চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
অনলাইনে খিস্তি খেঁউড় দেখে অনেকে আঁতকে উঠেছেন। কেউ কেউ আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন এই খিস্তি খেউরের অনলাইন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে। অনেকে জানতে চেয়েছেন, এতো গালি হজম করি কীভাবে? কেউ জিগ্যেস করেছে, “আপনি কী কোন টেম্পার কন্ট্রোলের কোর্স করেছেন?”
আসলে এই পৃথিবীতে আপনি ততদিনই নিরাপদ যতদিন আপনি কোন ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারবেন না। ফ্যাক্টর হয়ে উঠলেই বিপদ ঘনিয়ে আসবে। আপনার যুক্তি যত ক্ষুরধার হবে আপনি তত বেশী গালিগালাজের শিকার হবেন।
কারণ, মনোবিদ্যায় বলে, আপনার যুক্তি খণ্ডনের কোন ক্ষমতা না থাকলে আপনার প্রতিপক্ষ হতাশায় ভুগবে, আর গালি দিয়ে সেই হতাশা ঢাকার চেষ্টা করবে। বিরোধী মতকে সেই কারণেই কদর্য অশ্লীল ভাষায় কুরুচিকর আক্রমণ চিরদিন হয়েছে। সংস্কৃতি, খেলা, রাজনীতি সব ক্ষেত্রে। এ জিনিস কোন নতুন আমদানি নয়।
১৮০০ সালে আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস সম্পর্কে বিরোধী টমাস জেফারসনের পক্ষ থেকে ক্যাম্পেনে লেখা হল অ্যাডামস ‘একটা বীভত্স হিজড়ে গোছের চরিত্র, যাঁর পুরুষের বলিষ্ঠতাও নেই, নারীর নম্রতাও নেই।
’ আবার জেফারসন সম্পর্কে পাল্টা মন্তব্য এল ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের থেকে: ‘উনি ক্ষমতায় এলে এমন আইন করবেন, আমাদের বউ ও মেয়েরা বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য হবে। ’
১৮২৮-এ প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডামস সম্পর্কে ডেমোক্র্যাটরা বলল, উনি রাশিয়ার জার-এর জন্য মেয়ে জোগাড় করে দিতেন, দালাল। তার উত্তরে অ্যাডামস শিবির বলল, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বারো জন রেড ইন্ডিয়ানের মৃতদেহ তারিয়ে তারিয়ে ব্রেকফাস্টে খেয়েছেন, আর ওঁর মা বেশ্যা, স্ত্রী ব্যভিচারিণী।
১৮৩৬-এ কংগ্রেসম্যান ডেভি ক্রকেট বিরোধী মার্টিন ভ্যান বুরেন সম্পর্কে বলেন, ও তো গোপনে মেয়েদের পোশাক পরে থাকে! ১৮৭৬-এ রাদারফোর্ড হেস-এর বিরোধীরা বলতে শুরু করেন, তিনি নিজের মা’কে রাগের মাথায় গুলি করে মেরেছেন। একটা নির্বাচনের আগে আব্রাহাম লিঙ্কনের বিরুদ্ধে কাগজে লেখা হল, তিনি দশ দিনে এক বার মাত্র মোজা পাল্টান! তাই তার গায়ে বীভৎস গন্ধ।
তবে বামপন্থীরাও বেশ খিস্তি পারে। ২০০৬-এ জাতিসংঘে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেস জর্জ বুশ সম্পর্কে বললেন, ‘কালকে শয়তান এসেছিল এখানে। এখনও এই জায়গাটায় সালফারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে!’
১৯৯৩-এ কানাডায় সাধারণ নির্বাচনের আগে লিবারাল নেতা জাঁ শ্রেতিয়েঁ-র মুখের আংশিক পক্ষাঘাতকে নিয়ে শুরু হয় বিরোধী শিবিরের ক্যাম্পেন, তাঁর মুখের বিভিন্ন ছবির স্থিরচিত্রের পিছনে ভয়েস-ওভারে বলা হতে থাকে, ‘এ হবে আমাদের রাষ্ট্রপতি?’ কানাডাতেই ২০০৮-এ কনজার্ভেটিভ দলের ক্যাম্পেনে দেখানো হল, (অ্যানিমেশন ব্যবহার করে) বিরোধী নেতা স্তেফানে ডিয়ন-এর গায়ে একটা পাখি হাগু করছে।
১৯৪৭-এ ইংল্যান্ডের সংসদের বিরোধী দলনেতা উইনস্টন চার্চিলকে জিজ্ঞেস করা হয়, স্ট্যানলি বল্ডউইনের আশি বছর পূর্ণ হচ্ছে, হোক তিনি আপনার রাজনৈতিক বিরোধী, আপনি শুভকামনা জানাবেন না? চার্চিল বললেন, ‘আমি ওঁর অমঙ্গল কামনা করি না, কিন্তু উনি আদৌ না জন্মালেই খুব ভাল হত। ’
মহাকাব্যও খিস্তি খেঁউড় ছাড়া রচিত হয়নি।
মহাভারতে যুদ্ধের সময় অভিমন্যু দুঃশাসনকে বলেছেন ধর্মত্যাগী, কটুভাষী, নিষ্ঠুর মূর্খ। কর্ণ ভীমকে মাকুন্দ বলে গালি দিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিসের খ্যাত কমেডি রচয়িতা অ্যারিস্টোফেনিস নিজের নাটকে ভূরি ভূরি কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন উনার সমকালীন নাট্যকারদের সম্পর্কে। তাঁদের ব্যাঙ-ও বলেছেন। প্রথম শতাব্দীতে রোমে স্যাটায়ার লিখতেন সেনেকা, জুভেনালরা।
সেই সব লেখায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের নোংরা খিস্তিখেউড় করা স্বভাবে পরিণত হয়েছিল তাঁদের। মধ্যযুগে কম যাননি দান্তেও। ‘ডিভাইন কমেডি’র প্রথম অংশ ‘ইনফার্নো’তে নিজের আসল দুনিয়ার শত্রুদের নামের চরিত্রদের নরকের বিভিন্ন কক্ষে ঠাঁই দিয়েছিলেন। যমদূতেরা সেখানে তাঁদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালিয়েছিল!
প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলায় কবিয়াল রামপ্রসাদ ঠাকুর সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়াল রাম বসুকে ছড়ায় যে ভাষায় বিঁধেছিলেন তা উপভোগ করেছিলেন নবকৃষ্ণ দেবরা।
‘নাই কো রাম বোসের এখন সেকেলে পৌরষ,
এখন দল করে হয়েছেন রাম বোস রাম কামারের অণ্ডকোষ’।
আর উনিশ শতকে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘সম্বাদ রসরাজ’ ঈশ্বর গুপ্তকে ‘সমকামী’ বলে খিস্তি করে ছড়া লিখলোঃ
‘শুন হে ঈশ্বরদাস জিজ্ঞাসি তোমায়
যথার্থ মনের কথা বলিবে আমায়
... পত্নীর সুরম্য স্থান কিসে দেখ মন্দ
ভালবাস কি কারণ শিশু গুহ্য গন্ধ
কি জন্য ছাড়িলে পত্নীসহ সুখরতি
কি হেতু বালকগুহ্যে হইয়াছে মতি
কি কারণ দারাসহ আলাপে প্রমাদ
শিশুগুহ্য লেহনেতে এত কি আস্বাদ
মহাপাপী নরাধম গুপ্ত কর্তাভজা
মজাইয়া শিশুগণ ভোগ মারে অজা। ’
কিছুদিন আগে অ্যামেরিকায়, নারী অধিকার কর্মী সান্দ্রা ফ্লুক একটি আলোচনাসভায় কলেজ-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় গর্ভনিরোধক দেওয়ার পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। মার্কিন রাজনৈতিক সমালোচক এবং একটি জনপ্রিয় রেডিয়ো টক শো-র হোস্ট লিম্বুয়া লিম্ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই বেশ্যাটি এত বার সহবাস করেছেন, অথচ তাঁর নিজের জন্মনিয়ন্ত্রণের খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই! তাই ওবামা আর পোপের কাছে সেই খরচ মেটানোর দাবি তুলেছেন!’
ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ চলাকালীন ভারতীয় উইকেটকিপার পার্থিব পটেল একটি ক্যাচ মিস করলে কমেন্ট্রি বক্সে প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেন বলেন, ‘ভারতীয় দলের মধ্যে তিন-চার জন ভাল ফিল্ডার রয়েছে। তবে মাঠে এক-দু’জন বাঁদরও ফিল্ডিং করছে। ’ পাশ থেকে সঞ্জয় মঞ্জরেকর ‘বাঁদর’দের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি কয়েকজনের নাম করেন।
তবে কোন খিস্তি খেঁউড়ই শেষ পর্যন্ত খিস্তি দাতার জয় ডেকে আনেনি। খিস্তি দাতার সেই নিদারুন পরাজয় দেখতে চাইলে মুজতাবা আলীর মতো আপনার ও বলতে ইচ্ছে করবে, “বেচে থাকো খিস্তি খেঁউড়”।
বাংলাদেশেও বেশ কিছু ভালো ফেসবুকার, ব্লগার আছে, তবে দু একজন বাঁদরও আছে। সঞ্জয় মঞ্জরেকরের মতো বাঁদরের নাম জিজ্ঞেস করে আমাকে লজ্জা দিবেন না। বাঁদর গুলো বাঁদরামি করবেই, আপনার কাজ আপনি করুন।
খিস্তির কোন ইতিহাস লেখা হয়না। লেখা থাকে শুধু সংগ্রামের ইতিহাস। আপনার ফেসবুকিং যদি সেই সংগ্রামের কনামাত্র ও হয় তবে ভয় নেই রাজহাঁসের পালকের মতো খিস্তি খেঁউড় উড়িয়ে দিয়ে তর তর করে এগিয়ে যান। আমিও তাই যেতে চাই।
তথ্য সুত্র এবং কৃতজ্ঞতাঃ গালি চিরকালই, রোহণ ইসলাম
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।