এফ বি সি আইয়ের বর্তমান সভাপতি, পোশাক শিল্প মালিক আনিসুল হক, সম্প্রতি কোনো একটি মত বিনিময় সভায় মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে প্রাপ্ত রপ্তানী আয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, এবং এটা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব।
তবে এর জন্য আমাদের অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে, আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন প্রয়োজন, আমাদের বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র বদল করতে হবে, অহেতুক গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংসের জন্য শ্রমিক অসন্তোষ নির্মূল করতে হবে।
অনেক রকম প্রস্তাবনাই আছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিক সমিতির।
বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই উন্নয়নশীল দেশ, বাংলাদেশের মাথাপিছি বাৎসরিক আয় বর্তমানের ৪ গুন বাড়ানোর প্রক্রিয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদের অনেক শ্রমঘন্টা ব্যয় করছেন, বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এটা নিয়েও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নানাবিধ মতবিরোধ থাকলেও, একটি বিষয়ে তারা সবাই একমত,
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত বাংলাদেশ নির্মানে অন্তরায়।
বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের অবকাঠামো ও কর্মপদ্ধতি উন্নয়নের অন্তরায়। সুতরাং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে হরতাল এবং রাজনৈতিক অসন্তোষ ও মানবিক দাবি দাওয়া উত্থাপনের জন্য কোনো সমাবেশ এবং সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করতে হবে।
হরতাল বিহীন ২ বছর পার করবার পরে বাংলাদেশের মানুষ সহসাই হরতাল চাইছে না। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার সময় এই বিষয়টা বিবেচনায় রাখলে ভালো হয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধ্বসের তেমন স্পষ্ট প্রভাব পড়ে নি এখনও।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানী দ্রব্য তৈরি পোশাক, এবং এই খাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বরং অনুমিত সীমার বেশী হয়েছে। তবে যেভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য দেশগুলোতে, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে একটা সময়ে। সম্ভবত এই বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশে রেমিটেন্স কমে যাবে। রেমিটেন্স অনেকাংশেই আমাদের বিশ্ব শ্রমবাজারে সস্তা শ্রমিক রপ্তানী করা থেকে প্রাপ্ত আয়। বাংলাদেশে থেকে শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেখানের উপার্জিত অর্থের একটা অংশ বাংলাদেশে পাঠায়, সেখান থেকেই আমাদের রেমিটেন্স বৃদ্ধি পায়।
তবে শ্রমিক রপ্তানী কমে যাবে বলে আমাদের এই আয় বৃদ্ধির সম্ভবনা কম। আমাদের দেশ থেকে অদক্ষ কায়িক শ্রমদাতা জনগোষ্ঠী রপ্তানী হয়, বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও শিক্ষিত শ্রমিক রপ্তানী হয় না এবং কায়িক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে উন্নত বিশ্বে কমে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী নির্মান শিল্পে স্থবিরতা এসেছে, বড় বড় দেশগুলো বর্তমানে নগরায়নের বদলে নিজেদের ধ্বসে পড়া ব্যাংকগুলোকে অর্থ দিয়ে টিকিয়ে রাখবার প্রচেষ্টা নিয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক নগরায়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতো তাদের কর্মক্ষেত্র সীমিত হয়েছে, এবং শ্রমিক রপ্তানীর হার বাড়বার বদলে কমে যেতে পারে।
তবে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ তৈরি পোশাক থেকে প্রাপ্ত রপ্তানী আয় কমে না যাওয়ার অনেকগুলো কারণের একটা হলো এখানে শ্রমশোষণ এবং শ্রমিক নিগৃহের ঘটনা ঘটে বেশী।
ঠিক যেদিন আনিসুল হক বলেছেন আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন ঠিক সে দিনই পত্রিকায় খবর এসেছে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ীর কোনো এক গার্মেন্টসের মহিলা শ্রমিকদের যদি দুপুরে খাওয়ার জন্য বাইরে যেতে হলে তাদের স্যান্ডেল জমা রেখে যেতে হয়। যারা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের বক্তব্য এটা করা উচিত, কারণ যারা বাইরে খেতে যায়, তারা অনেকেই ফিরে আসে না। তাদের ফিরে আসা নিশ্চিত করবার জন্যই এই প্রথা উদ্ভাবন করেছে ম্যানেজমেন্ট। তবে দাস এবং শ্রমিকের ভেতরের ব্যবধান বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলো ম্যনেজমেন্ট। গার্মেন্টস মালিক জানিয়েছে তারা এমন কোনো নিয়ম বেধে দেন নি, বরং এটা বোধ হয় শ্রমিকের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
বর্বরতা কতটুকু বাঞ্ছনীয়? আমাদের উন্নয়ন শীল দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলা প্রয়োজন। আমাদের মাথা পিছু বাৎসরিক আয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তবে রপ্তানী আয় ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি করে সামগ্রীক ভাবে মাথাপিছু বাৎসরিক আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব না। এর জন্য শ্রমিকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। লভ্যাংশ শ্রমিকদের প্রদানের ব্যবস্থা করবার আইন পাশ করবার প্রয়োজনীয়তা আছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে হয়তো বৈশ্বিক মন্দার প্রতিক্রিয়া সরাসরি অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।
আমাদের আভ্যন্তরীণ শ্রমিক নিগ্রহের প্রতিক্রিয়ায় হয়তো দেশে তাৎক্ষণিক একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহন করা সম্ভব কিন্তু বিদেশে ঠিক এ কাজ করা সম্ভব না।
বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে উন্নত বিশ্বে জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পেয়েছে, সাম্প্রদায়িকতা এবং ভিনদেশী শ্রমিকদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অভাব এভাবেই বোধ হয় উন্নত বিশ্বের মানবিকতার প্রাচীর ধ্বসিয়ে দিচ্ছে। ভিন্ন জাতীয়তার শ্রমিকদের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভিনদেশী শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিক যারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মরত, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেই দেশের বাংলাদেশী দুতাবাস তেমন পদক্ষেপ গ্রহন করে নি।
বাংলাদেশের দুতাবাসগুলো সব সময়ই উচ্চমন্য কিছু কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত, যারা শ্রমিকদের ঠিক নিজেদের সমগোত্রীয় ভাবে না। বরং এইসব তথাকথিত গেজেটেড অফিসারদের আচরণে অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উদ্ভুত শ্রেণীঘৃণার প্রকট প্রকাশ থাকে।
বাংলাদেশ সরকার নিজদের শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহন করে নি, এটা বাস্তবতা। এই দেশের ভেতরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে মালিকদের আচরণ আধুনিক দাসত্বের কুৎসিত অনুভুতি এনে দেয়। একই সাথে বাংলাদেশের সরকারের নিযুক্ত দুতাবাস কর্মীদের ব্যবহারের উচ্চমন্যতা ভিন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিগৃহ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবার বাস্তবতা প্রকাশ করে না।
বরং তাদের উদাসীনতাই নিয়মিত সংবাদ শিরোমাণ হয়। এমনিতেই রেমিটেন্সের উপরে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব পড়বে, সেটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিবে যদি বাংলাদেশের দুতাবাসগুলো বর্তমানের মতো উচ্চমন্য কর্মকর্তাদের দ্রারা পরিচালিত হয়। এর ফলে নিজের নিরাপত্তাহীনতায় বিদেশে কর্মরত শ্রমিকেরা কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে আসবে এবং দেশের বেকারত্ব বাড়াবে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।