আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন জননীর অকাল প্রয়াণ (উৎসর্গ বন্ধুবর ব্লগার সীমান্ত আহমেদ)

আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে

৫ সালের গোড়ার দিকে ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় । ৭ বছর আগেই যে পরিচয় হতে পারতো ,হয়ে ওঠেনি, কেন হয়নি তাকেও কোনদিন বলা হয়ে উঠেনি । ৯৭ এ যখন আমি আইডিয়াল স্কুল প্রাঙ্গনে প্রথম পা রেখেছি , তার আগের বছরই এ প্রাঙ্গন ছেড়ে সে চলে গেছে মির্জাপুর ক্যাডেটের চৌহদ্দিতে । ০২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় আমার একটা রঙিন ছবি ছাপা হয়েছিল । ঠিক একই দিন ভেতরের পাতায় মির্জাপুরের ৭/৮ জন ক্যাডেটের এক সারি পাসপোর্ট সাইজের সাদা কালো ছবি ছেপেছিল পত্রিকাটি , সে ছবি আমি পরে দেখেছি ।

ভার্সিটিতে এসে শান্ত, সৌম্য , ভদ্র চেহারার লম্বা করে ছেলেটির দেখা পেলাম , আমি সিএসই তে , সে ইলেকট্রিক্যাল এ । আমরা ভীষণ ফুটবল পাগল ছিলাম , সুযোগ পেলেই ০২ ব্যাচের সিএসই দের হৈচৈ এ ভার্সিটির মাঠটা জীবনের আভাস পেত । অন্য ডিপার্টমেন্টগুলোকেও মাঠে আনার চেষ্টা করতাম আমরা । সিভিলদের কিছুতেই পাওয়া যেত না , মেকানিক্যালরা হাতে গোনা । যা কয়েকটা পাওয়া যেত ইলেকট্রিক্যালদেরই ।

লম্বামতন ছেলেটা তাদের মাঝেই একজন । প্রথম যেদিন সে আমাদের সাথে খেলেছিল , আমি ৫/৬ বার তাকে ডজ দিয়েছিলাম , সেটা তার মনে আছে কিনা জানি না । ০৫ সালের রশীদ হলে যখন একটা ঠিকানা হল , তখন তাকে পেলাম পড়শি হিসেবে । দু'তিন মাস ঘুরতেই রুম বদলে পুরোদস্তুর রুমমেট হয়ে গেলাম তার । সে আমার রুমমেট সীমান্ত আহমেদ , আমার জোরাজুরিতে ব্লগে যার পদচারণার সূচনা।

সীমান্তের সাথে আমার সম্পর্কটা আপাত দৃষ্টিতে অনেক ফরমাল ,এখনও তুমি-তুমির শেকল ভেঙে তুই-তোকারি তে যায়নি , কোনদিন যাবেও না। কিন্তু ফর্মালিটিজের মাঝে যে দূরত্ব থাকে , তার পুরোটাই অনুপস্থিত সেখানে । গভীর আন্তরিক ফর্মালিটি বলতে যদি কিছু থেকে থাকে , সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তার সাথে আমার সম্পর্ক । আমার না বলা কথাগুলো পৃথিবীতে প্রথম যে কজন জানাতে ভালো লাগত , সে হয়ে উঠল। তাদের একজন ।

৩০১১ নম্বর রুমে আমরা ছিলাম ৩ জন , আমি , হাফিজ আর সীমান্ত । হলে আমি ভীষণ ইরেগুলার , টার্মের বেশির ভাগ সময়টা বাসায় কাটতো । আর তার নিবাস শেরে বাংলা হল । হাফিজও সারাদিন ব্যস্ত । ৩০১১ দিনের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে ঘুমিয়েই থাকতো ।

৩ জনকে একসাথে পেতে রাত ৩ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত । পরীক্ষা পেছানোর জল্পনা- কল্পনা , রাজনীতি , খেলাধুলা , , প্রেম নিয়ে কত আলাপ করেছি । অবাক ব্যাপার , প্রায় সব কিছুতেই আমাদের মতের মিল হত । অপরিচিত লোকের সামনে আমরা দু'জনই ভীষণ মুখচোরা , পরিচিত জনদের সামনে ছোটাই কথার ফুলঝুরি । ঢাকার উপকন্ঠেই তার বাসা ।

সীমান্ত তার মায়ের কথা বলত খুব , উইকেন্ডে বাসায় গিয়ে মায়ের সাথে তার সবকথা শেয়ার করত । কোন মেয়েকে তার পছন্দ হলে , আমাদের আগে জানতো তার মা । উইকেন্ড ছাড়া যখন তাকে বাসায় যেতে দেখতাম , তখন বুঝতাম তার বাসায় ভালো কিছু রান্না হয়েছে , মা তাকে ডেকেছেন । আমি আর হাফিজ স্মৃতি হাতড়ে প্রথম শ্রেণী থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত পড়া গল্প কবিতাগুলোর নাম খুঁজে বের করতাম । অন্তত চারটি বা আটটি লাইন সে মুখস্ত বলে দিত , আমাদের বিস্ময়ের রেশ কাটতো না ।

হাফিজ খেলাধুলার আলাপগুলোতে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতো , সেটা বেশি জমতো যেদিন ফারহান আমাদের রুমে আসতো । আমি আর সীমান্ত আর্জেন্টিনাকে তুলোধুনো করতাম । ২০ বছর আগের পরিসংখ্যান হুবুহু মনে রাখার ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না । এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির রুপকার সীমান্তের মা , ছোটবেলাতেই যিনি ছেলেকে বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন । পেশাগত জীবনেও যিনি ঢাকার শীর্ষ একটি সরকারী কলেজের বাংলার বিভাগীয় প্রধান ।

সীমান্তের কথায় বুঝি জীবনে তিনি ছেলের সবচেয়ে বড় বন্ধু , যার আবেশে আজ আমি মাকে সাহস করে অনেক কথা বলি, আমার মাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি । এ বছরটার প্রারম্ভে আমি আর সীমান্ত Ericsson এ একসাথে টিকে গেলাম । আমি ছাড়লাম Grameenphone আর ও teletalk এর অফার । নতুন এ জীবনের প্রথম দিনে ওকে দেখেছি অন্য রুপে । সীমান্তের মায়ের চোখে সেদিনের স্বপ্নটা কত বেশি রঙিন ছিল , সেটা হয়তো কেবল অনুভবই করে যাবো , কোনদিন স্পর্শ করতে পারবো না ।

আমার ক্রমাগত চাপাচাপিতে ব্লগ লিখতে শুরু করল সীমান্ত । সীমান্ত বলতো তার ব্লগের প্রথম পাঠক তার মা , তার লেখালেখির উৎসাহদাতাও সেই মা , ওর সবচাইতে ভালো বন্ধু । আগস্টে আমি এরিকসন ছেড়েছি । সীমান্ত ছেড়েছে সেপ্টেম্বরের । ৫ তারিখে ছিল তার দিন বদলের দিন , বাংলালিংক তার নতুন ঠিকানা ।

আমি জানি , সীমান্তের মা' ই ছেলেকে নতুন পথ দেখিয়েছেন , নতুন পথ চলার সাহস যুগিয়েছেন। পরের প্রহরগুলো রক্ত ঝরা, দিনবদলের একদিন আগেই মায়ের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ । ৩ দিন পাঞ্জা লড়েছেন , তারপর আত্মসমর্পন। এর মাঝেই আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ , একটি বারও বন্ধুর পাশে যেতে পারিনি । আক্ষেপটা অনেকদিন আমাকে পোড়াবে ।

এবার ঈদে হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল ওদের বাসায় যাই , কেন যে ওকে ফোনে পাচ্ছিলাম না জানিনা । হয়তো ভাগ্য বিধাতা শেষ মুহুর্তের আগে বাস্তবতার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাননি । ডিসেম্বরের ঈদের কথা ভেবে রেখেছিলাম , কিন্তু সে ঈদ সীমান্তদের জন্য শোক বয়ে আনবে , একবারও ভাবিনি। রশীদ হলের হয়ে সীমান্ত যেবার ভার্সিটি অ্যাথলেটিকস মিটে অল্পের জন্য হেরে গেল , সেবার তার মুখে যে গভীর বিষাদের ছায়া দেখেছিলাম সেটা কোনদিন ভুলবো না । জানিনা বিন্দু শোকে নিথর হওয়া সীমান্ত কি করে সাগরের উত্তাল তরঙ্গ সামলে নিয়েছে ।

সীমান্ত হারেনি । ৩ দিন আগে তার সাথে দেখা হয়েছে , আমার বাবাকে হাসপাতালে সে দেখতে এসেছিল । নতুন পথ চলাটা নতুন করে শুরু করার সংগ্রাম শুরু হয়েছে তার । তাকে দেখে আমার মায়ের চোখের কোনে চিকচিক করে ওঠা অশ্রুবিন্দু দেখে ক্ষণিকের জন্য আমার ঠোঁটটাও কেঁপে উঠে , চুপ করে থাকি , মুখটা ঘুরিয়ে নিই। কিছু বলতে চাই , বলতে পারি না ........................


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.