আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বস্তির কুত্তাদের ফিল্মিক কোটিপতির অধরা সেলুলয়েড

যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
স্লামডগ মিলোনিয়ারের প্রধান তিনটা চরিত্র, জামাল, লতিকা ও সেলিম আর্টফিল্ম, শর্টফিল্ম বা বিকল্প ধারার ফিল্মে যে সত্য-চিত্র উঠে আসার দাবী করে উহাদের নির্মাতা, বোদ্ধা এবং দর্শকেরা, একটা সুখকাঠির স্পর্শে নন্দনায়িত হয়ে থাকে তাদের তৃপ্তির মুকুর, বিভিন্ন নাট্যমঞ্চ ভাড়া করে প্রজেক্টারে দেখিয়ে গুটিকতেক খুসকিযুক্ত পাবলিকের সাধুবাদে ধন্য হয় - স্লামডগ তার চেয়ে এককোটি গুন বেশী বিকল্প, অনুচ্চারিত, নিঠুর বাস্তবতার সজোরে বদ্ধ চিত্র দেখিয়েছে। ফিল্মদর্শকদের বেশীরভাগই কমার্শিয়াল বা এন্টারটেইনমেন্ট মুভির ভোক্তা। এবং সেই ড্যানড্রফহীন চুল ও ক্লোজআপ দাত সম্মৃদ্ধ জনগোষ্ঠী স্লামডগ এমন গিলেছে, এখন হয়তো তারা আরো এমন ছবি দেখতে চাইবে। অনুচ্চারিত, অপ্রকাশিত চিত্র, ঘটনার বয়ান নিয়ে এমন এন্টারটেইনমেন্ট মুভি হলে ফিল্মদর্শকদের গুছিয়ে নেয়া যায় বাণিজ্যের করতলে ভালোভাবেই। তবে একটু সুড়সুড়ি মার্কা সুফল হলো মুম্বাই এর ঐ বস্তীবাসীদের জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে ব্রিটেনের "হু ওয়ান টু বি মিলোনিয়ার" অনুষ্ঠানের প্রযোজকরা।

একটা কোটিপতি গোষ্ঠি ছদ্মাবরণে সেখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করবে। নতুন এই রিয়েলিটি শো বস্তির উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে, সবচেয়ে বড় কথা বস্তির কথাগুলো বাইরে আসার সুযোগ পাবে এবং বাকী বিশ্ব বেশ আগ্রহ সহকারেই তা দেখবে। আমার কথা হলো যেভাবেই হোক এই বস্তির ঘটনাগুলো আলোচিত, প্রকাশিত ও আন্দোলিত হওয়া দরকার। টাট্টিখানায় জামাল অমিতাভের হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনিতেছে কোটিপতি কুত্তার বাচ্চা নামের ছবিটাতে যে বস্তী দেখানো হয়েছে তার সাথে বাংলাদেশের কোন বস্তীর কোন পার্থক্য নাই। বোম্বে ও ঢাকার জীবনযাত্রার মধ্যে প্রচুর মিল খুঁজে পাই, একমাত্র দাঙ্গা বিষয়টি ছাড়া।

এখানে রাষ্ট্রীয় অথবা ব্যক্তিগত ষড়যন্ত্রে বস্তিগুলোতে আগুণ লাগানো হয়, উচ্ছেদ করা হয় আর বোম্বেতে একটু রাখঢাক করে। তবে বোম্বের বিমানবন্দরের পাশের ঐ বস্তী যেখানে সেলিম, জামাল আর লতিকা বড় হয়েছে তার স্থাপনা অনেক ব্যাপক ও স্থায়ী। বস্তীটাকেই উপস্থাপন করা হয়েছে অবিকল, গা ঘিনঘিনে ময়লাময় জলাশয় থেকে মিনারেলের বোতল, রিইউজেবল পেপার, কাপড় তোলা, উন্মুক্ত পায়খানা, আবর্জনা ও মল সমৃদ্ধ পানির ব্যবহার, অমিতাভকে দেখতে উন্মুক্ত পায়খানার দরজা খুলতে না পেরে নিচের মলভর্তি গর্তে নেমে মলে পেইন্টেড শরীর নিয়ে অটোগ্রাফ সংগ্রহ এসবের মাঝে বেড়িয়ে এসেছে সত্যিকারের চিত্র। বস্তির এই বিশাল ক্যানভাসে, শৈল্পিক উপস্থাপনের যে মুন্সীয়ানা তার কারণে কোটিপতি কুত্তার বাচ্চা এক অসামান্য দলিল-চিত্র। জামাল হটসিটে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর জেনেছে বস্তির ব্যতিক্রমী, নানামূখী, বর্ণময় ঘটনার মাধ্যমে।

তার পরিচিত হয়ে উঠতে হয়েছে রক্তের, সমাজের, অর্থনীতি আর ট্যাবুর সাথে ভিন্নভাবে, আশ্চর্য্যজনকভাবে যে জ্ঞানের সীমারেখা টানা সম্ভব নয় তেমন এক উন্মুক্ত, বন্য ও বিস্তৃত অঞ্চলে। তথাকথিত আইন, রাষ্ট্র আর নীতিবাগিশ, দয়ালু, সেবক মানুষেরা যেখানে অগম্য, ড্রইংরুমে পরিচিত কেবল কুত্তার বাচ্চা হিসাবে সেই জীবনেই জামালের জানা হয়ে যায় কোটিপতি হবার অনুষ্ঠানের প্রচন্ড গোছানো প্রশ্নগুলোর উত্তরও। ১৮ বছরের জামাল শৈশবের বস্তীতে স্কাইস্ক্রাপার হতে দেখেছে আমার আর কিছু লেখার নেই। কিন্তু অনেক কিছু লেখার আছে। এত চমৎকার ছবি দেখে মনে হয়েছে এই ইন্টারনেট-প্রজন্ম জীবনের অতি নগন্য জ্ঞানই আহরণ করতে পারে কেবল।

বস্তির একটা শিশু অব্যবস্থা, রোগজীবানুর ডিপোর মধ্যে বাস করে যেভাবে নিজের সার্ভিলেন্স শেখে, তার ধারে কাছেও আমরা নেই। আমরা ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে গেছি, পরীক্ষা হলের সামনে বাবা-মা বসে থেকেছেন খাবার নিয়ে, আর বিলাসী কাইকুই করে কার্টুন দেখে পৌরনিক পড়ে জেনে গেছি পৃথিবীর তাল তাল প্রজ্ঞা - বস্তির ঐ শিশুরা এক ঝলকানিতে উড়িয়ে দিতে পারবে এসব নিশ্চিত। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হলো আমাদের সংগ্রামমুখর জীবনের মুলমন্ত্রগুলো লুকিয়ে আছে এমন সব বস্তিতে। কিন্তু এসব নিয়ে ছবি বানাবে সেই উন্নত বিশ্বরাই, এগুলোকে বিক্রি করে বাগাবে কোটি কোটি টাকার মুনাফা, অস্কার। যে ক'জন বস্তির কুত্তা ছবিটাতে অভিনয় করেছে তাদের কেউ কেউ হয়তো বস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে অচিরেই কিন্তু লাখো লাখো জামাল, সেলিম, লতিকাদের এমন ছবি দেখে উল্লাস প্রকাশ করেই সন্তুষ্ঠ থাকতে হবে।

যুগের পরে যুগ ধরে তাদের জীবন ফিল্মিক কোটিপতির অধরা সেলুলয়েড।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.