আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার অসুখ



আমার একটা বিচ্ছিরি অসুখ হয়েছে। রাস্তায় কোন বাচ্চা মেয়েকে ভিক্ষা করতে দেখলে, নিজের মেয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলি। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বরগুনায় ত্রাণ দিতে গিয়েছিলাম সিডরের পর.... কম্বল নেয়ার জন্য বসে থাকা এক বৃদ্ধকে অবিকল নিজের বাবার মতো মনে হল। তার ঝুলে যাওয়া মুখের চামড়া, তার কাঁপতে থাকা হাত, অনাহারে থাকা তার চেহারার মধ্যে আমি নিজের পিতার মুখ দেখতে পেলাম।

ব্র্যাকের চাকরি করতে গেছে এক যুবক। আফগানিস্থানে তার পোস্টিং। তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হলো। সে ছিল মায়ের একমাত্র ছেলে। তাকে আমি দেখেনি, তার মাকে দেখেছি, টিভি পর্দায়।

অস্ভব শোকে, তাপে তিনি কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। শরীরের অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি এক করে তিনি বলছে, আমার কি হবে গো...আমার যে কেউ নাই .... টিভি পর্দায় তাকে দেখে আমি চিনলাম, তিনিই আমার মা। এই তো আমার মা কাঁদছেন। তার একমাত্র সম্বল পুত্র সন্তান আজ পরবাসে নিহত। অনেক অনেক অপেক্ষায় ছিলেন আমার মা- আমি ফিরে আসবো আফগানিস্তান থেকে, তিনি আমার জন্য পাশের গায়ের এক মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছেন।

আমাকে ছাড়া মার একা থাকতে খুব কষ্ট হয়। তবু আফগানিস্তানে পোস্টিং হওয়ার সুবিধা, তাতে বেতন খানিকটা বেশি। সংসারে টাকার দরকার আছে। এই টাকার জন্য কত কষ্ট করেছেন আমার মা। নিজে না খেয়ে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, অনেক দীর্ঘ কষ্টের কালো সমুদ্রের পর- সুখের রুপালী দ্বীপের আভাস- যখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে- তখন পৃথিবীর সমস্ত আলো একযোগে নিভে গেল।

বসুন্ধরা সিটিতে যখন আগুন লাগে- তখন আমি কলাবাগানে বন্ধুরের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে গেলাম ওখানে। আগুন জ্বলছে, ছাদে আটকা পড়েছে এক লোক- তিনি দ্রুত হাত নাড়াচ্ছেন। মাথার উপর হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। কিন্তু কাছে আসতে পারছে না- ঐ দূর থেকে দেখেও আমি লোকটাকে চিনি ফেললাম, আমার আপন বড়ো ভাই।

আমি নিজের হাত কামড়ে ধরলাম। এই হচ্ছে আমার অসুখের বৃত্তান্ত। রাস্তার ঐ ভিক্ষা করা , চলন্ত গাড়ির মাঝে ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো, আমার মেয়ে নয়। বরগুণার ঐ অশীতিপর বৃদ্ধটি আমার বাবা নয়। আফগানিস্থানে নিহত ঐ ছেলের মা আমার মা নয় , ছাদে আটকা পড়া ঐ লোকটি আমার ভাই নয়।

এটাই সত্য কথা, তবুও জেনে বুঝে নির্জলা সত্যের সাথে মিশে যাচ্ছে আমার কল্পনা, আমি অযথাই কষ্ট পাচ্ছি। আমার অসুখ এটাই। বিডিআরে ঘটনায় যত আর্মি অফিসার মারা গেছেন- তাদের প্রত্যেকের সাথে আমি একইভাবে কাল্পনিক আত্নীয়তা বোধ করেছি.....জেনারেল শাকিল, কর্ণেল গুলজার, নাম জানি না- এমন অনেককেই আমার পরম আত্নীয়ই মনে হয়েছে। অসহনীয় কষ্টে কেটেছে আমার ঐ সমস্ত দিন। আজ বিডিআর জোয়ানদের আত্নহত্যার খবর শুনি, আমার বুক কেঁপে ওঠে।

তাদের পরিজনকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে- আমি অস্থির বোধ করি। আবার ঐ একই অসুখ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমি এই অসুখ থেকে মুক্তি চাই। আমার আর ভালো লাগে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।