নতুন পৃথিবীতে সবাইকে স্বাগমতম!
৪ অক্টোবর ১৯৯৬, নাইরোবি, কেনিয়া। কেসিএ কেন্টেনারি টুর্নামেন্টের ৬ষ্ঠ ম্যাচে শ্রী লংকার বিপক্ষে পাকিস্তানের প্রথম উইকেট পতনের পর অপ্রত্যাশিভাবে মাঠে এলেন ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ব্যাট করতে নামা শহিদ আফ্রিদী, যিনি বোলার হিসেবে মূলত টিমে সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সবাইকে ভীষণভাবে হতবাক করে দিয়ে ৬ টি চার ও ১১ টি ছয়ের সাহায্যে মাত্র ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে দ্রুততম সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড গড়লেন তিনি। অন্যদের কথা বাদই দেয়া হলো, সয়ং আফ্রিদীও জানতেন না যে, এমন কীর্তি গড়তে যাচ্ছেন তিনি।
হুবহু না হলেও প্রায় এমন ঘটনাই ঘটেছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত মুভি স্লামডগ মিলিয়নেয়ার-এর বেলায়।
অন্য দর্শকদের কথা বাদই দেয়া হলো, মুভির ডিরেক্টর ড্যানি বয়েল, কো-ডিরেক্টর লাভলীন ট্যান্ডন, ও কলাকুশলীরাও ভাবেননি যে, মুভিটি এমন অসাধারণ সাফল্য পাবে! ইউএসএ-ইউকে-র প্রডাকশনের ১২০ মিনিট দৈর্ঘের ইংরেজি এই মুভিটি প্রথম দেখানো হয় ২০০৮ এর ৩০ আগস্ট ইউএসএ-র টেলুরাইড ফিল্ম ফেস্টিভাল-এ। এরপর টরোন্টো, অস্টিন, শিকাগো, লন্ডন, এএফআই ফিল্ম ফেস্টিভালে অংশ নেবার পর ইউএসএ-তে আংশিক এবং কানাডায় পুরোপুরি রিলিজ পায় গত ১২ নভেম্বর। এরপর ইটালি (৫ ডিসেম্বর) ও অস্ট্রেলিয়ার (১১ ডিসেম্বর) পরে ইউকে-তে রিলিজ পায় এ বছর ৯ জানুয়ারি। আর ইনডিয়াতে রিলিজ পেয়েছে গত ২৩ জানুয়ারি স্লামডগ ক্রোড়পতি নামে হিন্দী ভাষায়। কিন্তু অল্প এই সময়ের মধ্যেই অনেকটা ডার্ক হর্সের মতোই যা করার করে ফেলেছে মুভিটি।
১১ ডিসেম্বর ২০০৮-এ ঘোষিত গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশনে অত্যন্ত সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ ৪টি ক্যাটেগরিতে নমিনেশন পেলে পুরোপুরি লাইম লাইটে চলে আসে মুভিটি এবং ১২ জানুয়ারি ৪টি নমিনেশনের সবগুলিই (বেস্ট পিকচার-ড্রামা, বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট স্ক্রিনপ্লে ও বেস্ট অরিজিনাল স্কোর) গোল্ডেন গ্লোব জিতে নেয় মুভিটি। এরপর ২২ জানুয়ারি ঘোষিত অস্কার নমিনেশনে ৯ টি ক্যাটেগরিতে (বেস্ট পিকচার, বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট রাইটিং-অ্যাডপ্টেড স্ক্রিনপ্লে, বেস্ট মিউজিক স্কোর, বেস্ট মিউজিক সং, বেস্ট সিনেম্যাটোগ্রাফি, বেস্ট সাউন্ড এডিটিং, বেস্ট সাউন্ড মিক্সিং এবং বেস্ট ফিল্ম এডিটিং) ১০ টি নমিনেশন পেয়ে অস্কার জেতাকে সময়ের ব্যপার মাত্র বানিয়েছে মুভিটি। একই সাথে বাড়তে থাকা আইএমডিবি রেটিংয়ে মুভিটি টপ ২৫০ মুভি লিস্টের ৩৪ নাম্বারে অবস্থান করছে এখন। এরই মধ্যে একটি ইতিহাসও ঘটে গিয়েছে। তা হলো, এই উপমহাদেশ, বিশেষ করে পুরো ইনডিয়াকে আনন্দে ভাসিয়ে প্রথম ইনডিয়ান হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড জেতেন মুভিটির মিউজিক ডিরেক্টর মিউজিক মিউজিশিয়ান এ আর রহমান এবং অস্কার অ্যাওয়ার্ড হাতে নেয়া যার জন্য এখন সামান্য অপেক্ষার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে; কারণ, বেস্ট মিউজিক (স্কোর)-ক্যাটেগরির পাশাপাশি ও বেস্ট মিউজিক (সং)-ক্যাটেগরিতে জয় হো এবং ও সয়া-গান দু’টির অস্কার নমিনেশন পেয়েছে।
এত হৈ চৈ যে মুভিটি নিয়ে, তার কাহিনী কিংবা স্ক্রিপ্টের দিকে এবার একটু চোখ বোলানো যাক। বিকাশ স্বরূপের উপন্যাস কিউ অ্যান্ড এ (অর্থাৎ কোয়েশ্চেন অ্যান্ড আন্সার) অবলম্বনে স্ক্রিনপ্লে লিখেছেন সাইমন বুফয়। মুম্বাইয়ের বস্তিতে বড় হওয়া একজন টিনেজ বয় জামাল মালিক বর্তমানে একটি কল সেন্টার চা-ওয়ালা হিসেবে কাজ করে। সে হু ওয়ান্টস টু বি এ মিলিয়নেয়ার বা কন বানেগা ক্রোড়পতি নামের একটি জনপ্রিয় কুইজ প্রোগামে অংশ নিতে এসেছে। অথচ তার উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন নয়! একই সাথে উচ্চ-শিক্ষা এবং সাধারণ জ্ঞান না থাকা সত্তেও সে উপস্থাপক প্রেম কুমারের কঠিন প্রশ্নগুলির উত্তরগুলি সঠিকই দিয়ে যাচ্ছে (এর মধ্যে অডিয়েন্স ও ফিফটি-ফিফটি অপশন তাকে ব্যবহার করতে হয়েছে)! কিন্তু কীভাবে সে সঠিক উত্তর গুলিকে বাছাই করছে? ক. সে কি চিট করেছে?, খ. সে কি ভাগ্যবান? গ. সে কি জিনিয়াস? ঘ. নাকি এটি ভাগ্যের লিখন? ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি রূপি জেতার থেকে সে যখন একটি প্রশ্ন দূরে, তখন প্রথম শো’র সময় শেষ হয়ে যায়; পরের দিন বাকি অংশ টুকু অনুষ্ঠিত হবে।
এমন সময় চিটিং বা প্রতারণা করার সন্দেহে তাকে অ্যারেস্ট করিয়ে পুলিশ স্টেশনে টর্চারসহ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর সেময়ই জামাল মালিকের জবানীতে বের হয়ে আসে তার জীবনের অতীতে ঘটে যাওয়া স্বতন্ত্র ঘটনাবলী, যেগুলির মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে কুইজের প্রশ্নগুলির উত্তর। অন্যদিকে, কুইজে সে একমাত্র এই কারণেই অংশ নিতে এসেছে যাতে তার হারিয়ে যেতে বসা ভালোবাসার মানুষ লতিকা তাকে টিভিতে দেখতে পারে, কারণ লতিকা এই প্রোগ্রামটির একজন নিয়মিত দর্শক; কিন্তু লতিকা তখন একজন গডফাদারের কাছে বন্দী। তার ওপর, কুইজের শেষ প্রশ্নটি তার অতীতের সাথে মিলে যাওয়া সত্তেও এর সঠিক উত্তরটি তার সত্যিই অজানা। এখন প্রশ্ন হলো, জামাল মালিক কি খুঁজে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া একমাত্র প্রেমিকাকে? শেষ প্রশ্নের উত্তর ভুল দিয়ে সে কি হারিয়ে ফেলবে তখন পর্যন্ত আয় করা ১ কোটি রূপি? সবচেয়ে বড় কথা, লতিকা কি সত্যিই দেখছে কুইজ প্রোগ্রামের ওই পর্বটি? আসলে মুভিটি এতটাই হার্ট-টাচিং যে, এর প্রশ্নগুলি উত্তর এখনই দিয়ে দিলে মুভিটি দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
ইনডিয়া কেন্দ্রিক প্লট এবং সাইমন বুফয়ের স্মার্ট, এনার্জেটিক, সাসপেন্সফুল স্ক্রিপ্টের যথার্থ বহি:প্রকাশ এ আর রহমানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া কখনোই পূর্ণতা পেতো না। মুভির সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া ট্রাক জয় হো গোল্ডেন গ্লোব বিজয়ের পরে অস্কার নমিনেশনও পেয়েছে; অথচ গানটি তৈরি হয়েছিলো মূলত মুভি ইউভরাজ-এর জন্য। রিংগা রিংগা টাইটেলের গানটি তৈরি হয়েছে মুভি খলনায়ক-এর চলি কে পিছে কেয়া হে-র রিদমের ওপর। ও সয়া ট্রাকটি ফ্লাশব্যাকের জন্য ট্রিগার হিসেবে দারুণ কাজ করেছে; আফ্রিকান সাউন্ডে হেভি অর্কেস্ট্রায় এ আর রহমানের স্পিরিচুয়াল ও ডিভাইন ভোকাল ও এর রেঞ্জ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে এখানে; সাথে যোগ হয়েছে তামিল বংশদ্ভূত বৃটিশ সংরাইটার, সিংগার ও র্যাপার মাথাঙ্গি মায়া আরুলপ্রাগাসাম (যার স্টেজ নাম মিয়া) এর সিজলিং কন্ঠ; অস্কারে গানটি অ্যাওয়ার্ড জিতলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইন্সট্রুমেন্টালগুলি মধ্যে লতিকা’স ড্রিম, মিলিয়নেয়ার, লিকুইড ডান্স ও রায়টস্ রীতিমত মাস্টারপিস ওয়ার্ক।
মজার বিষয়, জামাল মালিকের বড় ভাই সেলিমের মোবাইল সেটে যে রিং টোন বাজে, সেটিও এ আর রহমানেরই করা; সেই রিং টোন টি মুভি স্বদেশ-এর থিম মিউজিকের অংশ।
অ্যান্থনি ডড ম্যান্টলের সিনেম্যাটোগ্রাফির মান নি:সন্দেহে সুপ্রিম কোয়ালিটির। ১৫ তম অ্যানুয়াল স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ডস-এ বেস্ট কাস্ট ইন এ মোশন পিকচার ক্যাটাগরিতে বিজয় অবশ্যই বলে দিচ্ছে মুভির অসাধারণ কাস্টিংয়ের কথা। জামাল মালিক ও লতিকা চরিত্রে দুই ডেবুট্যান্ট যথাক্রমে দেব প্যাটেল ও ফ্রিদা পিন্টো যেন মেড ফর ইচ আদার ছিলো। এছাড়া প্রেম কুমার চরিত্রের অনিল কাপুরের প্রশংসা সয়ং করেছেন রিয়েল কন বানেগা ক্রোড়পতি-র সেকেন্ড হোস্ট শাহরুখ খান; এর সাথে যোগ হয়েছে পুলিশ ইন্সপেক্টর চরিত্রে ইরফান খানের ইউনিক অভিনয়।
তবে সবাইকে যেন ছাড়িয়ে গেছে ছোট বেলার জামাল, সেলিম ও লতিকা চরিত্রে অভিনয় করা যথাক্রমে আইয়ুশ মহেষ খেদেকার, আজহারুদ্দিন মোহাম্মাদ ইসমাইল ও রুবিনা আলি, যাদের পারিশ্রমিক তাদের হাতে দেয়া হবে তাদের বয়স ১৬ বছর পূর্তির পরে।
মুভির সাফল্যের অন্যতম কারণ. এতে কোন বোরিংনেস নেই। কিছু ফ্যাকচুয়াল এবং কনটিনিউটি এরর থাকলেও সবমিলিয়ে এটি যে কোন ক্যাটেগরিতে যে কোন অ্যাওয়ার্ড পাবার মতোই একটি মুভি। মুভির নামের মধ্যে ডগ বা কুকুর কথাটি রয়েছে বলে ইনডিয়ার অনেকেই এর নামকরণে আপত্তি করেছে; মুভির নাম স্লামবয় মিলিয়নেয়ার হলে হয়তো এরূপ সমালোচনার মুখে এটিকে পড়তে হতো না। নি:সন্দেহে এটি একটি মাস্ট সি মুভি এবং একবার নয়, এক নি:শ্বাসে বারবার দেখার মতো মুভি।
আর সবচেয়ে বড় কথা, মুভিটি যে এমন বক্স-অফিস হিট হবে, হয়তো এটিই ছিলো এর ডেসটিনি বা ভাগ্যের লিখন!
[পুনশ্চ: লেখাটি ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে যায়যায়দিন-এ প্রকাশিত। ]
(Click This Link)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।