তখন দুই হাজার নয় সাল। সিনেমা নির্মান নিয়ে দুটা কোর্স শেষ করেছি, একটা কোর্স-ফিল্মও তৈরী করেছি। একটা কর্পোরেট ডকুেমন্টারী করেছি – অবস্থা যা তা। বুঝতে পারছি এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে তেমন কিছু হবে না। অভিজ্ঞতা দরকার।
ছোট্ট নেটওয়ার্কে জানিয়ে দিয়েছি – কেউ কাজ করলে যেন জানায়। এভাবেই সুযোগ পেয়েছিলাম এটিএন বাংলায় প্রোডিউসার আসলাম শিকদার ভাইয়ের সাথে কাজ করার। সব মিলিয়ে দুই মাস। টেলিভিশন প্রোগ্রামের কাজ কারবার বোঝা হল সেই সময়। নানা কারণে দুই মাসের বেশী কন্টিনিউ করা সম্ভব হল না।
ছেড়ে দিলাম।
জুন মাস আমাদের গ্রীষ্মের বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর প্রথম বছরে জুন মাস বাসায় বাবা মা’র সাথে কাটিয়েছিলাম। তারপর আর সুযোগ/ইচ্ছা হয় নি। কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেছি।
২০০৯ এর জুনে আসলাম ভাইয়ের সাথে আবার যোগাযোগ করলাম। তিনি টিভি প্রোগ্রামের চাপে অন্য কিছু করার সুযোগ করতে পারেন না, কিন্তু খুব আগ্রহ ডকুমেন্টারী নির্মানে। আমি বুঝেছিলাম যদি পুরো ব্যাপারটায় আমি সাহায্য করি তবে ডকুমেন্টারি নির্মান করা সম্ভব। এতে তিনি ডিরেকশন দেবেন সত্যি, কিন্তু কাজটা শেখা হবে আমার। আসলাম ভাই তখন মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ডকুমেন্টারী নির্মানের কনসেপ্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।
নাম ঠিক করেছেন – দৃশ্য একাত্তর। সে সময়ের ফটোগ্রাফারদের উপর ফোকাস করে নির্মান করা হবে। একটু ঘাটাঘাটি করতেই অনেক তথ্য বেরিয়ে এল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় দেশী বিদেশী ফটোগ্রাফাররা জীবনের ঝুকি নিয়ে সময়গুলোকে ইতিহাসের পাতায় স্থান দিয়েছেন কিন্তু এতদিন পরেও তাদের বেশীরভাগই স্বীকৃতি পান নি। এক এক করে সবাই ওপারে যাত্রা করছেন এবং শেষ সুযোগটাও নষ্ট হচ্ছে।
আমাদের ইচ্ছা সেরকম কিছু একটা করব।
আমার সাথে যোগ দিল জয়। উনি আমার পরে আসলাম ভাইয়ের সাথে সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। দুজনে একদিন বেরোলাম। জুন মােসর ২০ তারিখ।
বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরে এলাম। এম এ বেগ এর ছেলের সাথেও দেখা করেছিলাম। তারপর গেলাম রশিদ তালুকদারের বাসায়। কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাই, যদি দেখা পাই, যদি তিনি কোন তথ্য দেন, যদি তিনি একটা ডকুমেন্টারীর অনুমতি দেন। মুগদা থেকে রিকশায় কোথায় যেন যেতে হল – আমি চিনি না, জয় চিনেন।
তিনিই নিয়ে গেলেন। খুজে খুজে বের করলেন রশিদ তালুকদারের বাসা। যতজনকে জিজ্ঞেস করলাম বেশীর ভাগই চিনেন নাই। পুরানো এক দোকানদার দেখিয়ে দিলেন। গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকেন।
দরজা খুললেন তার ছেলের বউ। উদ্দেশ্য বললাম। তারা সামনের দরজা দিয়ে আমাদের ড্রইংরুমে এনে বসালেন। কিছু সময় পরে রশিদ তালুকদার স্যার এলেন। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী।
মুখ ভর্তি দাড়ি। কি ছবি দেখে এসেছিলাম আর কি চেহারা দেখলাম – কোন মিল নাই। কথা বলতে লাগলাম। সেই সময়ে আমি শুধু দরিদ্রই না, নি:স্ব মানুষও। ক্যামেরা কিনছিলাম, তিনদিন পরে দুর্ঘটনায় সেটা নষ্ট হবার পরে আরেকটা কেনা হয় নাই।
মোবাইলে শুধু কথা বলা যায়। জয় আগে থেকে ইনফর্মড ছিল না, তাই তার কাছেও কিছু নেই। শরীরের অবস্থা বললেন। অসুস্থ্য। একবার স্ট্রোক করেছেন।
কথা বার্তা জড়িয়ে যায়, সব কথা মনে করতে পারেন না। খাওয়া দাওয়া বেশ কন্ট্রোলড, ছেলের বউ দেখাশোনা করেন।
একাত্তরের স্মৃতি কিছু বর্ণনা করেছেন। সম্ভবত তিনি সে সময় দৈনিক আজাদের ফটো সাংবাদিক ছিলেন। পরে ইত্তেফাকে যোগ দেন এবং ২০০৭ এ রিটায়ার করেন।
আগেই বলেছি তিনি পুরানো সব কিছু মনে করতে পারেন না, সময় লাগে – তাই মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোন ঘটনা তিনি সে সময় আমাদের সাথে শেয়ার করেন নি। তবে কারা কারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ফটোগ্রাফি করেছেন, তাদের কারা জীবিত আছেন, কারা ইতমধ্যেই গত হয়েছেন সে ব্যাপারে বলেছেন। আমরা একটা লিস্ট তৈরী করে ফেললাম এইসব জীবিত মানুষদের। আমাদেরকে বারবার বললেন খুব দ্রুত যেন তার সাথে যোগাযোগ করি। কারণ তিনি অসুস্থ্য এবং কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকায় তার মেয়ের কাছে যেতে পারেন – চিকিৎসার উদ্দেশ্যে।
ইন্টারনেট থেকে নেয়া এই ছবিগুলোর মতই দুটো ছবি রশিদ তালুকদার দেখিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হল, ইন্টারনেটেও দুটো ছবিই ৭ই মার্চের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যি ছবি কোনটা?
ড্রয়ইরুমে তার তোলা বিভিন্ন ছবি আর কিছু পুরস্কার সাজানো ছিল। তিনি একটি বই ঘেটে ঘুটে কিছু ছবি বের করে দেখালেন। তারপর তার জীবনের একটি ঘটনা বললেন।
শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ৭ই মার্চ ১৯৭১ এ রেসকোর্স ময়দানে রশিদ তালুকদার বঙ্গবন্ধুর ভাষনের ছবি তোলেন। একটা দুটো নয়, অনেকগুলো। তার তোলা ছবি কিভাবে চুরি হয়ে গেল সেই বর্ণনা দিলেন। দুটো ছবি বের করে দেখালেন।
দুটোই ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ভাষন দিচ্ছেন এমন ছবি। কিন্তু পার্থক্যটা তিনি ধরিয়ে দিলেন। একটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুর সামনের ডায়াসটা সাদা কাপড়ে মোড়া, অন্যটা ফাকা। যদি একই ভাষনের ছবি হয় তবে কি তার সামনে থেকে কাপড়টা সরিয়ে নেয়া হয়েছিল? দুটো পৃষ্ঠা পরে আরেকটা ছবি বের করে পাতা ভাজ করে মিলিয়ে দেখালেন – একই ছবির দুটো অংশ, প্যানারমিক ভিউকে কেটে দু ভাগ করে দুটো পৃষ্ঠায় ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ের নাম আমার মনে নেই, ফটোগ্রাফারের নামও ভুলে গেছি।
তখন টুকে নিই নি, ভেবেছিলাম কদিন পরে শ্যুট করতে তো আসছিই। জানালেন – তার সেই ছবিগুলো তিনি কপিরাইট করে রাখেন নি। কাকরাইলে কি যেন এক অফিস আছে, সেখানে ছবি কপিরাইট করাতে হয়। এই সুযোগটা নিয়েছিলেন বন্ধুরূপী সেই ফটোগ্রাফার। রশিদ তালুকদারের ছবিকে নিজের ছবি বলে চালিয়ে দিয়েছেন, বই বের করেছেন সেই ছবি দিয়ে।
পরে রশীদ তালুকদারের কাছে স্বীকার করেছেন, রশীদ তালুকদারও কোন পদক্ষেপ নেন নি।
কথা হল অল্প, কিন্তু আন্তরিকতা হৃদয় ছুয়ে গেল। তার ছেলে ভেতর থেকে আমাদের জন্য আম আর জুস নিয়ে এলেন। স্যার আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছেলের সাথে বেশী কথা হল না, তিনি ভেতরে চলে গেলেন।
স্যার আমাদের ফোন নাম্বার দিলেন, বললেন পরের বার আসার সময় যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসি, তিনি অসুস্থ্য, কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না। আমরা দোয়া করলাম – কিচ্ছুটি হবে না।
আসলাম ভাইয়ের ব্যস্ততা এবং রেসপন্সের অভাবে রশীদ তালুকদারের কাছে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। আমার সাহস, উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় উপকরনের স্বল্পতা এবং ব্যস্ততার আধিক্য আমাকেও রশীদ তালুকদারের উপর সেই ডকুমেন্টারী তৈরী করার সুযোগ দেয় নি। আমি আফসোস করেছি বিভিন্ন সময়ে এই মানুষটির কথা ভেবে, বিভিন্নজনকে অনুরোধ করেছি কাজটা যেন করে – এই মানুষটির মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে যাবে ইতিহাস তৈরীর কাহিনীও।
সেই ক্ষতি অপূরণীয়। লাভ হয়নি।
অপূরণীয় ক্ষতি হয়েই গেল, ঠেকানো গেল না।
** ছবি কৃতজ্ঞতা:
Click This Link
Click This Link
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
:: লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে এই লেখার কোন অংশ কোথাও ছাপানো নিষেধ ::
সিনেমা নিয়ে যে কোন পোস্ট প্রথমে দারাশিকো ডট কমে প্রকাশ করা হয়। আপডেট থাকতে ফেসবুকে দারাশিকো'র ব্লগের সাথে থাকুন।
ধন্যবাদ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।