আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবসর জাহাজে তিন দিন



বাংলাদেশের প্রথিতযশা চারুশিল্পীদের নিয়ে প্রথম আর্ট ক্যাম্পটি করা হয় সেন্ট মার্টিনে। ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি ২০০৯। ৪ দিনের ক্যাম্পে সেবার যোগ দিয়েছিলেন ৩০ জন শিল্পী। যাঁরা সেবার বিভিন্ন কারণে সেন্ট মার্টিনে যেতে পারেননি, তাঁদের নিয়ে এবারের ক্যাম্পটি করা হয়-নদীর ওপরে। গাইড ট্যুরের আবসর জাহাজে করে।

৩৫ জনের দল নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি ১১ মার্চ, বুধবার, ২০০৯। ঢাকা থেকে গাইড ট্যুরের বাসে করে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছাই সকাল ১১ টার পরে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ জাহাজ আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে। শীতলক্ষ্যা পার হয়ে আমাদের নিয়ে জাহাজ যখন মেঘনা নদীতে, তখন দুপুর। মেঘনার কোনো এক নাম না জানা চরে থামে জাহাজ।

প্রায় সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। দু’চার জন যারা সাঁতার জানেন না, তাদের স্পিডবোর্ডে করে চরে পৌঁছে দেয়া হয়। সবুজ চরে আর নদীর পানিতে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে সবাই ফিরে আসে জাহাজে। তারপর দারুন সব আইটেম দিয়ে দুপুরের খাবার। সব্জী, লাল শাক, আলু ভর্তা, ছোট মাছ, ইলিশ মাছ ভাজা, আর ঘন ডাল...।

খাবার শেষে দধি। অনেকদিন এত মজার আর টাটকা খাবার খাইনি। খাবার শেষে সামান্য বিশ্রাম। বিকেল নাগাদ শিল্পীদের দিয়ে দেয়া হয়- প্রয়োজনীয় ক্যানভাস, কাগজ, রঙ, তুলি ইত্যাদি। দুপুরের খাবার শেষে জাহাজ নোঙ্গর তোলে।

ধীরে ধীরে জাহাজ চলছে। চলছে কাগজ আর ক্যানভাসের ওপর শিল্পীর তুলির আঁচড়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়... এর পর সন্ধ্যা। আস্তে আস্তে সূর্য ডোবে। আমরা পার হয়ে যাই মেঘনা সেতু।

ইতোমধ্যে আমাদের জাহাজ ঢাকা, না’গঞ্জ আর মুন্সিগঞ্জ জেলা পার হয়ে কুমিল্লা জেলায়। এবার আমাদের গাইড মিলন ভাই (ইনি আসলে গাইড ট্যুরের মালিক) এর নির্দেশে জাহাজ থামে মাঝ নদীতে। অসম্ভব তারুন্যে ভরা, মজার মানুষ মিলন ভাই। ষাটের কোঠায় বয়স। অথচ এ মানুষটিকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই! সারাক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখেন।

সন্ধ্যায় চা-নাস্তা সেরে সবাই মিলে বসে যায় আড্ডায়। আড্ডার নির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্তু নেই। ছবি আঁকা দিয়ে শুরু হয়। এরপর বিষয়ের আর লাগাম থাকে না। কে কাকে কতোটা পঁচাতে পারে, গত ক্যাম্পে কী কী হয়েছে, কে কে যেতে পারেন নি, শিল্পীরা কেনো ‘আউলা’ জীবন যাপন করে... একটার পর একটা বিষয় চলতেই থাকে।

সাথে চা / কফি / সিগারেট। আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে ‘ চায়ের কাপে ঝড় থোলা’। রাত নয়টা নাগাদ মিলন ভাই বেরসিকের মতো ঘোষনা দেন, আগামী ত্রিশ মিনিটের মধ্যে ভাবার টিবিলে যারা যারা যেতে ব্যর্থ হবেন, তারা রাতের খাবার থেকে বঞ্চিত হবেন। এরপর আর বসে থাকা যায় না। খাবারের পর আবার আড্ডা হবে এ কথার ওপর ভরসা করে সবাই খেতে গেলেন।

খাবারের টেবিলে গিয়ে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। কী ব্যাপার? সরেজমিনে যেয়ে দেখা গেলো, ভয়াবহ সব খাবারের আয়োজন। ফ্রাইড রাইস, চিকেন বার-বি-কিউ, ফ্্র্যান্স ফ্্রাই, টমেটুর চাটনি, পটল ভাজি, সালাদ আর পুডিং। সাথে তরল পানীয়। দশটার মধ্যে রাতের খাবারের পর্ব শেষ... এরপর শুরু হয় আড্ডা আর গান।

জাহাজের পেছনে এসে হাতের কাছে যে যা পেলো তাই দিয়ে বাজানো শুরু করে দিলো। হে ঈশ্বর, সে কী ভয়ানক সব মিউজিক ! গানের পাশে হরদম নাচও চলছিলো। সে নাচের কোনো তাল- লয়ের বালাই নেই। গানেরও কোনো সীমা পরিসীমা নেই। বাংলা সিনেমার পুরোনো দিনের গান থেকে শুরু করে- মমতাজ, মিলা, আসিফ, হাসান, কিশোর, মান্না, টুটুলসহ হালের মনপুরার বিখ্যাত সব গানের কোনোটাই বাদ পড়ে না।

সুর বরিশাল তো কথা ঠাকুরগাঁয়ে...। প্রায় সবাই গাইছে। কে যে শুনছে, আল্লাহ মালুম ! আকাশে বিশাল একখান চাঁদ মামা। বলাবাহুল্য, সে রাত ছিলো দোল পূর্ণিমার রাত। ঘোর লাগার রাত...।

মনে ঘোর নিয়ে রাত তিনটা নাগাদ মোটামুটি সবাই নিজ নিজ রুমে চলে গেলো। সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠার ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। এরমধ্যে দরজায় ধুপ ধাপ শব্দ। কী ব্যাপার, জাহাজে ডাকাত পড়লো নাকী ? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, কে ? এর মধ্যে মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম সকাল সাতটা বাজে...। ভীষন রাগ হলো।

বুঝলাম, ডাকাত-ফাকাত কিসস্যু না। বন্ধুদেরই কেউ। তাই বলে এত সকালে ? রুমের বাইরে বেরিয়ে এলাম। রুমের সামনে ৩/৪ জন দাঁড়িয়ে আছে...। ওদের নাকী ছবি আঁকা প্রায় শেষ।

আমাকে ছবি তুলতে হবে। সে জন্যই ডাকাডাকি করছে। হায় কপাল আমার ! জাহাজের ডেকে ক্যামেরা নিয়ে উঠে মনটা ভালো হয়ে গেলো। আসলেই সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছেন। জাহাজের এদিক সেদিক রঙ ছড়িয়ে আছে।

সারা জাহাজ ঘুরে শিল্পীদের ছবি আঁকার ম্যালা ছবি তুললাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম জাহাজের তিন তলায়। ইতোমধ্যে জাহাজ আবার চলতে শুরু করেছে। দুপুর নাগাদ আবার পদ্মার কোনো এক অজানা চরে জাহাজের নোঙ্গর ফেলা হলো। প্রায় সবাই পানিতে।

বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন তাঁরা। সবার ছবি আঁকা শেষ। মিক্সড সব্জী, লাউ আর মাগুর মাছের তরকারী, ছোট মাছ, মুরগী আর ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার। এরপর সবাই নিজের ছবির কাছে...। শেষ বারের মতো দেখছে আর প্রয়োজনে দু’এক স্থানে তুলি ছোঁয়াচ্ছে।

বিকেল পাঁচটায় অবসর জাহাজ যখোন না’গঞ্জ ঘাটে পৌঁছলো, তখোন প্রায় সবাই ঘুমে। ঠেলে-ঠুলে উঠানো হলো সবাইকে। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শিল্পীদের আর কেই রইলো না জাহাজে। সবাইকে নিয়ে গাইড ট্যুরের বাস রওয়ানা হলো ঢাকার পথে। জাহাজে রয়ে গেলাম আমি আর গাইড ট্যুরের মিলন ভাই।

ঢাকা থেকে এলেন মিলন ভাবী, তাদের নাতনী অরা, রেজা ভাই আর ভাবী, নওরোজ আর স্বর্ণা, শিমু নাসের আর কিমি। না’গঞ্জ থেকে উঠলো আমার বৌ আর ছেলে রোদ্দুর। আমাদের নিয়ে জাহাজ আবার ভাসলো রুপগঞ্জের দিকে। আজ রাতটা আমরা জাহাজে কাটাবো। কাল সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় ফিরবো।

ধীরে ধীরে জাহাজ চলছে...সূর্যটাও পাল্লা দিয়ে ডুবছে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।