কতো কিছুই না হতে চেয়েছি এই জীবনে। কতো কিছুই না চেয়েছি পেতে।
একেবারে ছোটকালে, যখন ক্লাস সেভেন এইট এ পড়ি, তখন সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা পড়তাম। তিন গোয়েন্দার দল - কিশোর, রবিন, আর মুসা - রোমাঞ্চকর সব রহস্য সমাধান করে বেড়াতো। আমার কিশোর মন কী যে শিহরিত হতো ওদের এডভেঞ্চার এর কাহিনী পড়ে।
কল্পনায় ভিড়ে যেতাম ওদের দলে আর সমাধান করে বেড়াতাম চাঞ্চল্যকর সব রহস্যের! ওদের সাথে আমিও ঘুরে বেড়াতাম লস এঞ্জেলেসের রকী বীচ এলাকায়। কিশোরদের বাসার পাশের গারাজের হেডকোয়াটার্সে ওদের সাথে আমিও যে রহস্য সমাধানে আমার মাথা খাটাতাম এটা ওরা কোনদিন জানতে পারবে না! সে এক অদ্ভুত যাদুকরী রোমাঞ্চকর জীবন। দুষ্ট মানুষদের সকল চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে তিন গোয়েন্দার দল আর আমি মিলে সমাধান করে দিতাম জটিল সব রহস্যের…
আরেকটু বড় হবার পর, নাকের নিচে যখন গোঁফের হালকা কালো রেখা দেখা দিতে শুরু করলো, তিন গোয়েন্দার বই এর জায়গা ধীরে ধীরে দখল করা শুরু করলো মাসুদ রানার বই। সে এক অন্য জগত। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এর এক দুর্ধষ স্পাই, মাসুদ রানা ক্রমেই হয়ে উঠলো আমার স্বপ্নের নায়ক।
গোপন মিশন নিয়ে দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়ায় রানা। কোমলে কঠোরে মেশানো, অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত চির সবুজ এক যুবক মাসুদ রানা। প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় থেকে শুরু করে প্রায় দুইশ’র মতো বই পড়ে ফেলেছি বছর দুয়েকের মধ্যেই। আমাদের বাসার কাছেই ছিল একটা বইয়ের দোকান যেখানে সেবা প্রকাশনীর বই ভাড়া পাওয়া যেত। প্রতি বই দুই টাকা করে।
পড়ে দুই-তিন দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হতো। রানা’র বুদ্ধি, শক্তি, স্মার্টনেস, আর সুন্দরী রমণীদের সাথে রোমান্টিকতা, সবকিছু মিলে ওকে মনে হতো স্বপ্নের দেশে থাকা এক পুরুষ। কতো অসংখ্যবার প্রতিজ্ঞা করেছি বড় হলে স্পাই হবো, ঘুরে বেড়াবো দেশ থেকে দেশে, সমাধান করে বেড়াবো জটিল সব রহস্যের, সান্নিধ্যে আসবো রুপবতী সব নারীদের, কোমরের হোলস্টারে লুকানো থাকবে পিস্তল…
এসএসসি পাশের পর ভর্তি হই নটর ডেম কলেজে। ততোদিনে আমার চিন্তাভাবনা আর আগ্রহের পরিধি আরো বেড়ে গেছে। অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদির প্রতি অনেক আগ্রহ বোধ করতাম।
বিশেষ করে বিজ্ঞানের প্রতি। অণু-পরমাণু কিভাবে কাজ করে, পৃথিবীর সৃষ্টি হলো কিভাবে, প্রাণ এর সৃষ্টি হলো কিভাবে, প্লেইন কিভাবে আকাশে উড়ে, কম্পিউটার কিভাবে কাজ করে - এরকম রাজ্যের প্রশ্ন আমার মাথায় খেলা করতো তখন। নটর ডেম এ পরিচয় হয় আমার বন্ধু তানভীর এর সাথে। বিজ্ঞান এর বিভিন্ন ব্যাপারে ওর ছিলো অনেক জ্ঞ্যান। ওর সাথে কতো যে তর্ক বিতর্ক করেছি বিজ্ঞ্যানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে! তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতর ফুলার রোডে ছিলো ব্রিটিশ কাউন্সিল এর লাইব্রেরী।
ওখানে সদস্য হলে বিভিন্ন ধরণের বই আনতে পারা যায়, এটা শোনার পর দেরী না করে সদস্য হয়ে যাই। এরপর কতো যে বই এনেছি ওখান থেকে! যে বইটি বিশেষভাবে আমার এখনো মনে আছে সেটার নাম হলো “প্ল্যানেট আর্থ”, লেখকের নাম সিজার এমিলিয়ানি। এই বইটি আমার জীবনকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিলো। বইটির বিষয়বস্তু ছিলো অনেক ব্যাপক - বিশ্বজগতের সৃষ্টি, প্রাণের সৃষ্টি, পৃথিবীর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত চার বিলিয়নেরও বেশি সময়ের ভূতাত্বিক ইতিহাস, ইত্যাদি। এইসব বইপত্র পড়ে পড়ে আর সেগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি বড় হলে বিজ্ঞানী হওয়ার কথা ভাবতাম।
পদার্থবিজ্ঞান আমাকে খুব টানতো। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর বিচিত্র জগৎ, কসমোলজির অবিশ্বাস্য ঘটনাপ্রবাহ, রিলেটিভিটি’র “আপেক্ষিক সত্য” - এসবকিছুর কারণে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম বড় হলে একজন পদার্থবিজ্ঞানীই হবো।
আইডিয়ালে (আমার হাই স্কুল) থাকতেই আমার আরেকটা স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো ধীরে ধীরে। সেই স্বপ্নের নাম হলো “আমেরিকা”! সেই ছোটবেলা থেকে মনে হয় এমন কোন দিন যেতো না যেদিন কোন না কোন ব্যাপারে আমেরিকা’র নামটা শুনিনি। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন সংবাদ, টেলিভিশন সিনেমা, ভিসিআর এর সিনেমা, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, এফবিআই-সিআইএ, ম্যাডোনা, মাইকেল জ্যাকসন, হলিউড, টারমিনেটর টু, বেসিক ইন্সটিঙ্কট, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যতো আবিষ্কার, হার্ভার্ড-এমআইটি, নাসা, সারা পৃথিবী জুড়ে যতো যুদ্ধ-বিগ্রহ - সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এই আমেরিকা।
আমেরিকা ক্রমেই ঢুকে যাচ্ছিলো আমার উৎসুক মনের গভীরে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম প্রচন্ডভাবে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই ছুটলাম মতিঝিলের ইউসিস অফিসে। সেখান থেকে আমেরকার যতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা নিয়ে ভর্তির জন্য এপ্লাই করলাম। ভর্তির অফারও পেলাম কয়েকটি থেকে।
ভিসা’র জন্য দাঁড়ালাম ঢাকার বনানীর সবচেয়ে বড় লাল দালানটিতে - স্বপ্নের দেশের এম্ব্যাসিতে। তখন ভিসা নিয়ে ছিলো ভয়াবহ রকমের কড়াকড়ি। যথারীতি ভিসা পাইনি। তিনবার দাঁড়ানোর পর রণে ভঙ দিলাম। কিন্তু আমেরিকা যাবার স্বপ্ন তাতে এতোটকু কমেনি!
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার শুরু হলো এক নতুন জীবন।
সেখানে ছিলেন আমার স্বপ্নের মানুষ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমার জীবন যে কয়জন মানুষ দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে তাদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে আছে জাফর স্যারের নাম। মাঝে মাঝে যখন খুব বেশি মন খারাপ থাকে, নিরাশ হয়ে থাকি, জীবনের কোন মানে খুঁজে পাই না, তখন একটা কথা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিই - জাফর স্যারের মতো মানুষেরা যখন বেঁচে আছে তখন বেঁচে থাকার নিশ্চয়ই কিছু একটা অর্থ আছে!
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসিএম প্রোগ্রামিং করতাম। কম্পিউটার দিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা। খুবই আনন্দদায়ক একটা ব্যাপার ছিলো এই প্রবলেম সলভিং।
প্রোগ্রামিং করতে করতে স্বপ্ন দেখতাম একদিন খুব বড় প্রোগ্রামার হবো, খুব বড় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীতে পৃথিবী বদলে দেওয়া যায় এমন সব কম্পিউটিং প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করবো। কখনো বা হ্যাকার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। জটিল সব ভাইরাস লিখে বড় বড় কম্পিউটার এর নিরাপত্তা ভেঙ্গে সেখানের সব তথ্য বের করে ফেলবো আর সবাই আমার প্রোগ্রামিং দক্ষতার প্রশংসা করবে!
আরো একটা স্বপ্ন ছিলো বিশেষ করে কলেজ জীবন থেকে - দেশের জন্য কিছু একটা করা। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, হরতাল-অবরোধ, হত্যা-প্রতিহত্যার রাজনীতি, ঘুষ, অনিয়ম, ট্রাফিক জ্যাম, পানি-বিদ্যুতের অভাব - আরো কতো কী! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালগুলোতে পড়ালেখা ছাড়া আর যা যা করা যায় তার সবকিছুই চলে অবিরাম। খুব ইচ্ছে হয় দেশের জন্য কিছু একটা করতে।
আমি আর আমার বন্ধু রাজু কমলাপুর রেল স্টেশনের কাছে রেল লাইনের উপর বসে বসে কতো বিকেল পার করেছি দেশের জন্য স্বপ্ন দেখে দেখে! কতো প্ল্যান করেছি কিভাবে দেশের জন্য কিছু করা যায়। একটা খুব ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বানাবো যার উপাচার্য হবেন জাফর স্যার। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা বের হবে তারা একেকজন হবে একেকটা বারুদের মতো। অসম্ভব সেই প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা কেউ হবে বিজ্ঞানী, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেই ডাক্তার, কেউ আর্কিটেক্ট, কেউ দেশের প্রতি পরম মমতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, কেউ ভবিষ্যৎ নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, কেউ বিখাত গণিতবিদ… ভাবতাম বড় হয়ে রাজনীতি করবো। একদিন এই দেশের সরকার প্রধান হবো আর বদলে দিবো দেশটাকে…
স্বপ্ন আর পরিকল্পনার এখনো শেষ নেই।
কতো নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি, কতো কিছু করতে চাই, কতো কিছু পেতে চাই এই জীবনে। এক জীবনে মানুষ কতো বছর বাঁচে? সত্তর, আশি, নব্বই, কিংবা বড়জোর একশ বছর? এই সময়ের মধ্যে কি সব কিছু পাওয়া যায়? প্রজাপতির মতো আমাদের মন খালি উড়ে বেড়ায়। কতো স্বপ্ন পূরণ হয়, কতো চাওয়া পূরণ হয়, তবু কি স্বপ্নগুলো থেমে থাকে? আমাদের চাহিদা কি কখনো কমে আসে?
সবকিছুর শেষে এই স্বপ্নগুলোই, চাওয়াগুলিই আমাদের জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রজাপতি মন-ই আমাদের জীবনের সম্পুর্নতার দিকে টেনে নিতে থাকে। জীবন চলতে থাকে…
(also posted at http://bilash.wordpress.com/ )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।