বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
শীল হচ্ছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় আচরণ। এক কথায় শীল হচ্ছে নৈতিক বিধান। বৌদ্ধদের পঞ্চশীল ও অষ্টশীল নৈতিক বিধান হিসেবে অনন্য।
যে কারণে, বৌদ্ধ শীলসমুহ অনেক দিন আগেই জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মেরই অনেক ধ্যানধারনার উপর বাংলার বাউল দর্শন গড়ে উঠেছে । কাজেই বাউলদর্শন নৈতিক বিধান সম্বন্ধে একেবারেই মৌন থাকতে পারে না। উপরোন্ত নীতিবিদ্যা বা Ethics হলো দর্শনশাস্ত্রের এমন এক শাখা-যা নৈতিকতা বিষয়ে আলোচনা করে। এই কারণেই, নীতিবিদ্যা আলোচনা ব্যতীত দর্শনশাস্ত্র চর্চা সম্ভব না।
বাউল তথা লালনের একটি গানে বাউলদের নৈতিকতার সরুপটি ফুটে উঠেছে।
গান
সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।
খরিদদার দোকানদার মহাজন বাটখারাতে কম তাদের কসুর করবে যে যম।
গদিয়াল মহাজন যেজন বসে কেনে প্রেমরতন।
পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না পারে যেতে পারবে না।
যতোবার করিবে হরণ ততোবার হবে জনম।
লালন ফকির আসলে মিথ্যে ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে
সই হলো না একমন দিতে আসলে তার প’লো কম।
বয়ান
সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।
গানের প্রথম চরণেই লালন যা বলা বলে দিয়েছেন। সত্য বলতে হবে আর সুপথে চলতে হবে। কাকে বলছেন লালন? মনকে। মনকে কেন ? কেননা, বুদ্ধ ”ধর্মপদে” মানে, বৌদ্ধদের পবিত্র গ্রন্থ বলেছেন: All that we are is the result of what we have thought: it is founded on our thoughts, it is made up of our thoughts. If a man speaks or acts with an evil thought, pain follows him, as the wheel follows the foot of the ox that draws the carriage.
আমি তখন বলছিলাম না: বৌদ্ধধর্মেরই অনেক ধ্যানধারনার ওপর বাংলার বাউল দর্শন গড়ে উঠেছে ।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।
বাউলেরা জীবনভর দেহের ভিতরের বসবাসরত লোকোত্তর মানুষেরে খোঁজে । এইই বাউলের সাধনা। সেই মানুষকে পেতে হলে সত্য ও সুপথ চিনতে হবে। কাজেই নীতিশাস্ত্র যে বাউলদর্শনের ভিত -কথাটা প্রমাণ করা গেল।
অগ্রসর হই।
খরিদদার দোকানদার মহাজন বাটখারাতে কম তাদের কসুর করবে যে যম।
কথাটা সহজেই বোঝা যায়। সবাইকেই যখন যম (মৃত্যুর) মুখে পড়তে হবে-তখন দুনীর্তি করে কার কী লাভ হে!
গদিয়াল মহাজন যেজন বসে কেনে প্রেমরতন।
গানটির সবচে রহস্যময় চরণ এটি। এই কথার মানে খাঁটি মানুষকে বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না।
প্রেমরতন বা অনাবিল প্রেমের অনুভূতি তার হৃদয়ে জাগ্রহ হয়। চরণটির দ্বিতীয় মানে- গদিয়াল মহাজন হচ্ছে ঈশ্বর-যিনি বসে প্রেমরতন কেনেন। এর অর্থ হল: প্রেমের প্রতিষ্ঠার জন্যই ঈশ্বর বিশ্বজগৎ নির্মান করেছেন ...আর তোমরা প্রেমহীন কর্ম কর!
পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না পারে যেতে পারবে না।
এই চরণটির মানে বোঝা যায় সহজেই। ‘পার’ বলতে লালন সম্ভবত সুখময় অনন্তকে বুঝিয়েছেন।
পারে যাওয়াই জীবাত্মার মোক্ষ-মানে মানুষের লক্ষ।
যতোবার করিবে হরণ ততোবার হবে জনম।
এই চরণে বেদান্ত দর্শনের প্রভাব স্পস্ট। মানবজীবনকে ভালো চোখে দেখা হয় নাই উপনিষদের দর্শনে। কাজেই পূণ্য অর্জন করে যত শীঘ্রি সম্ভব পারে যাওয়া যায় তত ভালো।
তালে আর এ ধরায় জন্মিতে হবে না। বাউল দর্শন কি বেদান্ত দর্শন ?
না।
তাহলে?
বেদান্ত দর্শন জগতের শ্রেষ্ঠ অধ্যাত্মবাদী দর্শনের অন্যতম। ইউরোপের দার্শনিক সোপেনহাওয়ার, নিৎসে-এঁদের অবধি প্রভাবিত করেছে বেদান্তদর্শন। বাউলদর্শনে তার কিছু ভাবনার ছায়া পড়াই স্বাভাবিক।
লালন ফকির আসলে মিথ্যে ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে
অসাধারণ বাক্য। এই চরণে নিজের সমালোচনা করেছেন লালন। তীর্থে তীর্থে ঘুরে কী লাভ যদি না অন্তরের ময়লা পরিস্কার না হয়। সবশেষে লালন বলেছেন-
সই হলো না একমন দিতে আসলে তার প’লো কম।
এই এক মন দেওয়াই আসল।
মানে? প্রথম চরণ দুটোয় ফিরে যাই-
সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।
সত্য বলে সুপথে থেকে ভিতরের মানুষের খোঁজ করা-এই হচ্ছে লালনের এথিক্স।
‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ গানটি আবদেল মাননাম সম্পাদিত অখন্ড লালনসঙ্গীত থেকে নেওয়া হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।