জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব
না, আমি এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি কখনো! আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম! আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না! শুধুই দাড়িয়ে শুনছিলাম! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে! এইতো মানুষের জীবন! এইতো জীবনের অর্থ!
গত পরশুদিন সারারাত্র আমি এবং আমার বন্ধু সুমন দাড়িয়েছিলাম ভারতীয় দূতাবাসের সামনে। আমার মা এবং বোন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভারত যাবে। তাদের ভিসার জন্য রাত্র ১২টা থেকে সুদীর্ঘ লাইনে দাড়িয়েছিলাম আমরা। প্রচন্ড ঠান্ডা! শীত আর কুয়াশাতে আমাদের জবুথবু অবস্থা!
রাত্র ১টা বাজে। রাস্তার পাশেই একটি চায়ের দোকান রয়েছে।
আমি আর সুমন গেলাম চা খেতে।
ছোট্ট একটা দোকান। ভেতরে একজন পুরুষ বসা আছেন। পাশে দাড়িয়ে আছেন একজন মহিলা। চা খাওয়ার সময় আমার পাশে একটি ভাঙা ভিটা দেখতে পেলাম।
আমি মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে এখানে তাদের বাসা ছিল কিনা। তিনি বললেন যে, হ্যা, এটি তাদের বাসা। কিন্তু সরকার ভেঙে দিয়েছে।
জিজ্ঞাসা করলাম এবার ক্ষমতায় কাদের আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এবার উনি একটি চেয়ারে বসলেন।
বললেন, খালেদা-হাসিনা যেই আসুক, আমাদের কিছু আসে আসে-যায় না।
পরক্ষণেই বললেন, মহাজোট যেন ক্ষমতায় আসে সে জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাই।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনার স্বামী কি করেন?'
উনি চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমার স্বামী ইপিআর ছিল। এখন তোমরা যেটাকে বিডিআর বল, বাংলাদেশ হওয়ার আগে ওটাই ইপিআর ছিল।
তিনি নিস্পৃহ কন্ঠে বললেন, আমার স্বামীকে পাক-বাহিনী মেরে ফেলে।
আমি এইটুকু জীবনে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্পের বই পড়েছি, কিছু সিনেমা দেখেছি, বিভিন্ন বই-পত্রপত্রিকাতে পড়েছি পাকিস্তানীদের এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংসতার কথা। কিন্তু কখনো এভাবে একজন নারীর মুখোমুখি হইনি যিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন যুদ্ধের সময়। যার কারনে আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। শুনতে চাইলাম পুরো ঘটনা।
তিনি বলতে লাগলেন............
আমার স্বামী তখন মুক্তিবাহিনীর সাথে একত্রে যুদ্ধ করছিল। তখন দেশ স্বাধীন হতে আরো সাতদিন বাকি ছিল। যুদ্ধের ফাঁকে একদিন বাসায় এল। হঠাৎ বাসায় রাজাকার এসে উপস্থিত। ধরে নিয়ে গেল আমার স্বামীকে।
পাক-হানাদার বাহিনী আমার স্বামীকে বলল মুক্তিবাহিনীর খবর দিতে। কিন্তু আমার স্বামী কোন কিছুতেই দিলনা। হানাদাররা তখন তাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু বলে দিল, আজকের মধ্যে খবর দিতে। আমি স্বামীকে বললাম, তুমি মুক্তিদের খবর দাও; নইলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলতে পারে।
তাছাড়া আমার কোলে তখন দেড় মাসের প্রথম সন্তান। খুব ভয় করছিল আমার। তবে আমার স্বামী বলল তিনি মুক্তিদের খবর দিতে পারবেননা। তিনি বেঈমানি করতে পারবেন না। সন্ধ্যার দিকে আমার স্বামী পালানোর আগেই রাজাকাররা এসে আবার তাকে ধরে নিয়ে যায়।
তারপর তাকে কী জিজ্ঞাসা করে, আমি তা জানিনা। কিন্তু তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমার স্বামী নিজে মারা গেছে, কিন্তু দেশের সাথে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বেঈমানি করেনি। আমার স্বামী সবসময় বলত, আমরা বাঙালি, আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করবই। এসব কথা বলতে বলতে মহিলা কেঁদে ফেললেন।
আমারও তখন কান্না পাচ্ছিল। সুমনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল টপটপ করে। কিন্তু আমাদের জন্য বিস্ময় আরো অপেক্ষা করছিল। আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাচ্চা এখন কি করে, তখন তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, তোমরাই আমার বাচ্চা! আমার দেড় মাস বয়েসী দুধের বাচ্চাটিকে রাজাকাররা নিয়ে যায়।
তারপর আমার স্বামীর লাশের সাথেই তার লাশটা পাই আমি!
আমি কোনদিন ভাবতেই পারিনি এধরনের অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটতে পারে! হ্যা, আমি শুনেছি, পড়েছি যে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু তাই বলে একটি দেড়মাস বয়েসি শিশু? এই শিশুটির কি অপরাধ? তাকেও মেরে ফেলতে হবে?
আমার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। কী বলব আমি! তাঁকে কী বলে সান্ত্বনা দেব! আমি নিজেই তো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তিনি আরো বললেন, তারা পাক-হানাদারদের চেয়ে রাজাকারদের বেশি ভয় পেতেন। কারন, কার ঘরে কিশোরী মেয়ে আছে, কোন বাসায় মুক্তিবাহিনীর লোক আছে, এসব খবর রাজাকাররাই সবসময় পাক-হানাদারদের দিত।
আমি একটি প্রশ্ন করে আরো গাধা হয়ে গেলাম। আমি বললাম, আপনি আর বিয়ে করেননি? তিনি সগৌরবে বললেন, না বাবা, আমি আর বিয়ে করিনি। আমার কোন বাচ্চা নেই। আমি এই জগতে একা!(পাশের দোকানিকে দেখিয়ে বললেন) আমার একটি ভাই আছে খালি! তোমরা সবাই আমার সন্তান!
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! থমকে গেল আমার মনটা! কী বললেন তিনি! আমরা সবাই তার সন্তান! তারাই তো আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন! কিন্তু এধরনের মা'দের জন্য আমরা কী করতে পেরেছি!
আমার মাথায় তখন একটি প্রশ্নই বারবার খোচা দিচ্ছিল; উনি কি ধর্ষিতও হয়েছিলেন?
কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি। শত হলেও মা তো!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।