আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লালনের একটি গান

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

গানটি এই- পাখি কখন জানি উড়ে যায় একটা বদ্ হাওয়া লেগে খাঁচায় ভেবে অন্ত নাহি দেখি কার বা খাঁচায় কে-বা পাখি। আমার এই আঙ্গিনায় বসে আমারে মজাতে চায়। খাঁচার আড়া প'ল খসে পাখি আর দাঁড়াবে কী সে? আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে- আমার চমকজ্বরা বইছে গায়।

আগে যদি যেত জানা জংলা কভূ পোষ মানে না। তা হলে হয় প্রেম করতাম না লালন ফকির কেঁদে কয় ... সাঁইজীর এই গানটি অনেকেরই শোনা। আমি কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষন করতে চাই। পাঠ করুন- খাঁচার আড়া পল ধ্বসে পাখি আর দাঁড়াবে কী সে? আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে- আমার চমকজ্বরা বইছে গায় আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে- এই তৃতীয় চরণটি কি প্রশ্ন না বিবৃতি? প্রশ্ন হলে তো এভাবে লিখতে হবে- আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে? আর বিবৃতি হলে এভাবে- আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে। মানে একটা দাঁড়ি দিয়ে শেষ করতে হবে।

আবারও বলি-তৃতীয় চরণটি কি প্রশ্ন না বিবৃতি? তা হলে এবার প্রথম চরণে যাই। খাঁচার আড়া প'ল ধ্বসে ...কী এর মানে? খাঁচা কি শরীর? তা হলে খাঁচাসম শরীরটি কোনওদিন শুকিয়ে মরে গেলে শরীরের ভিতরে যে প্রাণপাখি রয়েছে সেটির কি হবে? এই লালনের বিপন্ন বিস্ময়। আরও বহৎ প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভেবে দেখা যায়। যদি জগৎটাই তৈরি না হত? তো? তা হলে প্রাণগুলির কি হত? এই লালনের বিপন্ন বিস্ময়। এবং আমাদেরও।

এক গূঢ়তম বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত হয়ে লালন গাইলেন- খাঁচার আড়া প'ল ধ্বসে পাখি আর দাঁড়াবে কী সে? আমার সমস্ত কৌতূহল পরের চরণটি নিয়ে- আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে- তা হলে আবারও বলি-এই তৃতীয় চরণটি কি প্রশ্ন না বিবৃতি? যদি প্রশ্ন হয় তো? লালন সমমনাদের কাছে প্রশ্ন রাখছেন, আমরা যেমন প্রায়শ রাখি,আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে,যে,খাঁচাকে শরীর সাব্যস্ত করেই বলি- খাঁচাসম শরীরটি কোনওদিন শুকিয়ে মরে গেলে শরীরের ভিতরে যে প্রাণপাখি রয়েছে সেটির কি হবে? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর। যে প্রশ্নের উত্তরের জন্য ছেঁউরিয়ার সাঁইজী জীবনভর উতলা হয়ে রইলেন আর আমরাও তাঁরই বংশধর বলেই তাঁর ভাবনার সঙ্গে আজও একাত্ম হতে চাইছি। আর যদি ওই ৩য় চরণটি বিবৃতি হয় তো? আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে। তা হলে তো সব কথাই ফুরোলো। আর কোনও কথা থাকে না।

আমি এই ভাবনা ভাবছি মিছে যে-যদি জগৎটাই তৈরি না হত? তো? তা হলে প্রাণগুলির কি হত? এসব আর ভেবে কি হবে? এসব ভেবে ভেবে তো - আমার চমকজ্বরা বইছে গায় এবার গানটির শুরুতে যাই। পাখি কখন জানি উড়ে যায় একটা বদ্ হাওয়া লেগে খাঁচায় ... পাখি মানে তো জীবন? যা নিয়ে আমাদের অপার বিস্ময়। যে কোনও সময়ই জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে। তবু্ও এই জীবনপাখি নিয়ে আমাদের কৌতূহল কম নয়। শরীর ও মন আমাদের ভাবায়।

লালন বলছেন- ভেবে অন্ত নাহি দেখি কার বা খাঁচায় কে-বা পাখি। আমার এই আঙ্গিনায় বসে আমারে মজাতে চায়। অতুলনীয় কাব্যদশর্নের আর উৎকৃস্ট নমুনা এর চে বেশি আর কি হতে পারে বলুন? কখনও কখনও মনে হয় যে আমরা সব পেয়ে গেছি। প্রজ্ঞা। নদীয়ার লালন।

বাংলার ভাব। কিন্তু, পাখি কেন লালনের উঠানে বসে লালনেরে মজায়? এর জবাব কে জানে? হয়তো কোনিয়ার জালালউদ্দীন রুমী জানেন? পাখি যে উঠানের ডালিম গাছের ডালে বসে কবিকে মজায়, সে সাক্ষ্য লালন দিচ্ছেন। তা হলে টেলিওলজি মেনে নিতে হচ্ছে কি? মানে যা দেখি তার সবেরই একটা মানে আছে। পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে শিশুরা না খেয়ে মরে যায় ... কিংবা ...তা হলে তারও অর্থ আছে? হেগেল কি বলেন? উনিশ শতকে হেগেলও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছিলেন জানি। এখন আমরা ভাবছি।

‌'কদ্দুর এগোল মানুষ?' ভেবে অন্ত নাহি দেখি কার বা খাঁচায় কে-বা পাখি ... অসম্ভব রহস্যময় দুটি চরণ। লকলকে আগুনে শিক পুড়িয়ে নগ্নবুকে লিখে এ নগরটা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাউল হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। 'দেখি' ও 'পাখি' - এই দুটো শব্দকে ভগবান শুধু এই গানটির জন্যই তুলে রেখেছিলেন বলে সন্দেহ হয়। এই উদাসী চরণদ্বয় ডাকে, দিগন্ত থেকে ডাকে, যেখানে রেললাইন অদৃশ্য হয়ে গেছে ... ভাবনায় ভাবনায় ক্ষতবিক্ষত লালন ফকিরের আর্তি- আগে যদি যেত জানা জংলা কভূ পোষ মানে না। তা হলে হয় প্রেম করতাম না লালন ফকির কেঁদে কয় ... এবং এই কান্নাটা আমাদের ... এ কালেও ...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।