আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আতঙ্ক (ছোটগল্প)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)
সিনেওয়ার্ল্ড লন্ডনের ইলফোর্ড শাখার সামনে বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিল আসিফ এবং তমাল। এবার যেন আক্টোবরের শেষ সপ্তাহেই শীতটা বেশ চেপে বসেছে লন্ডন শহরের বুকে। রাতও হয়ে এসেছে। জমে যাওয়া হাতগুলোকে ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে খানিকটা উষ্ণ করার চেষ্টা করছিল ওরা। হঠাৎ দূরে ২৫ নাম্বার বাসটা আসতে দেখে চনমনে হয়ে উঠলো মন।

এই ঠান্ডায় নির্জন বাস স্ট্যান্ডে আর দাড়িয়ে থাকতে হবে না ভেবেই বেশ প্রফুল্য লাগছিল ওদের। বাসটা আসার সাথে সাথে তাতে উঠে সামনের দিকে পাশাপাশি দুটো সিটে বসলো দুজন। বাস প্রায় ফাকা। তবে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ভরতে শুরু করবে। বাসটা যতই হোয়াইট চ্যাপেলের দিকে যেতে থাকবে, ততই লোকসমাগম বাড়তে থাকবে।

লন্ডনের যে কয়েকটা এলাকাকে বাংলাদেশী পাড়া বলা হয় হোয়াইট চ্যাপেল সেগুলোর ভেতরে অন্যতম। ফলে বাসের যাত্রীও হয় অধিকাংশ সময় বাংলাদেশী। মাঝে মাঝে পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং ব্রিটিশও দেখা যায়। আজ ছুটির দিন, তাই খন্ডকালীন কাজ শেষে বাড়ি ফেরা বাংলাদেশী ছাত্রদের দেখার সম্ভাবনাই বেশি। বাস চলছিল এবং একটু পরপর বিভিন্ন স্টপ থেকে যাত্রী নিচ্ছিল।

কয়েকটা স্টপ পার হবার পর হঠাৎ লম্বা আলখাল্লা ধরনের পোশাক পরা একজন লোক এসে ওদের ঠিক সামনে বসলো। বাসের সামনের দিকের দুটো সারি মুখোমুখি করা। ফলে লোকটাকে খুব ভালো ভাবে দেখতে পাচ্ছিল আসিফ এবং তমাল। মুখে চাপ-দাড়ি। আলখাল্লার সাথে পায়জামা পরা যা ভাঁজ করে গোড়ালীর উপর তোলা।

সহজেই বোঝা যাচ্ছিল হয়তো খানিক আগে নামায পড়ে বের হয়েছে। চোখে সুরমা দেয়া। একটা মাঝারী ধরনের ব্যাগ রয়েছে হাতে। বাসে উঠার পর থেকেই লোকটা চোখ বন্ধ করে ঝিমাচ্ছিল। ৭/৭-এর লন্ডন বোমা বিস্ফরনের পর থেকে এধরনের মানুষ দেখলে আসিফের অন্যরকম অনুভুত হয়।

ব্যাপারটা অস্বস্তি এবং ভয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা। পুরো বাস ব্রিটিশে ভরে থাকলেও আসিফের কোন সমস্যা হয়না, কিন্তু একজন দাড়িওয়ালা মানুষ দেখলেই এই অনুভুতিটা শুরু হয়। আসিফ লোকটার উপর থেকে চোখ সরিয়ে বাহিরে তাকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কেন যেন ওর মন বারবার ফিরে যাচ্ছিল লোকটার কাছে। এক সময় জোর করে দৃষ্টিকে বাহিরে দিয়ে রাখলো সে।

হঠাৎ তমালের কনুইয়ের খোঁচা অনুভব করলো আসিফ ওর পেটে। তমাল কানের কাছে এসে নীচু স্বরে বললো, "লোকটার হাতের ব্যাগটা দেখেছিস?" আসিফ ভালো করে লক্ষ্য করেনি আগে। এবার তাকালো। কালো রঙের একটা সাধারন ব্যাগ। একটু পুরোনো বলেই মনে হলো।

তবে তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। তাই স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তমালের দিকে। তমাল আবার নীচু স্বরে ফিসফিস করে বললো, "লোকটা বাসে উঠার পর থেকে ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। একবারের জন্যও মাটিতে বা পাশের খালি সিটে রাখেনি। " এবার আসিফ বুঝতে পারলো তমাল কি বোঝাতে চাচ্ছে।

দ্রুত লোকটাকে আবার ভালো করে দেখে নিল। আসিফের মনে হলো লোকটার একটা হাত যেন ব্যাগের ভেতরে খানিকটা ঢোকানো। আসিফ কিছু বলার আগেই তমাল আবার বললো, "ট্রিগার চাপ দিবে বলে কি হাত ঢোকানো?" লন্ডনের প্রচন্ড ঠান্ডায়ও আসিফ ওর কপালে ঘাম অনুভব করলো। তমালের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে রীতিমত দরদর করে ঘামছে। লোকটা তখনও চোখ বন্ধ করে আছে।

একটা হাত ব্যাগের ভেতরে। অল্প হলেও বোঝা যাচ্ছে ঠোট নড়ছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। এক কথায় ভয়ঙ্কর লাগছে লোকটাকে। মনেমনে আল্লাহর নাম নিতে শুরু করলো আসিফ।

পরবর্তি স্টপ যেটাই হোক নেমে যাওয়া দরকার। কিন্তু তমালকে যে এ কথা বলবে সে শক্তিও যেন ওর নেই। পাথরের মত লোকটার সামনে ওরা দুজন বসে রইলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটার হাতের দিকে। প্রতিটা মূহুর্ত যেন একেকটা বছর বলে অনুভুত হচ্ছিল।

ওদের ঠিক সামনে থেকে যদি বোমা বিস্ফরন ঘটায়, শরীর ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সম্ভবত চিৎকার বা শেষ অর্তনাদেরও সময় থাকবে না। আসিফের মনে পড়লো ৭/৭ এর লন্ডন বোমা বিস্ফরনের সেই বাসের চিত্র। কি ভয়াবহ ছিল সে দৃশ্য! হঠাৎ লোকটা চোখ খুলে তাকালো। তমাল সাথে সাথে আসিফের হাত প্রায় খামচে ধরলো।

আসিফ অনুভব করছিল ওর হৃদপিন্ড যেন ফেটে বের হয়ে আসবে, এত জোরে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। লোকটা ব্যাগটা ওভাবে বুকের সাথে ধরে উঠে দাড়ালো। তারপর বাস থামার জন্য বেল বাজালো। এক দৃষ্টিতে আসিফ এবং তমাল তাকিয়ে আছে কি হয় দেখার জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।

পরবর্তি স্টপে বাসটা থামলে লোকটা নেমে গেলো। বাস আবার চলতে শুরু করলো। কিন্তু আসিফ এবং তমাল নিজেদের মধ্যে একবারও এ নিয়ে আর কথা বললো না। আসলে ওদের স্নায়ু তখন প্রচন্ড ক্লান্ত। সিটে হেলান দিয়ে দুজনই অসার ভাবে পড়ে রইলো; যতক্ষন না বাসটা ওদের হোয়াইট চ্যাপেলে নামিয়ে দিল।

বাস থেকে নামার পর স্ট্যান্ডেই এক বড় ভাই, রায়হান ভাইয়ের সাথে দেখা হলো ওদের। তমালের শক্তি মনে হয় ফিরে এসেছে তখন। হড়হড় করে বাসের সব ঘটনা বলে ফেললো। রায়হান ভাই শুনে হাসতে শুরু করলেন। তমালও তখন হাসছে।

কিন্তু আসিফ একদম গম্ভীর। রায়হান ভাই জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। আসিফ খানিকক্ষন চুপ করে থেকে জানতে চাইলো বুকের সাথে ব্যাগ চেপে ধরে রাখার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? রায়হান ভাই বললেন, "এর ব্যাখ্যাতো খুব সহজ। সম্ভবত কোরআন শরীফ ছিল ব্যাগে। " আসিফ ভেবে দেখলো তাই তো! ব্যাখ্যাটা বেশ যুক্তিসঙ্গত এবং প্রথম চিন্তায় এটাই মাথায় আসার কথা।

একজন মুসলিম একটা ব্যাগকে পরম যত্নে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। কি থাকতে পারে তাতে? স্বাভাবিক চিন্তায় পবিত্র কোরআন থাকার বিষয়টাই সবার আগে মনে আসার কথা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছে যে পবিত্র কোরআনের পরিবর্তে তাতে বোমা থাকার সম্ভাবনা প্রথম মনে আসছে। এলোমেলো ভাবে দুয়েকটা গাড়ী চলে যাওয়ার শব্দ আসছিল। কনকনে ঠান্ডা বাতাস কানের কাছে যেন ছুরির মত কেটেকেটে যাচ্ছিল।

লন্ডনের রাস্তায় শীতের সেই রাতে হাটতে হাটতে আসিফ ভাবছিল, বোমা বিস্ফরনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে, যারা দাবী করে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ করছে, সেই নির্বোধ মানুষগুলো কি বোঝে না তারা আসলে ইসলামের বিপক্ষে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা আজ মুসলিমদেরই দলেদলে বিভক্ত করে দিচ্ছে। আজ একজন মুসলিম হওয়া স্বত্ত্বেও আরেকজন মুসলিম দেখলে আসিফ ভয় পায়। একজন দাড়িওয়ালা মানুষ দেখলে বা কেউ আরবীতে কথা বললে অবচেতন মন তাকে অজানা হামলাকারী বলে ভেবে নেয়। বরং একজন ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ানই যেন আসিফের কাছে অনেক বেশি বন্ধুভাবাপন্ন।

এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হয়তো মুসলিমরাই মুসলিমদের থেকে দূরে সরে যাবে। কারন বোমার ভয়াবহতা কোন জাতি, বর্ন বা ধর্ম চেনে না। চেনে কেবল রক্ত; আর সেটার রং এবং স্বাদ সব মানুষেরই এক। ২৭ নভেম্বর ২০০৮ ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড। অক্টেবর ২০০৮-এর লন্ডন ভ্রমনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখিত।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।