পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি
কাজরী... এর কওমী মাদ্রাসার অন্দরে
ব্লগার নিশ্চয়ই একটি কোয়ালিটেটিভ রিসার্চের ইচ্ছা নিয়ে ব্লগাতে বসেন নাই , তবু আমার সন্দেহ হয় , তাঁর যদি এই রিসার্চের কায়দা কানুন সম্পর্কে জানা থাকত , আরেকটু গোছানো তথ্য পেতাম হয়ত আমরা । টুকরো টুকরো হলেও কাজরী... একটা ভীষন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন । তাঁকে অভিনন্দন ।
বলছিলাম ব্লগার কাজরী... এর কওমী মাদ্রাসার অন্দরে সিরিজটির কথা । সাদা চোখে যেটাকে খুব সাদা মাটা "অবজার্ভেশন" বলেই মনে হয় ।
তবে , গল্পের মত করে বলা টুকরো টুকরো বাক্যের একটু গভীরে তাকালে আমরা একটা অচেনা জগতের সন্ধান পাই । এই জগতটা আমাদের অপরিচিত । হয়ত আমাদের অনেকের বোন, প্রেমিকা, আত্মীয়ার অপরিচিত । কিন্তু তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার উপায় নাই । এরা আমার দেশেরই মানুষ ।
কিন্তু ঠিক মানুষ নয় , মানবেতর হিসেবে তারা স্রেফ জীবন যাপন করে । কিংবা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে বলা যায় ।
অনেকেই অনেক ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করেন , বাংলাদেশে জামাতের মত স্বাধীনতা বিরোধী দল কি করে মাত্র ৩৭ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি , রাজনীতি এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সারের মত বাস তৈরী করতে পারে ?
উত্তরটা ভয়াবহ । জামাত, রাজাকার, আল বদর কিংবা আল শামসের লোকেরা , শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্যরা একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা বিরোধী হয়েও এতটা শক্তি অর্জন করতে পারে কারন তাদের বিরুদ্ধে আমরা নমনীয় থাকি । যখন আওয়ামী লীগ কিংবা বি এন পি জামাতকে সাথী , বন্ধু , ভাই বানিয়ে বাংলাদেশকে চুষে খায় তখন আমরা ক্ষমাশীল হই ।
আমরা ৭১ এর পরে যেই গ্রাম আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলো , মুক্তিযুদ্ধের রসদ যুগিয়েছিলো , স্বাধীনতা তাদের সুন্দর জীবন দেবে ভেবেছিলো - সেই গ্রামকে আমরা ভুলে থাকি । আমাদের মনযোগের কেন্দ্রস্থল হয়ে থাকে ঢাকা , চট্টলার মত কুলীন শহর । ক্ষমতাভোগীদের এই ন্যাক্কার জনক আচরনের প্রতিবাদ , প্রতিরোধ করার বদলে আমরা উলটো তাদের সাথে হাত মিলিয়ে ঢাকায় পড়ি, ঢাকায় চাকুরী খুঁজি , ঢাকায় বাড়ি বানাই অথবা আর কিছু না পারি ঢাকার কাছে নদী কিনে রাখি একটা "ঢাকাইয়া উন্নত ভবিষ্যতের" আশায় ।
এরই ফলশ্রুতিতে গ্রাম আমাদের অবহেলা, অমনযোগ এর ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো হয়ে ওঠে । গ্রামের দরিদ্র , অসহায় , পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কেবল পিছিয়েই পড়ে ।
তারা শহুরে চাকচিক্য আলা প্রতিষ্ঠান গুলোর দরজা থেকে ছিটকে পড়তে থাকে কেবল দূরে , আরো দূরে । কিন্তু , মানুষ বসে তো আর থাকে না । সুতরাং , সাধ্যের ভিতরে মানুষ যা পায় , তাকেই গ্রহন করে নেয়।
আমরা গ্রামীন জনপদের চাহিদাকে বরাবর উপেক্ষা করে এসেছি বলেই আজকে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে হাজার কওমী মাদ্রাসা ব্যাঙের ছাতার মত বিস্তার লাভ করে এখন শহরকেও গ্রাস করতে চলেছে । এটা আমাদের অবহেলার ফল ।
মোমবাতির নিচের অন্ধকার এর মতই আমরা আমার নিজের দেশের ভিতর একটা বিরাট জনগোষ্ঠীতে কি ঘটে চলেছে , কেন ঘটছে , এর ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে একেবারেই উদাস ।
পছন্দ করি আর না করি , এই মানুষ গুলো , যারা কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহন করে , একটা সময় মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ আর "লাইফ স্কিল" , " উপার্জনের জন্য পেশাগত শিক্ষা"র দিক থেকে পঙ্গু হয়ে বের , এরা আমার দেশের , আমার সমাজেরই অংশ হয়ে থাকে । উটপাখির মত আমরা বালিতে চোখ গুঁজে থাকি আর হাজার হাজার নারী ও পুরুষকে একটা মধ্যযুগীয় বিভীষিকাময় শৈশব , কৈশোরের ভিতর দিয়ে যেতে দেই । খেয়াল করুন , একেবারে শিশু অবস্থা থেকেই এরা একটা ভিন্ন জগতের আসামী হয়ে যায় । স্বাভাবিক পারিবারিক, সামাজিক , সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা ব্রেইন ওয়াশড এক একটা অদ্ভুত প্রানী হিসেবে বাইরের জগতে পা রেখেই কি দেখে ?
দেখে - তাদের এত বছরের শিক্ষা ও জীবনযাপনের তরিকার কোন স্বীকৃতি নেই ।
এদের জন্য ভালো কোন পেশা নেই । চাকুরির সুযোগ নেই । অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান বলে ব্যবসা বানিজ্যের পুঁজি তো নেইই , শিক্ষাও নেই । কারন তাদের ঝুলিতে যোগ্যতা বলতে পরকালের জ্ঞান , অফুরন্ত নেকি আর সোয়াব আর সাথে চাঁদা বাজি কিংবা ভিক্ষার "ট্রেনিং" । আর সব না হয় বাদ দিলাম , পেটের ক্ষুধা তো সব মানুষই টের পায় আর সেই ক্ষুধা মিটাতে সব কিছু করতেই প্রস্তুত থাকে ।
দোষ দেবেন কি করে যখন এরাই জামাতের হাতিয়ার হয়ে ওঠে ?
আমরা তাদের যা দেইনাই , জামাত তাদেরকে সেই সব দেবে বলে দলে টেনে নেয় । জামাত তাদের কর্মীদের ইহকালে চাকুরী , ব্যবসা , ঋণ এর ব্যবস্থা করে আর পরকালে বেহেস্তের চাবি পাবে বলে ভাওতা বাজি করে ।
কিন্তু , জামাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই কাজটি করে , তা হলো , আমাদের " নির্লিপ্ততা আর অবহেলায় প্রায় অগোচরে " চলে যাওয়া একটা জনগোষ্ঠীকে তারা তাদের গোচরে আনে । আমরা যেই গ্রামকে ভুলে থাকি , সেই গ্রামকে তারা ধীরে খুব ধীরে গ্রাস করে নেয় । ফুলকুড়ির মতন শিশু সংগঠন কিংবা মাদ্রাসার মত জায়গা গুলো তারা দখল করে নেয় ।
আমরা শিশুদের পাত্তা দেই না ।
আমরা গ্রামের গরীব গুর্বোদের পাত্তা দেই না ।
আমরা গ্রামীন মেয়ে শিশু, কিশোরী, নারীদের পাত্তা দেই না ।
আমরা তেল চুপচুপে , বোটকা গন্ধ আলা ক্ষ্যাত লোকগুলাকে ভুলে থাকি ।
আর তারপর , একদিন ভোরে উঠে দেখি আমাদের ভুলে যাওয়া লোকগুলো না জেনে , না বুঝে চলে গেছে শত্রুর পক্ষে ।
এবং আমাদের আত্ম অহংকারের মুখে চুন কালি মেখে দিয়ে এবার তারা আমাদের বাধ্য করে তাদের পাত্তা দিতে । তাদের সংখ্যা গত ৩৭ বছরে এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা সাহস করে আমাদের সংসদে যাওয়ার, আমাদের বিজয় দিবসে মিছিল করার , আমাদের পয়লা বৈশাখে বোমা ফেলে মানুষ মারার ।
হ্যাঁ , এইবার আমরা চোখ ঠিক খুলি না , খুলতে বাধ্য হই ।
কাজরীকে অভিনন্দন এই রকম ভুলে যাওয়া " বাংলাদেশকে " আমাদের চোখের সামনে এনে উপস্থিত করার জন্য ।
যখন একই দেশে আমেরিকান স্কুল , আগা খান কিংবা ক্যাডেট কলেজ, ভিকারুন্নিসা , শাহীন , হলিক্রস , নটারডেম আর কওমী মাদ্রাসা থাকে ; যখন একই দেশে বাংলা , ইংলিশ আর মাদ্রাসার উর্দু, আরবী মিডিয়াম তিনটা ভিন্ন প্রজাতি তৈরী হতে দেওয়া হয় ; যখন একই দেশে কেউ ইউরোপ , আম্রিকায় সামার কাটায় আর কেউ বাপ, মা খাওয়াতে পারে না বলে মাদ্রাসায় , এতিম খানায় চলে আসতে বাধ্য হয় --- তখন সেই দেশ ফ্যানাটিকের জন্ম দেয় ।
দেবেই ।
এই নগ্ন বৈষম্যকে আমরা তৈরী হতে দেই । ভুলে যাই , দেশের শরীরে কোথাও পচন দেখা দিলে সেটার নিরাময় করা আমারও দায়িত্ব । আর না হলে , সেটা একদিন আমাকেও শেষ করে দেবে ।
স্বার্থপরতা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার মাদক আমাদের বাংলাদেশকে আজ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে ।
কওমী মাদ্রাসার পুত্র কন্যারাও যে আমাদের সন্তান , তা আমরা ভুলে থাকি বলেই এই সন্তানেরাই একদিন বোমা হাতে চিৎকার করে বলতে আসে ,
দড়ি ধরে মারো টান , বাংলা হবে আফগান ।
আমরা কি কাজরী... লেখায় উঠে আসা আমাদেরই ভাই , বোনদের , বাংলাদেশের শিশুদের ভুলে থাকবো ?
আর আমাদের রক্তে কেনা পতাকা গিলে খাবে ৭১ এর শকুন ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।