স্পার্টাকাসের নাম কার না জানা। এই মহান মানুষটি ছিলেন একজন ক্রীতদাস। কিন্তু বিদ্রোহী হয়ে তিঁনি স্বতন্ত্রভাবে আত্নপ্রকাশ করেন। তখন তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল একটি ক্রীতদাস বাহিনী। স্পার্টাকাসের সেনাবাহিনী রোম সামাজ্র্যে আঘাত হানে এবং কিছুকালের জন্য হলেও সিজারের সিংহাসনকে টলিয়ে দিয়েছিল।
পরবর্তীতে এই স্পার্টাকাস ব্যক্তিউর্দ্ধ তাৎপর্য এবং একটি আইডিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। নিপীড়ত মানুষের সংগ্রামী চৈতন্য হিসেবে তিনি কালতিক্রমী মহিমায় ভাস্বর। একুশের চেতনাও সেদিক থেকে সংগ্রামী বাঙ্গালি জাতি চৈতন্যের ভাস্বর, একটি মূল্যবোধ, জীবনাদর্শ; যা আমাদেরকে প্রতিবাদী করে তোলে এবং সর্বপ্রকার নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে স্বকীয় সত্তা- স্বরুপে প্রতিষ্ঠিত ও বিকাশিত হওয়ার আহবান জানায়।
ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী হাতিয়ার ।
মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র, বহু ভাষা-ভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করে না; এটা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখে। তাই একুশে ফেব্র“য়ারি এখন আর শুধু আমাদের মাতৃভাষা দিবস নয়। এ ভাষাটি এখন বিশ্ব ভ্রমন করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে এবং প্রতি বছর ‘একুশে ফেব্রয়ারি’ সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এছাড়া কানাডার অন্টারিও প্রদেশের প্রাদেশিক আইন পরিষদে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
বৈশ্বিক প্রক্ষাপটে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ভাষাকে অবহেলা করছি। ফলে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের মধ্যে যেসব নেতিবাচক দিক রয়েছে সেগুলো থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে।
তাই আমাদেরকে শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে এবং ‘করপোরেট কালচারের’ আগ্রাসন থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। এখনো আমরা হন্য হয়ে ইংরেজির দিকে ছুটছি, অথচ বাংলা ভাষার ঐশ্বযর্, মাধুর্য অনুধাবন করতে পারছি না। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এটা মানি। এটা অবশ্যই অতি প্রযোজনীয় এটাও বিশ্বাস করি। কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করে এটাকে গ্রহণ করা উচিত হবে না।
অবশ্য বাংলাকে ইউনিভার্সেল নেটওয়ারিং ল্যাঙ্গুয়েজ (ইউএনএল) এ পরিণত করার কাজ শুরু করেছে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ। বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষার সৃষ্টি সম্ভারকে ইন্টারনেট বিশ্বের সব ভাষার মাুনষের কাছে পাঠযোগ্য করার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা সফল হলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ তাদের নিজ নিজ ভাষায় বাংলা ভাষার সৃষ্টিসম্ভার যেমন পাঠ করতে পারবে তেমনি অন্যান্য ভাষার সৃষ্টিসম্ভারও বাংলা ভাষায় পাঠ করা সম্ভব হবে।
এদেশে যারা লেখালেখি করেন তাদের আর্থিক অবস্থা এত সমৃদ্ধ নয় যে তারা বিশ্ব সফর করে নিজেকে পরিচিত করাতে পারবেন কিংবা সে রকম কীর্তি হয়তো কারো নেই। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা এখানে বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে।
এ বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুধাবন করা প্রয়োজন। বাংলা সাহিত্য বৈশ্বিক দরবারে পৌঁছার ক্ষেত্রে আরোও একটি অন্তরায় হচ্ছে এটা সেভাবে অনুবাদ না হওয়া। তাই বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজি, ফারসি, জার্মান, স্পেনীয় কিংবা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ ভাষার পাঠকদের কাছে পরিচিত করিয়ে তুলতে একটি স্বতন্ত্র অনুবাদ ব্যুরো প্রতিষ্টা করা দরকার।
বর্তমানে ওয়েবভিত্তিক লেখালেখি চলছে। এখানে যারা লিখছেন তাদের সংখ্যা অনেক বেশি।
যদিও এখন এটার সুচনাকাল তবুও নতুন সাহিত্য সৃষ্টি বা বাংলা লেখালেখির ট্রেন্ড হিসেবে এধরণের ওয়েব বা ব্লগ একটি শক্তিশালী মিডিয়াতে পরিণত হয়েছে। এটা সাহিত্য চর্চার একটি আন্দোলনও বটে। তবে এটার সম্পাদন বা মান নিয়ে সজাগ থাকতে হবে। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে লিটল-ম্যাগাজিনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে নতুন লেখক তৈরি প্লাটফর্ম সুদৃঢ় হবে।
বিশ্বের ৬০৬০টি ভাষাকে টিকিয়ে রাখা, পান্ডুলিপি সংরক্ষণ ও ভাষার উন্নয়নের জন্য ঢাকার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে আরো কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে। যাতে প্রতিষ্ঠানটি তার ধারণাপত্র অনুযায়ী যথাযথ কাজ করতে পারে। একটি বিষয় ভাবা উচিত যে, শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, একুশে ফেব্র“য়ারির প্রভাতফেরি করে কিংবা দেশের বাইরে শহীদ মিনার স্থাপন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সম্ভারের উন্মোচন বা প্রবেশ ঘটবে না। অবশ্যই আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে তাদের ভাষায় বাংলা ভাষার সম্ভারকে উপস্থাপন করতে হবে।
দুই.
আমাদের জাতিসত্তার স্বরুপ আবিস্কারে একুশের অবদান অসমান্য। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতির মাঝে চেতনার উন্মেষ হয় । আর তখন থেকেই বাঙ্গালি উপলব্দি করেছিল তারাই বাঙ্গালি জাতীয়তাবোধ, ও তাদের সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী। এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন এই দু’ধারাকে একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তিসংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। এর ফলে আমরা বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তরে আন্দোলন করেছি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। বুকের তাজা রক্ত পিচঢালা পথে ঢেলে দিয়ে ভাষা পেয়েছি। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। প্রবল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের জন্যই এদেশের সূর্যসন্তানেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্রমাগত আঘাত পেয়েছে আমাদের একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম।
। আঘাতে আঘাতে বেশ কাতর হয়ে পড়েছে। তাইতো পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, রাহাজানি, হরতাল, দূর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লাগামহীন ছাত্রসংগঠন ইত্যাদির খবর। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই সমস্যা। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে।
কিন্তু এতকিছুর পরও দেশেপ্রেম, একুশের চেতনা নিহত হয়নি। তারও অনেক বড় বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে আমাদের তরুণসমাজ। এই মার খাওয়া দেশপ্রেমের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও নানাক্ষেত্রে তরুণদের উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। পাটের জিনোম আবিস্কারে সাফল্য দেখিয়েছেন তরুণ বিজ্ঞানীরা। মাইক্রোসফট, গুগুল, ইয়াহুতে কর্মরত তরুণ বিজ্ঞানীরা।
মেহেদীর তৈরি অভ্র সফ্টওয়্যারটি বাংলা লেখালেখির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বকোষ, উইকিপিডিয়ায়, বিশেষ করে বাংলা উইকিপিডিয়ায় তরুণদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। গত বছরের ২৩ মে মুসা ইব্রাহীমের এভারেষ্ট জয় তারুণ্যের অমিত প্রাণশক্তি ও আত্নবিশ্বাসের অভিব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তিন শিক্ষার্র্থীর সমন্বয়ে গড়া বাংলাদেশ দলটি ইউরিয়া সারের অপচয় রোধ ও জমিতে সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা উপস্থাপন করে পুরস্কার জিতে নেয়। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ২০০৫ সাল থেকে অংশগ্রহণ করে বেশ সফলতা নিয়ে আসছে এদেশের তরুণরা।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের মতো করে তরুণদের জন্য আয়োজিত মডেল নেশনসে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের তরুণরা। বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম কিডনি তৈরি করেছেন বাংলাদেশের ডা. শুভ রায়। সাইট ইউটিউবের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত জাওয়েদ করিম। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বাংলাদেশি তরুণ বিজ্ঞানী ই-ডায়াল কলিং সার্ভিস উদ্ভাবন করায় কোন কোড নম্বর ছাড়াই বিশ্বের যেকোন দেশে আজ সরাসরি ফোন করা যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমে তরুণরা নানা ধরণের সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।
এসব অত্যাধুনিক মিডিয়া ব্যবহার করে তরুণরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গণসাক্ষর সংগ্রহ, ইভ-টিজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা, শীতার্ত মানুষের জন্য বস্ত্রাদি সংগ্রহ করছে। নানাভাবে তরুণরা আজ বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্বল করছে। অতএব দেখাই যাচ্ছে তরুণসমাজ আজও স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ ও লালন করছে। এরাই দূর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার , ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা বা ২০২১ সালে নাগাদ মাধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে একুশের চেতনায় উজ্জীবিত এই তরুণসমাজের সম্ভাবনা ও ভূমিকা কাজে লাগানো।
এম জিয়াউল হক সরকার
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail: ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।