আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রশিদ ফকিরের ঈদ সপিং

.

সকালে বের হওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। বসার ঘরে অপরিচিত লোকের কথা শুনে গলা বাড়িয়ে দেখি রশিদ ফকির। তাকে ঘিরে আছে বাসার সবাই। রশিদ মিয়া প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে শাড়ি লুঙ্গি বের করে ওসবের পাড়-জমিন দেখাচ্ছেন। জানলাম,আব্দুর রশিদ ঈদে তার নিজের জন্য একটা লুঙ্গি,বউয়ের জন্য ১শ ৭০ টাকায় একটা বউয়ের জন্য ও একই দামে ছেলের বউয়ের জন্যও শাড়ি কিনেছেন।

ঈদ এক দিন পরে হবে শুনে সে গতকাল সন্ধ্যায় এগুলো বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। রাতে তিনি রাস্তার পাশে থাকেন বলে ওগুলো নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করেনি। আব্দুর রশিদের সঙ্গে বাসার সবার কেমন সদ্ভাব! কিছুক্ষণ পর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি। আব্দুর রশিদের মধ্যে এক ধরনের শিশু সুলভ তাড়াহুড়া। এর মধ্যেই জিঙ্গেস করলাম কয় টাকা পেলেন আঙ্কেল? আব্দুর রশিদের মধ্যে আজ ভিখারি ভিখারি ভাবটা নেই।

তার কপাল ঢাকা টুপিটার বদলে ফোটা ফোটা একটা নতুন টুপি পরেছেন। প্রথম দিন হাত গুটিয়ে পরেছিলেন যে রঙচটা শার্টটা তার বদলে একটা কালো টি শার্ট গায়ে চাপিয়েছেন। আমার অবশ্য লোকটার বিষয়ে প্রথম দিনের ঘোর নেই আর। এর পর দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে তার সাথে। জানিয়েছেন,ঈদ সামনে রেখে ভিক্ষা করলেও তার ইচ্ছা এর পর থেকে শুধু কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তরকারী চেয়ে নিয়ে সামনের রাস্তায় বসে বিক্রি করবেন।

ব্যবসা খারাপ হলে তবেই শুধূ ভিক্ষা করবেন। আশ্চর্য হয়েছি তার কথা শুনে!ব্যাটার দেখি বহু মুখি আয়। একটা পয়সা অকাজে খরচ করেন না। খাবারও কেনেন না। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে খেয়ে নেন।

রাতে ঘুমান ডেইলি স্টারের উল্টো পাশে যে মসজিদটা আছে তার সামনের যায়গায়। রশিদ সাহেব অবশ্য একে বলেন,মসজিদের সামনের ময়দান। ১০/১২ হাত যায়গাকে কেউ কোন আক্কেলে ময়দান বলে বুঝি না। ঢাকায় ভিক্ষুকের অভাব নেই, কিন্তু আব্দুর রশিদের জন্য বেশি মায়া লেগেছিল লোকটা জন্ডিজে ভুগছিল বলে। কিছু খেতে পারছিলেন না!এক ক্যানভাসার তাকে বারণ করেছেন,মাংস,ইলিশ ও চিংড়ি মাছ না খেতে।

১০ টাকা দিয়ে তিনি এই পরামর্শ নিয়েছিলেন। লোকটাকে একটা মোবাইল দিয়ে পরিচিতদের নাম্বার দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ করবো ভাবছিলাম। সে নিতে রাজি হয়নি। ওটা চুরি বা ছিনতাই হয়ে যাবে সহ কি কি যুক্তি দেখিয়ে এড়িয়ে গেলেন। তাকে কোন একটা বস্তিতে বা আরাম বাগের মেসে পরিচয় বদলে সস্তা একটা মেসে ওঠার পরামর্শ দিলে তিনি এটাকে অহেতুক টাকা খরচ বলে মত দিলেন।

উল্টো জিঙ্গেস করলেন এই বাড়িটা আমার কিনা! ভাড়া থাকি বলার পর হাল্কা এমন একটা ভঙ্গি চেপে গেলেন যা প্রকাশ করলে মনে হতো, টাকা খরচ করে এমন ভাড়া থাকার কোন মানে নেই। শেষে রশিদ ফকিরকে স্বাবলম্ভি করার নিস্ফল চেষ্টার অংশ হিসেবে নগদ কিছু টাকা ছাড়া কিছুই গছাতে পারলাম না। উল্টো আমার দিকে কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকালেন। তবে তার জন্য কেনা আইড় মাছের তরকারি দিয়ে পেট পুরে খেতে দেখে সত্যিই শান্তি পেয়েছিলাম। আমি ভেবে ছিলাম লোকটা আসবেনই না।

কিন্তু ঠিক ঠিকই এসেছিলেন। খাওয়ার পর কাজ আছে বলে কেটে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার স্ত্রী গ্রামে এক বাড়িতে কাজ করেন। ছেলে ছোট টা মাঝে মাঝে আসে টাকা কিছু জমলে গ্রামে পাঠান তিনি। কী কী কাজে কিছু টাকা সুদের উপর নিতে হয়েছে তাকে।

আব্দুর রশিদ দেখলাম সার্বক্ষণিক কথা বলে। এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে চলে যান একটু একটু করে। সবাই যেন তার সব কথা জানে। কাপড় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, লাল শাড়িটায় তিনি ঠকেছেন। এরপর আমার প্রশ্ন শুনে বলেন, ৩ হাজার টাকার মতো।

কিছু খুচড়া আছে। ছেড়া ২ টাকার নোট আছে কতগুলো দেশ থেকে ফিরে চালাবেন ওগুলো। আমি হিসেব করি,১০/১২ দিন হবে প্রথমবার আসার পর অতিবাহিত হলো। এর মধ্যে ৩ হাজার টাকা । মন্দ কি! লোকটার একটা জিনিস পছন্দ হলো , সে আমাকে নিজের উপর ভরসার যায়গাটুকু জানিয়ে কোন একটা যায়গায় দুশ্চিন্তা মুক্ত করেছেন।

মনে হলো সব মানুষের বাঁচার যাই হোক নিজস্ব ভরসার যায়গা থাকে। জিঙ্গেস করি,স্বাস্থ্য কেমন এখন? খেতে পারেন? রশিদ মিয়া বলেন,পেশাব হলুদ খুব। মাথা ঝিম ঝিম করে। তবে বাড়ি গেলে এই কয় দিনে ভাল হয়ে যাবেন। সঙ্গে আরো কি কি বলেন।

আমার খারাপ লাগাটা জেগে ওঠতে চায়। তবে তিনি বাড়ি গেলে তার পর্ণকুটিরের ছায়া তাকে হয়তো সুস্থ্য করে ফেলবে এই ভরসা জাগে। ভাবি এই লোকটা এতো খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে এক টাকা,দুই টাকা জোগার করার চেষ্টা হরেছেন কিভাবে! তার মতো আরো কত মানুষ করছে! আব্দুর রশিদ আবার আসবেন বলে চলে গেলেন। যাবার আগে দরজায় দাড়িয়ে জিঙ্গেস করলেন,বাবার জন্য দেশের থেকে কি আনবো?মাশ কলাই খান? লোকটা আদিখ্যেতা দেখে মেজাজ খিচড়ে ওঠে। বলি, না-কিছুই খাই না।

আপনার কিছু আনা লাগবে না। বলি ,আপনি কি রোজা? কিছু খেয়ে যাবেন নাকি?আব্দুর রশিদ বলেন,তিনি চৈত্র মাসেও রোজা রেখেছেন,এখন কার দিন ব্যাঙের লাফের এক লাফ। আব্দুর রশিদ চলে যাওয়ার পর, মনে আসে সে শাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা কি করবে। দুর থেকে তাকে বাড়ি ফিরতে দেখে বাবা এসেছেন বাবা এসেছেন বলে বোধ হয় দৌড়ে যাবে তার ছোট ছেলেটা। কিন্তু,রশিদ তো ছেলেটার জন্য কিছু কিনলেন না! ছোট একটা মেয়েও আছে বলেছিলেন কি? যাক,যার যার জীবন তার তার।

আব্দুর রশিদের অসুস্থতা খুব ভয়ংকর নয় বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রথম তার সঙ্গে কথা বলার পর খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। কি এক ঘোরে পেয়ে বসেছিল। চাচ্ছিলাম, দ্রুত সুস্থ হোক বুড়োটা। আব্দুর রশিদ এর আগের বার খেতে আসার দিন কি করবো কি করবো ভেবে গ্রামীণের স্বাস্থ্য সেবার হেল্প লাইনে ফোন করে পরামর্শ চেয়েছিলাম।

৭৮৯। এই সেবাটা আমার খুব পছন্দের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ প্রথম কলেই ফোন ধরেন। খুব মনযোগ দিয়ে সমস্যা শোনেন এবং পরামর্শ করেন। এ দফা ফোন করলে এক ভদ্র মহিলা ফোন ধরলেন,তাকে সমস্যার কথা বললে তিনি যে পরামর্শ দিলেন সে উপায়ে আব্দুর রশিদের চিকিৎসা সম্ভব নয়।

বলছিলেন, কিছু খেতে পারেন না মানে কি?খান না ? খেতে ইচ্ছে করে না? না খেলেও স্যালাইন ওয়াটার খাওয়াতে হবে। ঠান্ডা পানি,ফ্রুট জুস। আর ফুল বেড রেস্ট। বললাম আমি যার অসুখের কথা বলছি তিনি খুব হাঁটা হাঁটি করেন। অনেক সময় রোদেও ঘোরেন।

চিকিৎক বললেন,না না একদম রোদে হাঁটা হাঁটি করা যাবে না। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম লোকটা রাস্তার পাশে থাকেন,খুব গরিব। এ ক্ষেত্রে কি করা যায় একটু জানিয়ে হেল্প করবেন? তিনি কি একটা টেবলেটের নাম বললেন,৫ এমজি। বললেন,খাবার আগে তিন বেলা খেতে হবে। এত রুচি বাড়বে।

আর ফুল রেস্ট কিছু দিন। ঠান্ডা পানি। ঠিক হয়ে যাবে। আগে কখনো ও প্রান্ত থেকে ফোন কাটা হয়েছে এমনটা হয় নি। সেদিন কেটে দেয়ায় নিজেকে আহাম্মকের মতো লাগছিল।

ওষুধ ঠিক আছে। কিন্তু এই রোগীর ক্ষেত্রে তো এই ওষুধ যায় না। আব্দুর রশিদের জীবীকার পরিকল্পণা জেনে একটু নির্ভার লাগছে। এতোক্ষণে আব্দুর রশিদ পৌঁছে গেছেন নিশ্চয়। এতোক্ষণে কি!দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা।

এখন বোধ হয় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সকালে আবার ঈদ না ! ঈদ মোবারক আব্দুর রশিদ। রশিদ ফকিরকে নিয়ে আগের লেখাটা এখানে দেখতে পারেনঃভিখারি আব্দুর রশিদের স্বাস্থ্যটা ভাল যাচ্ছে না

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.