ছোটবেলায় অনেক বাক্যের অর্থ বোঝা সম্ভব হয়নি, বুঝলেও ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিনি। জোর যার মুলুক তার - তেমনই একটি। যার পূর্ণ অর্থ এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ বুঝিয়েছে আমার এক বন্ধু। তানভীর। যার আচরণে আমরা ছিলাম অতিষ্ট।
খেলতে গেলে ঝামেলা, কোথাও দাওয়াতে গেলে খাবারের উপর তার আগ্রাসী হাত, কোথাও যাবার প্রোগ্রাম হলে তার সুবিধানুযায়ী তার বাসার নিচে একত্র হতে বাধ্য করা বুঝিয়ে দিত জোর যার সবই তার। আমাদেরও চুপ করে থাকতে হতো। থাকতে হতো বললে ভূল হবে, থাকতাম। তানভীর যে খুব শক্তিশালী ছিল তাও নয়, বন্ধুদের নিজেদের মধ্যে নানা ফাজলেমীর সময়ে চিকন চাকন এই ছ'ফুটকে আমরাই নেতা বানাতাম। আবার গোপনে গোপনে তার বিরুদ্ধে বহু প্ল্যান করতাম।
তবে কোন কাজেই শেষ পর্যন্ত সফল হতাম না কারন কেউ তানভীরের বিপক্ষে যেতে চাইতাম না। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে তা কেউ না কেউ ফাঁস করে দিত। বিপদে পড়তে হতো পরিকল্পনাকারীকে। তাই তানভীরকে সাথে নিয়েই প্ল্যান হতো। কাউকে নদীতে গোসল করার কথা বলে পানিতে নামিয়ে দিয়ে তার জামা কাপড় নিয়ে নদী পার হয়ে যাওয়া, কারো মাথায় ডিম ভাঙ্গা, ময়লা পানি শরীরে ঢেলে দেয়া, কথা না শুনলে তাকে ক্লাবের রুমে আটকে রাখা সহ বহু ছেলেমানুষী কাজ করেছি।
সব কিছুতেই ছিল তানভীর। তানভীর যেদিন আড্ডায় আসেনি, সেদিন আমরা সব ভদ্র। আমাদের উত্তেজনা নেই, নেই ফাজলেমিও। আড্ডার পরিবেশও সেদিন থাকত শান্ত।
বোঝাই যেত তানভীর আসেনী।
২.
দুষ্টামী, ফাজলেমির সাথে তানভীরের নাম মিশে থাকলেও বন্ধু তানভীরকে পেয়েছি বন্ধুত্বের কঠিন কঠিন পরীক্ষাতেও। কোন বন্ধুর জন্য বিপদের অনিশ্চিত অন্ধকারে ঝাপ দেয়ার সময়েও। আমি, তানভীর, আমরা দশ বারোজন এক হয়ে হাতে হাত রেখে চলেছি বছরের পর বছর। এ হাত কেউ ছাড়বো না এমন প্রতিজ্ঞাও ছিল সবার। কিন্তু যা ভাবা হয়নি তাই হলো, যাকে ভাবিনী সেই তানভীরই প্রথম তার হাত সরিয়ে নিল।
শুধু হাতই সরিয়ে নিল না। চলেও গেল। এমন দুরুত্বে যেখানে আমরা হাজারো চেষ্টায়ও যেতে পারবোনা, ধরতে পারবোনা তার হাত।
৩.
একদিন হঠাৎই চলে গেল তানভীর। আমাদের কেউ কোথাও গেলে সকাল বা সন্ধ্যার আড্ডায় জেনে যেতাম।
এই প্রথম আমাদের মধ্যে কেউ এমন জায়গায় গেলো যা আমরা জানলাম না। শুনলাম তানভীরকে পাওয়া যাচ্ছেনা। শুনে অবশ্য অবাক হলাম না। ভাবলাম, এসে পড়বে। হঠাৎ তার এক আত্মীয় জানাল, সে যেখানে গেছে সেখানে ট্রলারে পার হতে হয়।
গতকাল একটা ট্রলার ডুবে গিয়েছে। কয়েকজন নিখোঁজ। আমার ভেতরে ধুমড়ে মুচড়ে গেলো। এটা যদি সত্যি হয় এবং এই ট্রলারে যদি তানভীর থেকে থাকে?
ভাবতেই যেন অন্ধকার নেমে এলো। মনে পড়ল, তানভীর আর আমি একসাথে সাঁতার শিখেছি, সাঁতার পারলেও তেমন সাঁতার পরতাম না আমরা।
এরপরের ঘটনা?
সারাদিন সারারাত ধরে সেই নদীর তীরবর্তী এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি তানভীরকে। বন্ধু তানভীরকে। চাইনি এভাবে হারাক তানভীর। লাভ হয়নি। কারন সেই ট্রলারেই সে ছিল।
দুদিন পর তানভীরকে পাওয়া গেল। নদীতে ভেসে থাকা অবস্থায় দেখলাম নিথর তানভীরকে। এতদিন জোর খাটিয়ে সব কিছু করা তানভীর সামান্য জোর খাটিয়ে উঠে আসছেনা। মনে মনে বললাম, বন্ধু উঠে আয়।
৪.
আজকে পাঁচ বছরই পার হয়ে গেলো।
তানভীর নেই। সবই আছে, সবাই আছে। এখনও খেলতে যাই মাঝে মাঝে, দাওয়াতেও যাই, খুঁজি তানভীরকে। ভাবি, এই বুঝি তানভীর আসবে। তানভীর আসেনা।
এখনো কোন কোন কাজের আগে তানভীরের বাসার সামনে দাঁড়াই। তাকিয়ে থাকি তানভীরদের দোতলা বাড়ির বারান্দার দিকে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় অনেক সময় কেটে যায়।
তানভীর আর নামেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।