটাকে আরও বৃহদাকার করে শুধুমাত্র গুটিকয়েক কে বাইরে রাখবার অনুমতি দিলে আরও ভালো হতো দেশের জন্য। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে রাজনীতি করলে অন্তত অপরাধী হয়ে জেল পুলিশ এইসব আইন ও সালিশের মুখোমুখি হতে হয় কদাচিত।

বরং ভিন্ন দাবি উঠানো যেতে পারে- যে দেশে নীতি নির্ধারকের অধিকাংশই অপরাধী,সেই দেশে আলাদা করে জেলখানা নির্মাণ এবং সেখানে ছোটোখাটো অপরাধীকে আটক রাখবার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি না?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.