এদিককার রিক্সাগুলোয় দুজনে স্বচ্ছন্দে বসা যায় না। শরীরে অস্বস্তি টের পাচ্ছিল কৌস্তভ। মনটাকে অন্যদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দ্বিগুণ বিপত্তি! শরীর উষ্ণ হচ্ছে। বিপাশা রিক্সার ঝাঁকুনি সামলাবার চেষ্টা করতে করতেও টের পাচ্ছিল কৌস্তভ শক্ত কাঠের মতো হয়ে উঠতে চাইছে। মনে মনে হাসছিল বিপাশা।
কৌস্তভ ওর চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোটো। মৃণালের কলেজে জয়েন করে মৃণালের রুমেই পেয়িংগেস্ট হিসেবে উঠেছিল। গ্রামের ছেলে হলেও পড়াশোনায় ভালো। একেবারে ডক্টরেট করেই কলেজে ঢুকেছে। কৌস্তভের চেহারায় এবং পোশাক পরিচ্ছদে একটু গ্রাম্যতার রেশ ছিল, কিন্তু বিপাশার সংস্পর্শে এসে সবটুকু গ্রাম্যতা মুছে যেতে দেরি হয়নি।
কৌস্তভের চেহারায় এবং পোশাকে একটা ঝকঝকে ভাব এলেও মনের মধ্যে গ্রাম্যতার রেশ এখনও রয়ে গেছে। সে কারণেই কৌস্তভ বিপাশার ঘনিষ্ঠ শারীরিক উষ্ণতায় দারুমূর্তি হয়ে যাচ্ছে। বিপাশা ডান হাতটা কৌস্তভের পিঠের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিল।
বর্ষায় ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাওয়া নিচের পাথরগুলো রিক্সার চাকার সঙ্গে চমৎকার একটা লাফালাফির খেলা খেলছে। বিপাশার বত্রিশ বছরের বিস্ফোরক দক্ষিণ বুকের সঙ্গে কৌস্তভের বাঁদিকের অংশে মাঝে মাঝেই বেশ চেপে বসছে।
কৌস্তভ চলমান রিক্সা-কাটা বাতাসেও বিন্দু বিন্দু ঘামছে। বিপাশা লক্ষ্য করেছে তার শরীরের প্রতি কৌস্তভের গোপন আকর্ষণ বেশ তীব্র। না দেখার ভান করে বিপাশা কৌস্তভকে তার শরীরের সম্পদ নানাভাবে দেখাবার চেষ্টা করেছে। কৌস্তভ ধরা না পরার আপ্রাণ চেষ্টা করেও বিপাশার কাছে বারবার ধরা পড়ে গেছে। বিপাশার প্রতি কৌস্তভের আকর্ষণ দিন দিন শুধু অমোঘই হয়ে ওঠেনি--মুগ্ধতায় ক্রমশ অন্ধ হয়ে উটেছে।
কিন্তু মনের ভেতরের গ্রাম্যতা কৌস্তভকে আরষ্ট করে রাখে প্রয়োজনীয় মুহূর্তগুলোতে। যেমন আজ এই মুহূর্তে--কিন্তু বিপাশাও আজ মরিয়া। কাঙ্ক্ষিত জীবন যেমন একদিকে গড়াতে গড়াতে অনিবার্য মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছিল, ঠিক তেমনই অন্যদিকে প্রাণপণে বেঁচে ওঠার তাগিদে বিপাশা ধীরে ধীরে কৌস্তভের সান্নিধ্যকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে।
স্বামী হিসেবে মৃণাল বিপাশার উপযুক্ত নয় অনেক দিক থেকেই। তবু নানান ঘাটতি সত্ত্বেও বাপ-মায়ের নির্বাচিত মৃণালকে মেনে নেবার চেষ্টায় বিপাশার ফাঁক ছিল না।
মৃণাল নিজে কবিতা লেখে না। কবিতা সকলে লেখেও না। কিন্তু যে বিপাশার কবিতা নিয়ে হৈ-চৈ হয়--পত্র-পত্রিকা থেকে চিঠিপত্র আসে--সেই বিপাশার অধ্যাপক স্বামী মৃণালের বিপাশার কবিতাই শুধু নয়--কবিতা বিষয়টাই পছন্দের বিষয় নয়! তার পছন্দের বিষয় হলো--কলেজ থেকে ফিরে ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি গলিয়ে ঘাড়ে-বগলে পাউডার ছড়িয়ে দু'একজন সহকর্মী সহ কেরানি-দোকানদারদের সঙ্গে ক্লাবে কল-ব্রে নামে ফাটকাবাজির তাস খেলা। রাত দশটা-সাড়ে দশটায় ফিরে কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় গড়িয়ে যাওয়া ছাড়া অন্যকোনো নেশা মৃণালের নেই। কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে এমন একজনও যে কেউ থাকতে পারে বিপাশার কল্পনার মধ্যে ছিল না।
নিজের বিষয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে পাঠ্যপুস্তক আর সকালে খবরের কাগজ ছাড়া অন্য কোনো বইপত্র নাড়াচাড়া করতে বিশেষ একটা দেখা যেত না। এমনকি বিয়ের পরে বিপাশাও তার যাবতীয় ঐশ্বর্য নিয়ে মৃণালের সামনে দাঁড়ালেও মৃণালের কাছে সে নেশা হয়ে উঠতে পারেনি! যৌনতার ক্ষেত্রেও মৃণালের অনীহা বিপাশাকে প্রথম প্রথম বিচলিত করেছে। পরে জেনেছে মৃণাল নিয়মিত মদ্যপান করে। শুনেছে নিয়মিত মদ্যপানের মাত্রা বাড়তে থাকলে যৌনক্ষমতা কমে যায়--অনীহা জন্মায়। এই কারণটাকে সামনে রেখে বিপাশা সরাসরি মৃণালের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিল।
সংঘর্ষ দিনদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। সমস্যার কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের সঙ্গে একদিন বিপাশা আবিষ্কার করেছে--তারই কাজের মেয়ের শরীরের মধ্যে মৃণাল যা পায় বিপাশার শরীরের মধ্যে তা পায় না বলেই তার অনীহা বা অক্ষমতা!
এরপর আর লড়াই চলে না। এরপর আর একদিনও নিজেকে মৃণালের সঙ্গে এক শয্যায় ভাবতে পারেনি। মানুষ আর যাই হোক--কুকুর-বেড়াল তো নয়।
অতএব বিপাশার জীবনে মৃণাল ক্রমশই অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আর মৃণালের অস্তিত্বের অবক্ষয়ের ফাঁক দিয়ে কৌস্তভের অস্তিত্ব বিপাশার কাছে অনিবার্য কারণেই মূল্যবান হয়ে উঠেছিল।
বিপাশার প্রতিটি কবিতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কৌস্তভ। ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করে তর্ক করে। দেশ-বিদেশের কবিতার বই খুঁজে এনে দেয়।
মাঝে মাঝে বিপাশাই তার কবিতার খাতা নিয়ে কৌস্তভের সঙ্গে ধান ক্ষেতের পাশে চলে যায়। নদীর ধারে চলে যায়। নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছি আসে। হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়ে কৌস্তভকে দু'হাতে আঁকড়ে ধরে।
আঁচল লুটোয় মাটিতে। চশমার কাচের দেওয়ালের ওপাশে কৌস্তভের চোখের মণি জ্বল জ্বল করে। কবিতার আলোচনা তুমুল হয়ে ওঠার কারণে কপালে কপাল ঠুকে যায় হাসতে হাসতে কৌস্তভের হাঁটুর ওপর জলপ্রপাতের মতো বিপাশা ছড়িয়ে পড়ে। জলের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে--মনও জলজ অনুভূতিতে টলে ওঠে। মৃণাল কেন ওর জীবনে কৌস্তভ হয়ে উঠতে পারলো না?
অথচ কৌস্তভ হাত বাড়াতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেয়।
বিপাশা অপেক্ষায় থাকে। মৃণালের ছায়া সরে গেলে কৌস্তভ একদিন বনস্পতি হয়ে উঠবে নিশ্চিত।
অবশেষে মৃণালের ছায়া সরে গলে গতকালই। বিপাশার পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন শেষ হয়েছে গতকাল বিকেলে। বিকেলেই এক অসহ্য উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে কৌস্তভকে টেলিফোনে খবর দিয়েছিল বিপাশা--'আমি তোমার নতুন কলেজের নতুন কোয়ার্টারে কালই যাচ্ছি।
স্টেশনে থাকবে। কথা আছে। '
মৃণালের সঙ্গে বিপাশার বিচ্ছেদের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠার সময় থেকেই কৌস্তভ অন্য কলেজে চাকরি খুঁজতে শুরু করেছিল। পেয়েও গিয়েছিল কলকাতার কাছেই এই নতুন কলেজে। বিপাশার সঙ্গে যোগাযোগ ছিলই।
--আমরা এসে গেছি। এখানেই নামতে হবে।
একটা ছোট্ট হলুদ রঙের একতলা বাড়ির সামনে রিক্সা দাঁড়াল। সামনে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। বিপাশার মনে হলো, অনেক পথ পেরিয়ে এসে ছায়াঘন এক শীতল জলাশয়ের তীরে এসে দাঁড়াল।
হাত বাড়ালেই টলটলে জল। বাঁশের গেট ঠেলে ছোট বাগান পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে কৌস্তভের সঙ্গে ঢুকলো বিপাশা। প্রথমেই ছোট কিন্তু চমৎকার সাজানো বসার ঘর। বিপাশা একটা বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে বসলো। বসার বিপজ্জনক ভঙ্গির প্রতি কৌস্তভের চোখ আটকে গেল না দেখে বিপাশা সামান্য অবাক হলো।
--কি খাবে বলো?
জানতে চাইলো কৌস্তভ।
--ব্যস্ত হয়ো না। তেমার সঙ্গে কথা আছে।
--বেশ তো, কথা হবে। কিন্তু--
--এক গ্লাস জল খাওয়াতে পার?
--এক মিনিট!
কৌস্তভ পর্দা সরিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল।
বিপাশা মনে মনে বলার কথাগুলো কিভাবে শুরু করবে ভাবতে লাগলো। নিজের স্কুলের চাকরি বজায় রাখতে হলে প্রতিদিন কলকাতা থেকে এতদূর যাতায়াত করা সম্ভব হবে? কৌস্তভকেই কলকাতা থেকে প্রাথমিকভাবে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতে হবে। পরে কলকাতারই কোনো কলেজে ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
কৌস্তভ গ্রামের জল-হাওয়ায় মানুষ হলেও মানসিক দিক থেকে মৃণালের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাছাড়া সাতিহ্য-শিল্পের সঙ্গে কৌস্তভের একটা স্বাভাবিক যোগ আছে, তার বোধও ফাঁকা নয়--বেশ গম্ভীরই বলা যায়।
বিপাশা ভাবলো--কোনোরকম ধানাই-পানাই না করে সরাসরি আসল কথাটা কৌস্তভকে বলে দেবে। একটা দিন ঠিক করে রেজি:-টা সেরে নেবে। বিপাশার সঙ্গে কৌস্তভের বছর পাঁচেকের ফারাকটা নিয়ে সে আদৌ কিছু ভাবছে না। কারণ গোটা শরীর দিয়ে বিপাশা কৌস্তভের শরীরের উষ্ণতা নানা সুযোগে টের পেয়েছে। তার বুঝতে ভুল হয়নি।
শুধুমাত্র গ্রাম্য রক্ষণশীলতার শক্ত বেড়াটা এখনো ভেঙে ফেলতে পারেনি। বৈধ সম্পর্কের প্রশ্নকে কৌস্তভের মতো ভদ্র শালীন ছেলেরা বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এদিক থেকে বিপাশা মনে মনে অনেকটাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিশ্চিন্ত হয়।
--আপনার জল।
বিপাশা চমকে উঠে দাঁড়ায়।
আঠারো-ঊনিশের একটি পুতুল পুতুল গড়নের মেয়ে ঝতঝকে কাঁসার গ্লাস ভর্ত্তি জল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সিঁথিতে টাটকা সিঁদুর। কপালে জ্বলজ্বলে পয়সার সাইজের গোল টিপ। খোলা একপিঠ চুলের প্রেক্ষাপটে গোল ফোলা ফোলা মুখের মধ্যে আসল সৌন্দর্য্য বড় বড় দুটি চোখের দৃষ্টির মধ্যেই! মসৃণ গলা। বুকে এবং শরীরের নিম্নাংশে প্রবল ঢেউ বিপাশাকেও স্তম্ভিত করে দিল।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিল বিপাশা। একবুক তৃষ্ণা। ঢক্-ঢক্ করে এক নি:শ্বাসে জলটা খেয়ে নিল।
--আপনি একটু বসুন। উনি এক্ষুণি আসবেন।
আমি রান্নাঘরে যাই?
--তুমি--মানে আপনি--
--তুমিই ঠিক আছে। আমার নাম তপু। ভাল নাম তাপসী। সাতদিন হলো হঠাৎই যোগাযোগ হয়ে গেল, আর তিন দিনের মধ্যেই বিয়ে--না না, সামাজিক নিয়মে নয়--রেজিস্ট্রি বিয়ে। আমি তো সামনের এপ্রিলেই হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা দেব।
উনি আমায় পড়াতেন।
মেয়েটি ফিক্ করে হাসলো। বিপাশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির মুখের দিকে। এ মেয়ে কি জীবনানন্দের নাম শুনেছে? ফেদরিকো গর্থিয়া লরকা কে, এ কি তা জানে? জাঁ কঁকতো, লুই আরগঁ, রাইনের মারিয়া রিলকে, পাবলো নেরুদা, মায়াকভস্কির কবিতার একটা লাইনও কি এই মেয়েটা পড়েছে? কবে পড়বে? ততদিন কৌস্তভ কি তাহলে--
বিপাশা ধীরে ধীরে দরজার দিকে পা বাড়াল। একটু হাসার চেষ্টা করলো।
কাঁধের ব্যাগটা ফের কাঁধে ঝুলিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ফিরবে না জেনেও বললো--
--আসার পথে একটা নদী দেখলাম। একটু ঘুরে আসি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।