আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৯৭২ সাল; বারিয়াঁ ক্যম্প, মারী

উন্নত দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা

শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ মুজিবকে তার অজানা জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হোল, সম্ভবত ৮ই জানুয়ারীতে। তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না তাকে মেরে ফেলা হবে বা হয়েছে, এ নিয়ে গুজব তো চলছিলই; উৎকন্ঠার সময় ছিল নিশ্চয়ই পাকিস্তানে অবস্থান করা বাঙ্গালীদের সহ সকল বাংলাদেশীদের। ভুট্টো তখন ক্ষমতায়, জানা যায়, তিনি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেবার সময় তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু লন্ডনে গিয়ে পরিস্থিতি সন্মন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ার পর যেই সাংবাদিক সম্মেলন করেন, তাতে ভুট্টোর আশা ধুলিস্যাত হয়ে যায়। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যোগাযোগ বন্ধ, একেবারেই বন্ধ।

বন্ধ হবেই না কেন, পরাজিত শত্রু পক্ষ দেড় হাজার মাইল দূরে, যেই শত্রুর চেহারা দেখলে, নাম উচ্চারন হলে মনে হয় এখনই যেভাবে হোক নিধন করি। সমস্যা সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগনের না, সমস্যাটা বাংলাদেশে ফেরত যেতে ইচ্ছুক ও উদ্গ্রীব রয়ে যাওয়া বাংলাদেশীরা। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের পর কোন চিঠি পত্র আর আদান - প্রদান হচ্ছে না। আমাদের না হয় একটা উপায় ছিল, লন্ডনে আত্মীয় থাকাতে তার ঠিকানায় বাংলাদেশে প্ররিতব্য চিঠি গুলো পাঠাতাম। আর উনি বিনা পয়সায় ওভার টাইম করে স্বযত্নে ভিন্ন কামে ভর্তি করে ঐ চিঠি গুলো বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজনদের নিকট পাঠাতেন।

বিপরীত দিকে স্বাভাবিকভাবেই একই পদ্ধতি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে চিঠি লন্ডন হয়ে আসতে লেগে যেত বিশ দিন। অনেক বাঙ্গালী ব্যচেলর এবং কিছু কিছু পরিবার সাহস করে ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আফগানিস্থান হয়ে ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশে যাওয়া শুরু করলে; পালিয়ে যাওয়া। কবে দেশে যেতে পারব, এর কেন নিশ্চয়তা না থাকাতে এই পন্থা অনেকেই নিতে আরম্ভ করলেন। আমরা ও চিন্তা করেছিলাম হয় তো কিন্তু আমার আম্মা নিশ্চয়ই এই প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছিলেন।

কারন আমরা ছিলাম চার বোন এক ভাই (আমি)। আম্মা সম্ভবত অচেনা পথে মেয়েদের নিয়ে এভাবে যাবার রিস্ক নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তদুপরি পাকিস্তান থেকে আফগানিস্থান অতিক্রম করনের সময় রাতে বিশ থেকে তিরিশ মাইল হেটে সীমানা পাড়ি দিতে হবে। তাও সবাইকে ঐ সময়ে মিলিশিয়া কাপড় পরিধান করে থাকতে হবে। ঐ সময়ে ধরা পড়লে সরাসরি জেলে, অার জেল থেকে বের হওয়ার উপায় তখন একটু কঠিনই মনে হচ্ছিল সবার কাছে।

কানা ঘুষা চলছিল কবে আমাদেরকে ক্যম্পে নেয়া হবে। কারন ব্যচেলর অফিসারদের সীমান্ত বর্তী দূর্গ বা কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই। তাদেরকে অন্তরীন রাখা হয়েছিল, অপরাধ একটা ই নিজের দেশে ফেরত যাবার পক্ষে সই করেছে। আমাদের বাসায় থাকতেন কর্ণেল সুলতান, আর্মি মেডিকেল কোর এর, ১৯৭২ সালে পেশোয়ারের কোন এক দূর্গে (নাম মনে আসছে না) ছেড়ে আসলাম, তখন বুঝে নিলাম আমাদের সময় ও চলে এসছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরিবার সহ আমরা যারা সামরিক এলাকায় ছিলাম তাদেরকে মারীর কাছে বারিয়াঁ বলে এক জায়গায় নিয়ে আসা হোল।

আমাদের জিনিষপত্র আগেই বিক্রি করা হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই অনেক সস্তায়। মনে পরে কিছু ট্রাংক ও চারপাই সংগে আনা হয়ছিল। আর্মি ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। পাহাড়ের ঢালুতে আমাদের দুই বেড রুম ওয়ালা পুরোনো বৃটিশ শাসনামলের বাসায় ছেড়ে দেয়া হোল। এমনই নির্জন ও পুরোনো দোতলা ফ্ল্যট বাড়িতে আনা হোল, যে একটু ঘুরে দেখা গেল ঐ ফ্ল্যট বাড়ির অনেক কিছুই ব্যবহারের অযোগ্য।

সবচেয়ে প্রকট সমস্যা বাথরুম ব্যবহারের অব্স্থা নেই, দূর্গম নির্জন এইসব এলাকায় চেয়ারের পটি ব্যবহার করা হয়, (সুইপার এসে ঐ পটি পরে সাফ করে দেয়ার কথা)। সেই চেয়ারের পটিই নেই। বোঝা গেল 'একটিভ সার্ভিস' থেকে বের করার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা দূঃর্ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এই ঢালু পাহাড়ী এলাকা জঙ্গল বলতে পাইন গাছ দিয়ে আবৃত। বাথরুম সমস্যা দু তিন দিনের মধ্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সমাধান করে যায়।

বারিয়ান থেকে রাওয়ালপিন্ডি যেতে দেড় থেকে দু ঘন্টা লাগতো। রাওয়ালপিন্ডিতে তখনও প্রচুর বাঙ্গালী ছিল বিধায় এবং এই ক্যম্পে অন্তরীন করার কোন উপায় ছিল না বিধায় সকলে ক্যম্পে এসেও একট খুশীই ছিলেন বেধ করি। নানাহ সামরিক বাহিনীর পরিবারের সংগে এক অন্য রকম একাত্বতা বোধে সবাই মিলিত হতে থাকলেন। সব মিলে গোটা তিরিশেক এর ওপর পরিবার বারিয়াঁ তে একত্রিত হয়েছিল। বারিয়াঁ মারী থেকেও আরও ১০০০(এক হাজার) ফুট উচুঁতে অবস্থিত।

ছবিঃ শীতকালীন বারিয়াঁ বাজারের; ইন্টারনেট থেকে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.