...এক...
এ জন্মের জন্য ওপরওয়ালার প্রতি আমার নিদারুণ অনুযোগ আছে। দুর্বল স্বাস্থ্য ও ততোধিক দুর্বল চিত্ত সহকারে এই ধরাধামে আমাকে পাঠানোর জন্য। কেন তার কারখানায় কি এর চেয়ে ভালো কিছু ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। আমার বদ্ধমূল ধারনা, ব্রান্ড নিউ তো দূরের কথা আমাকে সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসও দেয়া হয়নি। নির্ঘাত কারখানার কোনায় অন্ধকারে মরচে পড়া বহু ব্যবহারে (কয়েকবার এই পৃথিবী পরিভ্রমণ করে ফেরত যাওয়া) জরাজীর্ণ পুরানো জিনিস আমার দেহ ঘড়িতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
তা নইলে এখন নাহয় বুড়ো হয়েছি, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বাতের ব্যথা, অম্বল, অনিদ্রা নিত্য সঙ্গী হবে...অনুযোগ করে লাভ নেই। কিন্তু এক সময়ে তো দুই বেণী ঝুলিয়ে ইশকুলে গিয়েছি। সেই সময়েও কেন একটু সাধ করে বৃষ্টিতে ভিজলে, কিংবা শীতের সন্ধ্যায় একটু হিমের নীচে থাকলেই...খবর হয়ে যেত? খবর আর কী? আবার জ্বর, টনসিল, বিচ্ছিরি কাশি...আবার মোজা পরে ঘুরে বেড়াও সপ্তাহ দুয়েক...পটাস পারম্যাঙ্গানেট সহকারে গরম পানিতে সকাল বিকাল গার্গল কর...গলায় চুলকানি উদ্রেককারী মাফলার নামক পদার্থটি পেঁচাও...বিকালের হাওয়া খেতে ছাদে/খোলা মাঠে যাওয়া বন্ধ...গামলার মত কাপে করে সারাদিন আদা সহযোগে লেবুর চা খাও (এটি ছিল বিশেষভাবে পিতৃদেবের নির্দেশ। আদা যে সর্বরোগের মহৌষধ এই ধ্রুব সত্যটা আমি আমার নিভৃতচারী বাবার কাছ থেকেই জেনেছি। তাঁর তালিকায় আরও ছিল সরিষার তেল, গরম দুধ ও রশুন)।
গলা দিয়ে কিছু নামছে না? আইসক্রিম, ফুচকা কিংবা চানাচুরও খেতে ইচ্ছে করছে না? জাউয়ের মতো নরোম খিচুড়ি, শিং মাছের পাতলা ঝোল, শীতের দিনের জল পাই, নতুন আলু, টমেটোর ঝোল ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে খাও আর গৃহবন্দী থাকো...
এই সব করে টরে অনার্স পাস করার পরে একবার হ’ল জন্ডিস। ঠিক আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইটার গায়ে হলুদের দু’দিন আগে ঘটলো ঘটনাটা। সে এক বিশাল ব্যাপার। বিয়ের চেয়েও বিশাল আয়োজন। বিয়ে টিয়ে রইলো পড়ে, সবাই জন্ডিস রোগী নিয়েই ব্যস্ত।
একাধারে তিন মাস শয্যাশায়ী। কিসের ক্লাস কিসের কী! দু’দিনের মধ্যে গায়ের চামড়া, হাত-পায়ের নখ, চোখের সাদা অংশ সরিষা খেতের রং ধারণ করলো। আমি বেশ হলুদিয়া পাখি হয়ে গেলাম। এমনকি বিছানার ধবধবে সাদা চাদর গেরুয়া ধারী হয়ে গেল। রক্তে ঘাপটি মেরে থাকা বিলিরুবিন নামক অচিন পাখি ধাই ধাই করে উঠে যেতে লাগলো।
হাতের চামড়া ফুঁড়ে স্যালাইন চলতে থাকলো। আমি চিঁহি চিঁহি করে (গলায় তখন স্বর ফুটছিল না যে!) এ জন্মের সকল পাপ (চারতলার মেয়েদের কমন রুমের চা, সিঙ্গারা, নীরব হোটেলের শুটকির ভর্তা, শামসুন্নাহার হলের সামনের চটপটি, ফুচকা, কাসুন্দি দিয়ে রাস্তার পাশের কাঁচা আমের ভর্তা, বাড়ি থেকে ফুটানো পানির বোতল নিতে ভুলে যাওয়া, রাত জেগে কড়া চা সহযোগে হেমন্ত মুখার্জীর গান শোনা, ইত্যাদি) স্বীকার করে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমার মূলত: “আয়রন লেডি” মাতৃদেবী আকুল হয়ে ভেঙে পড়লেন। তাঁর দিবারাত্রির কাজ হয়ে দাঁড়ালো নিজের হাতে বাজার করা, নিজের হাতে রান্না করা, নিজের হাতে আমাকে প্রতিটা বেলা খাওয়ানো, আর সারা রাত নামাজ পড়ে মুনাজাতে কাঁদা, “আল্লাহ, যত অসুখ আছে আমাকে দাও। আমার বাচ্চাকে ভালো করে দাও।
” আরও একটা কাজ তিনি খুব ভালো করতেন। সেটা হ’ল গায়ে হাত বুলানো। জ্বরের ঘোরে কোন অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কিংবা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙা চোখ মেলে কত অসংখ্যবার যে দেখেছি এক জোড়া নরোম, ভেজা চোখ জেগে আছে আর একটা হাত আলগোছে আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। খুব সম্ভব, আমার মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল হাত বুলিয়েই সব অসুখ ভালো করে দেবেন তিনি। হায়, অবোধ জননী!
আয়রন লেডির আরেকটা ব্যাপার ছিল।
দিনের মধ্যে হাজারবার করে জানতে চাইতেন কেমন লাগছে। আগেরবারের চেয়ে একটু ভাল লাগছে কি না (মূলত: তুখোড় মেধাবী এই মানুষটা কেন যে বুঝত না,মানুষের শরীর এত দ্রুত ভাল হয়ে যায় না! এমনকি মাতৃদেবী ঘন ঘন জিজ্ঞেস করলেও না। )। আর পিতৃদেব? তিনি কম কথার মানুষ, বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেন, কপালে হাত রেখে জ্বর দেখতেন, দরকার হলে মাথায় পানি ঢেলে দিতেন, কপালের জল পট্টি ভিজিয়ে দিতেন, পায়ের তলায় গরম সরিষার তেল ডলে দিতেন, জ্বরের প্রকোপ বেশী দেখলে পাড়ার ওহাব ডাক্তারের বাড়িতে ছুটতেন। কিন্তু সবকিছু করতেন নিঃশব্দে।
তিনিও জায়নামাজে দীর্ঘ সময় পার করতেন। তাঁর প্রার্থনা ছিল শব্দহীন, শুধু দু’চোখের জলের ধারারা ছিল দৃশ্যমান।
...দুই...
সেদিন ম্যালা দিন পরে আমার ছেলেবেলার বন্ধুটি ফিরে এলো। শুরুটা ছেলেকে দিয়ে। প্রথমে ইশকুল ফেরত ছেলে ফোনে জানালো, “মা, আমার গলা ব্যথা করছে।
তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো। ” এক দিন বাড়িতে রেখে গরম স্যুপ আর আদা জলের পথ্যতেই সেরে উঠল। কিন্তু উইকএন্ডের শুরু থেকেই আমার ছেলেবেলার বন্ধু জানান দিচ্ছিল সে ভুলে নাই আমাকে! তার পর এক রাতে শেষতক চলেই এলো অনেকটা “যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে...”র মতো করে। দুই ব্লাঙ্কেটের নীচে আমার ঠকঠকানো কাঁপুনিতে ছেলে জেগে গেলো, “মা, কী হয়েছে? হোয়াই আর ইউ শেকিং? তুমি কি পানি খেতে চাও?”
“না, বাবা, পানি লাগবে না। ব্ল্যাঙ্কেটের ওপর দিয়ে আমাকে জাপটে ধরে থাকো।
তা’হলেই হবে। ইট উইল বি অল রাইট ইন ফিউ মিনিটস। ডোন্ট ওরি। ”
দু’দিন পাত্তা না দিয়ে দেখতে চাইলাম কী হয়। কিন্তু গলার ব্যথা, মাথার ভেতরে ব্যথা, গায়ের গিঁটে গিঁটে ব্যথারা জানিয়ে দিল তারা বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
পিতৃদেবের কথামত প্রচুর আদা সহযোগে জল জ্বাল দিয়ে মগ ভর্তি চা খেলাম। নিজের হাতে বানানো টমেটোর বিস্বাদ ঝোল খেলাম (ঘরে আলু ছিল বাড়ন্ত। ম্যালা দিন ফ্রোজেন জলপাইও কেনা হয়নি)। আয়রন লেডির হাতের কী জাদু ছিল, জেনে রাখা হয়নি। ছ্যাঁচা রশুনের ফোড়ন দিতো, এটা জানি।
আমিতো তাই দিলাম, তা’হলে আমারটা কেন সেরকম হ’ল না! নির্ঘাত কিছু একটা আমাকে বলে যায়নি। এখন যে ফোন করে জেনে নেবো, তাওতো সম্ভব না।
যাকগে, রাখে হরি মারে কে? বেশ করে দু’খানা এডভিল খেয়ে ছেলেকে নিয়ে রওনা দিলাম বদ্যি বাড়ির উদ্দেশ্যে (ছেলেকেও দেখানো দরকার)। সেদিন রোদ উঠেছে ফকফকা, সাথে মৃদুমন্দ ঝোড়ো হাওয়া। এই দেশে রোদেলা দিন মানেই হ’ল ভয়াবহ ঠাণ্ডা দিন।
রোদ + ঝোড়ো হাওয়া = শৈত্য প্রবাহ (তাপমাত্রা এক নিমিষে ১০- ১৫ ডিগ্রি তলিয়ে যাবে)।
গাড়ির পেছনের সিট থেকে ছেলের জিজ্ঞাসা, “মা, আর ইউ ওকে?”
“ডোন্ট ওরি, দ্য ইয়াংগেস্ট ডটার অফ দ্য আয়রন লেডি ইজ ফাইন লাইক রকি মাউন্টেন। তুমি সিট বেল্ট পরেছ, বাবা?”
“আমি সিট বেল্ট পরেছি, মা। বাট, ইউ ওয়ের শ্যাকিং লাস্ট নাইট এগেইন। ”
“দ্যাটস ওকে।
রকি মাউন্টেন শ্যাকস সামটাইমস। আই অ্যাম অ্যাবসল্যুটলি ফাইন নাউ। ”
বলতে বলতে উড্রফের কর্নার ছাড়িয়ে যাই। একটু দূরেই ফ্যালোফিল্ড ট্রেন স্টেশন। স্টেশনের লাল ছাউনিটা দেখলেই কোথাও খুব যেতে ইচ্ছে করে।
কবে একটু ছুটি হবে, কোথাও যাওয়া যাবে... ছুটি গল্পের ফটিকের মতো ছুটি আর হয় না...
...তিন...
ওয়াকিং ক্লিনিক। আগে কখনো আসিনি। ডাক্তারের অ্যাসিস্টেন্ট সব বৃত্তান্ত নোট নিয়ে গেল। ডাক্তার ব্যাটা এসে প্রথমেই সেই নোটে চোখ বুলাতে বুলাতে শুধায়, “এসব কী তোমার নিজের হিস্ট্রি না কী তোমার ফ্যামিলি হিস্ট্রি?”
আমি পরিষ্কার হতে জানতে চাই, “তুমি ঠিক কিসের কথা বলছ?”
“এই যে সার্জারি, কেমো...এসব?”
“বালাই ষাট, ফ্যামিলির হতে যাবে কেন? এগুলো সব আমার নিজের। ”
ডাক্তার এবারে আমার বর্তমান অসুখের বৃত্তান্তে মন দিলো।
বিড়বিড় করে বলল, “মনেতো হচ্ছে ভাইরাল। কিন্তু তোমার যা হিস্ট্রি! কাজেই টেস্ট করাটাই ভাল। ” (সারভাইভার হওয়ার সম্মানই আলাদা!)।
তারপর, গলা থেকে সরু কাঠি দিয়ে সযত্নে সোয়াব নিলো। তারপর খসখস করে ওয়ার্ক নোট আর টেস্টের রিক্যুজিশন লিখতে লিখতে বলল,
“কালকের মধ্যে রিপোর্ট পাব।
আমার অ্যাসিস্টেন্ট তোমাকে কল করলে চলে এসো। ”
আমিও গুড গার্লের মত মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম। এর মধ্যে ছেলেকেও দেখে দিলো ডাক্তার। ওরটা ভাইরাল, কাজেই কিচ্ছু করার দরকার নেই। শুধু মায়ের যত্নই একমাত্র পথ্য।
...চার...
ছেলেটার কী যে বাজে অভ্যাস। গায়ে হাত বুলিয়ে না দিলে ঘুম আসে না তার। সেদিন রাতে প্রাত্যহিক রুটিন শেষ করে তার দিকে পেছন ফিরে শুয়েছি। তখনই ছেলে বলে উঠল, “মা, আমি কি তোমাকে একটু হাত বুলিয়ে দেব?”
“কেন বাবা?”
“তুমি বলেছ আয়রন লেডি তোমাকে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতো। স্পেশালি হোয়েন ইউ ওয়ের সিক...”
“না, বাবা ইটস ওকে।
আই অ্যাম ফাইন। তুমি ঘুমাও। ”
ম্যালা দিন পরে আমি ওপর ওয়ালাকে একটা ধন্যবাদ দেই। অন্তত: চোখের জলের ধারাকে শব্দহীন করার জন্য...
_______________________
কৃতজ্ঞতাঃ বানানবিদ তিথীডোর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।