লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। পিতার শেষ চিঠি
মোহাম্মদ ইসহাক খান
প্রিয় পুত্র,
আমি কোনদিন কাউকে নিজের হাতে চিঠি লিখিনি। আমার চিঠিপত্র দেখার জন্য আলাদা লোক ছিল, ওরা আমার কাছে পাঠিয়ে দিত যেসব চিঠি পড়ার যোগ্য।
আমি পড়ে বলে দিতাম কী জবাব দিতে হবে। কিন্তু নিজ পুত্রের কাছে লেখার জন্য সেক্রেটারির সহযোগিতা নেয়া সমীচীন মনে করি নি। তাই কলম তুলে নিয়েছি। হাতের লেখা খারাপ হয়েছে, কারণ আমার শরীর দুর্বল, অক্ষরগুলো একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার অনুরোধ, কষ্ট করে পুরো চিঠিটি পড়।
আমি যখন জীবন শুরু করি, তখন আমার হাতে ছিল মাত্র একশো ডলার। সেটা একটি জায়গায় বিনিয়োগ করে, কঠোর পরিশ্রম করে, আজকের এই কোটি কোটি ডলারের সম্পত্তি আমি তৈরি করেছি। একসময় আমি পায়ে হেঁটে সব জায়গায় যেতাম, গাড়িভাড়া ছিল না বলে। কিন্তু একটা সময় আমার প্রাইভেট প্লেন হয়েছিলো।
ভাগ্য সাধারণত পরিশ্রমী লোকদের ফেরায় না।
আমাকেও ফেরায় নি। না, আমার পরিশ্রম, সাফল্য, কী পেয়েছি না পেয়েছি তার ফিরিস্তি দিতে তোমার কাছে লিখছি না। আমি লিখতে বসেছি কী হারিয়েছি তা লিখতে।
দীর্ঘ বিশ বছর কাজে ডুবে থেকেছি আমি, বাড়িতে কিংবা বাইরে। কাজ ছাড়া আর কিছু জানতাম না আমি, শুধু জানতাম আমার ব্যবসা আরও বড় করতে হবে, আরও লাভ বাড়াতে হবে, ব্যাংকব্যালেন্স আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে হবে।
বিশ্রাম নিতে চাইতাম না আমি, কর্মীদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করতাম। আমার প্রভাব এতই ছিল, ওরাও বিশ্বাস করেছিল এটাই জীবন। থেমে যাওয়া মানে সময় নষ্ট, দম নেয়া মানে আরও কিছু প্রফিট কমে যাওয়া।
এই করতে করতে আমি আমার পরিবারকে সময় দিতে পারি নি। না তোমার মা'কে, না তোমাকে।
কীভাবে তুমি বড় হচ্ছ, ভাল আছ না কষ্টে আছ, তা জানার প্রয়োজন মনে করি নি, কারণ ভেবেছি জীবনধারণের সব প্রয়োজনীয় উপকরণ, বিলাসব্যসনের সব জিনিস তোমাকে দেয়া হচ্ছে, তোমার আর কিছু চাওয়ার নেই, থাকতে পারে না।
এক সময় আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম, শরীরে বাসা বাঁধল কালব্যাধি। মৃত্যু যে খুব দূরে নয়, বুঝতে পেরে তোমাকে লেখার প্রয়োজন বোধ করলাম। কেউ বিশ্বাস করবে, এই বুড়ো বয়সে প্রথমবার পুত্রকে চিঠি লিখছি?
আমি তোমাদের কাউকে সময় দিতে পারি নি। সবার সাথে একত্রে বসে একটি ডিনারও করা হয়নি।
অনেকের ভিড়ে ছিলাম আমি, সবসময়। কর্মী, সহকারীরা আমাকে ঘিরে রাখতো। কিন্তু হাসপাতালের সংকীর্ণ বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে, নিঝুম রাতগুলোতে ভেবে ভেবে আমি বুঝতে পেরেছি, তোমাদের সবাইকে আমি বঞ্চিত করেছি। তোমার মা'কে তার প্রাপ্য সঙ্গ থেকে বঞ্চিত করেছি, পিতৃস্নেহ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করেছি। আমি আবিষ্কার করেছি, আমি এত বড় একজন মানুষ, অথচ আমার কোন বন্ধু নেই, সবাই আমার বেতনভোগী, কর্মচারী, যারা আমার সামনে বিনয়ের অবতার সেজে মেকী আনুগত্যের ভান করে।
কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ আমার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় না, আমি এই বিশাল পৃথিবীতে বড়ই একা। এজন্য দায়ী আর কেউ নয়, আমি নিজেই।
শেষ সময়ে আমার মনে হয়েছে, এটা আসলে কোন জীবন নয়, আমি একটা রোবট কিংবা উন্নতমানের টাকা তৈরির মেশিনের মতো নিরন্তর কাজ করে গেছি।
তোমার মনে নিশ্চয়ই ক্ষোভ আছে আমার প্রতি। তবুও, শেষ ক্ষণে এই বুড়োর মিনতি, আমাকে তুমি ক্ষমা কর, পুত্র।
যদি পারো, তাহলে তুমি একজন সাধারণ মানুষের জীবন যাপন কর, আমার মতো অভিশপ্ত জীবন নয়। দেখবে, তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।
একটা সময় তোমার স্ত্রী আসবে, তোমাদের সন্তান হবে। তাদেরকে সময় দিও, আমার মতো বঞ্চিত কোরো না যেন। তাদের সাথে হাসবে, খেলবে, গান গাইবে, ঘুরতে যাবে।
মাসের শেষে হাতখরচার একটা সম্মানজনক পরিমাণ টাকা পৌঁছে দিয়েই তোমার দায়িত্ব শেষ, তা যেন মনে কোরো না।
বিদায় পুত্র। এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছবে, আদৌ যদি পৌঁছয়, তখন সম্ভবত আমি আর নেই। আমি আরেকবার তোমার কাছে, তোমাদের কাছে, সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি বড় অপরাধী, কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করার সময় আমার আর নেই।
ওপারের ডাক শুনতে পাচ্ছি। তোমাকে আমি টাকাপয়সা আর বিষয়সম্পত্তি ছাড়া কিছু দিয়ে যেতে পারিনি, সেজন্য বড়ই আফসোস হচ্ছে। তুমি একজন পিতার কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পেতে পারতে। প্রিয় পুত্র, আবার বলি, আমার মতো হয়ো না, একজন সাধারণ মানুষের মতো হয়ো, বন্ধু আর প্রিয়জনদের হাত ধরে জীবনের পথে হেঁটে যেও, আমার মতো একা যেন চল না। যদি তাই কর, আমার মতো শেষ সময়ে তোমারও অনুতাপের সীমা থাকবে না।
সতর্কবাণী নয়, আদেশ নয়, উপদেশ নয়, এই কথাগুলো এক মৃত্যুপথযাত্রী এক বুড়োর মিনতি বলেই মনে কোরো।
হা ঈশ্বর! আমি আসছি। হায়! আমার সময় বড় কম।
তোমার দুর্ভাগা পিতা।
*****
ব্যস্ত পুত্র চিঠিটি তুলে নিলো।
কয়েকদিন হয় পিতার বিশাল ব্যবসার দায়ভার নিজের নবীন কাঁধে তুলে নিয়েছে সে, দম ফেলবার ফুরসৎ নেই, নিজেকে মনে হচ্ছে অথৈ পাথারে পড়ে যাওয়া একজন মানুষের মতো, যে দায়িত্বের চাপে খাবি খাচ্ছে। প্রতিদিন টেবিলে জমা হচ্ছে গাদাখানিক ফাইল, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক চিঠিপত্র।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের চিঠি, তদবির ইত্যাদি। এর মধ্যে কোনটা আবার একেবারেই ফালতু, না পড়েই ফেলে দেয়ার মতো। তবুও, সতর্কতা হিসেবে খামটা খুলে দেখতে হয়, প্রথম লাইনটা পড়ে দেখতে হয়।
এই চিঠিটি বেনামী। সাদা খামে ভরা, কোন প্রতিষ্ঠানের ছিলছাপ্পড় নেই।
নিজের কাজে অসম্ভব ব্যস্ত পুত্র চিঠিটি খোলারও প্রয়োজন মনে করলো না, আরেকটি মূল্যহীন চিঠি মনে করে দলা পাকিয়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে নিক্ষেপ করলো। এতে পুরো এক মিনিট সময় বাঁচল তার। এই সময়ে সে আরেকটি চিঠি পড়ে ফেলতে পারবে কিংবা আরও দুটো ফাইলে সই করতে পারবে।
কীভাবে এসব আবর্জনা জাতীয় চিঠি তার কাছে পৌঁছয় সে জবাব তলব করতে হবে আজই, সেক্রেটারি বড় অসাবধান হয়ে পড়েছে।
(৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।