আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাচনে কারচুপির সম্ভাব্য পরিকল্পনা এবং তা প্রতিরোধের উপায়

আহসান মোহাম্মদ

গত দুই বছরের ঘটনাবলীর কিছুটাও যাদের স্মৃতিতে রয়েছে, তাদের এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে একটি পাতানো নির্বাচনে পরিণত করার কোন চেষ্টাই নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাশীনেরা বাকী রাখবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম নির্বাচন কমিশন একটি রাজনৈতিক দলকে ভাঙ্গার কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এ জন্য সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাশীনদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন। সে কারণে সংলাপের সময় চার দলের দেয়া এবং সরকারের মেনে নেয়া সাত দফার সবগুলোই উপক্ষো একতরফাভাবে ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। খালেদা জিয়া তখন সাত দফাকে চার দফায় নিয়ে আসেন এবং বিএনপির সাথে নির্বাচনের তারিখ পেছানো নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয় ১৯ নভেম্বর দুপুরে।

তখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সশরীরে হাজির হন নেপথ্য ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তিটি এবং তার নগ্ন হস্তক্ষেপে সবকিছু বানচাল হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ ডিসেম্বর তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানেরে একতরফা ঘোষণা দেয়া হয়। ২১ নভেম্বর বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এই ঘটনা সবিস্তারে প্রকাশিত হয়। ক্ষমতাশীনদের আশা ছিল বিএনপিসহ চারদলীয় জোট এই ঘটনার পরে আর নির্বাচনে যাবে না। তবে শেষ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার সময়োচিত প্রেস ব্রিফিং ও পদক্ষেপের কারণে সে প্রচেষ্টা সফল হয় নি।

এই বিষয়টিকে উল্লেখ করা হলো এই কারণে যে, মাত্র কয়েকদিন আগে যে ব্যক্তি একতরফা নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে এতো নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করলেন, তিনি কোন এক জাদুমন্ত্রবলে সকল প্লান পরিকল্পনা ত্যাগ করে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবহীন নির্বাচন করতে দিবেন - এ আশা করাটা বোকামী। জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের পরদিনই সেনাবাহিনী মোতায়েনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির আশঙ্কাকে আরো জোরালো করে তুলেছে। এখন দেখা যাক নির্বাচনে কারচুপির সম্ভাব্য পরিকল্পনাগুলো কি হতে পারে: ১. ক্ষমতাশীনেরা পছন্দ করে না - এমন জোটের সমর্থকেরা যেন ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হয় সে ব্যবস্থা করা হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, কেন্দ্র ভিত্তিক রাজনৈতিক সমর্থন বিবেচনা করে একটি বিশেষ দলকে জিতিয়ে আনার জন্য নির্বাচন কমিশন সীমানা পুন: নির্ধারণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাতে একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার খবরও সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে।

ক্ষমতাশীনদের নিকট কেন্দ্রভিত্তিক রাজনৈতিক সমর্থনের বিস্তারিত এবং হালনাগাদ তথ্য রয়েছে। নির্বাচনের আগে বাছাইকরা এলাকায় ভয়-ভীতি ছড়ানো হতে পারে। বিএনপির মাঠপর্যায়ের অসংখ্য নেতা-কর্মী মাথায় হুলিয়া নিয়ে অথবা কারাগারে নির্যাতনের স্মৃতি নিয়ে কেবল বাড়ী ফেরা শুরু করেছেন। ১৭ তারিখে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার এবং ১৮ তারিখে আবার সেনাবাহিনী মাঠে নামানোর ফলে জরুরী অবস্থার রেশ কাটবে না এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ভীতি কাটবে না। আবারো গ্রেফতারের ভয়, ধড় পাকড়ের গুজব ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের অনেককে এলাকা ছাড়া করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এর ফলে তারা তাদের সমর্থকদেরকে ভোট কেন্দ্রে নিতে পারবেন না। এভাবে অনেক কেন্দ্রে চারদলীয় প্রার্থীর এজেন্ট নাও থাকতে পারে। ২. বাছাই করা কেন্দ্রগুলোর (যেখানে ক্ষমতাশীনদের অপছন্দের জোট প্রার্থীদের ভোট বেশী) আশে পাশে পূর্ব পরিকল্পিত কিছু গোলোযোগ সৃষ্টি, তারপর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অ্যকশন এবং ব্যাপক ধর-পাকড়ের গুজবের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোকে জনশূণ্য করে তারপর ব্যাপক জাল ভোটের ব্যবস্থা করা হতে পারে। জরুরী অবস্থার ভীতি যেহেতু কাটছে না, তাই এই কাজটি অনেকটা নীরবে করে ফেলা সম্ভবপর হবে। ৩. তাছাড়া নির্বাচনের ফলাফল কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে বদলানোর একটি প্রচেষ্টা হতে পারে।

এ উদ্দেশ্যে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে করে রেখেছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তার কিছু মহড়াও হয়েছে। মেয়র পদে একজন প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর একটি রাজনৈতিক দলের চাপে ফলাফল পাল্টে ফেলা হয়। পরে জানানো হয় যে, একটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার নাকি ফলাফল নিয়ে বাড়ী চলে গিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন, সরকার বা সংবাদ মাধ্যম আমাদেরকে অবশ্য জানায়নি যে আর কতজন প্রিজাইডিং অফিসার এ ধরণের কাজ করেছেন।

প্রতিরোধের উপায়: ১. ভোট কেন্দ্রে গোলোযোগ বাধাতে একটু সময় লাগে এবং জাল ভোট দেয়া হয় ভোটারের উপস্থিতি যখন কম থাকে, তখন। তাই কারচুপি রোধ করার সবথেকে কার্যকর উপায় হচ্ছে, ভোটগ্রহণ শুরুর সাথে সাথে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নিজের ভোটটি দিয়ে আসা। সাধারণ ভোটার এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। ২. রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোকে নির্বাচনের অন্তত: এক সপ্তাহ আগে থেকে নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তা ওয়েব সাইটের মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে।

নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক মনিটরিং সেলও তৈরী করতে হবে। এলাকাভিত্তিক মনিটরিং সেল কেন্দ্রের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে। কোন এলাকায় যদি কোনভাবে ভয়ভীতি ছড়ানো হয় তা সাথে সাথে এই সেলে রিপোর্ট করতে হবে এবং ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে হবে। নির্বাচনের দিন মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার ফলে ভোট গ্রহণকালীন অনিয়ম মনিটরিং সেলে জানানোর বিকল্প ব্যবস্থা তৈরী রাখতে হবে। ওয়ারলেস ফোন যদি নিষেধাজ্ঞার আওতায় না পড়ে তাহলে সেগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে, অথবা কেন্দ্রের নিকটস্থ কোন ল্যান্ড ফোন ব্যবহারের জন্য আগে থেকে কথা বলে রাখতে হবে।

কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলে যোগাযোগের জন্য সাইবার ক্যাফে বা অন্য কোন ইন্টারনেট সংযোগ তৈরী রাখতে হবে। ৩. প্রতি কেন্দ্রে কয়েকজন বিকল্প পোলিং এজেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন কোন নির্বাচনী এজেন্টকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোট কেন্দ্র থেকে দূরে রাখা হলেও কোন কেন্দ্র এজেন্টবিহীন না থাকে। ৪. কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল যেন রিটার্নিং অফিসারের নিকট এসে পরিবর্তিত না হতে পারে সে জন্য আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করতে হবে। প্রিজাইডিং অফিসারের গণনাকৃত ফলাফলের বিবরণীর কপি নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক মনিটরিং সেলে সাথে সাথে পাঠিয়ে দিতে হবে। এই ফলাফল রিটানিং অফিসারের নিকট পাঠানো ফলাফলের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে।

ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়ার নলি নকসা বানচাল করে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে দেশপ্রেমিক শক্তিকে আগে থেকেই কারচুপি প্রতিরোধে সকল প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.