আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে-

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীদের ভীড় সে অর্থে খুবই সাম্প্রতিক একটা ঘটনা, হয়তো আজ থেকে ২০ বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্নশাসিত হয়ে উঠবার আগে এখানের মেয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের পেছনে পেছনে গিয়ে ক্লাশ রুমে ঢুকতেন, সেখান থেকে বের হয়ে আবার মেয়েদের কমন রুমের প্রবেশ করতেন, তারও আগে কোনো এক সময় ক্যাম্পাসে মেয়েদের সাথে ছেলেদের কথা বলা জরিমানযোগ্য অপরাধ ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দেশের পরিস্থিতি এবং সামাজিক নৈতিকতা বদলে দেওয়া অনেক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে এই ক্যাম্পাসে, তবে একটা স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জাহাঙ্গীরনগর এগিয়ে, বাংলাদেশের সবচেয়ে সংগঠিত যৌননীপিড়ন বিরোধী অন্দোলন হয়েছিলো জাহাঙ্গীরনগরে। কতটুকু মরিয়া হলে মানুষ বিচ্ছিন্ন লোকালয়ে মোমবাতি জ্বেলে সারা রাত শকুনের থাবার নীচে শংকিত চড়াইয়ের মতো রাত জাগে? তবে উদ্যত বন্দুকের নল আর নির্যাতিত হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা পালিয়ে যান নি, সারা রাত পরস্পর যুথবদ্ধ থেকে ভয়াল একটা রাত অতিক্রম করে তারা নিজেদের দাবীতে অবিচল ছিলেন বলেই আজ জাহাঙ্গীরনগর যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে সরব। এই আন্দোলনের পুরোধা তারাই।

তারাই প্রথম কোণঠাসা অবস্থায় এসে উপলব্ধি করেছে শিক্ষাঙ্গনে নারী শিক্ষার্থীরা কতটা অসহায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোতে তাদের নীপিড়ন মেনে নেওয়ার সবক দেওয়া হয় পারিবারিক ভাবেই, তাদের নিজেদের নির্যাতনের যন্ত্রনা লুকিয়ে সমাজে ঘুরতে হয়, উচ্চতর মানসিকতার উঁচু শিক্ষাঙ্গনে এসেও তারা উন্নত চেতনাধারী মানুষ, তাদের পথপ্রদর্শক শিক্ষকদের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়। আন্দোলনের চুড়ান্ত পরিণতি কখনই পায় না, আন্দোলন ঝিমিয়ে যায়, সাময়িক একটা জয়ের মোলায়েম স্বাদ মুখে লেগে থাকে। মূলত আন্দোলন লক্ষ্য হারায়, আন্দোলন ব্যপকতা থেকে সীমিত পরিসরে চলে আসে, আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। যেকোনো সামাজিক আন্দোলন ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেলে ব্যক্তির অপসারণে সেই আন্দোলন মরে যায় , কিংবা ব্যক্তির পুনর্স্থাপনে সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

যখন আমাদের প্রয়োজন একটা যৌন নীপিড়নবিরোধী নীতিমালা, যেখানে শিক্ষাঙ্গনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য একটা কাঠামো থাকবে, যেই কাঠামো সীমিত ভাবে হলেও ক্ষমতাসীনদের প্রভাববলয়ের বাইরে থাকবে, যেখানে গিয়ে একজন নিপীড়িত নারী নিজের কথা বলতে পারবেন, কোনো বস্তুগত প্রমাণ ব্যতিরকেই মিছিল মিটিং এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ব্যতিরকেই একজন নারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত হবে। একটা নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান থাকবে নিপীড়ক শিক্ষকের জন্য, যেখানে শিক্ষকের দলীয় রং, তার রাজনৈতিক আনতি, তিনি সন্ধ্যা রাতে ক্যান্টনমেন্ট কিংবা মগবাজার কিংবা ধানমন্ডি গিয়ে নিজের বিবেক বেচে আসেন কি না এইসব অশালীন বিবেচনা থাকবে না। তার নিজস্ব নিপীড়ক পরিচয়ের বাইরে অন্য কোনো পরিচয় সেখানে গ্রাহ্য হবে না, সাদা কিংবা গোলাপী কিংবা লাল কিংবা সবুজ, যে রংয়ের দলের উর্দি চড়িয়ে তিনি ক্যাম্পাসে ঘুরেন না কেনো, সিনেট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে তিনি কোন দলের ভোটার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, এইসব বিবেচনা করে দলীয় ছাত্রসন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত হতে হবে না অভিযোগকারী শিক্ষার্থীদের। জাহাঙ্গীরনগরের যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন, সেখানেও একটা দাবি ছিলো অভিযুক্ত শিক্ষকের অপসারন তবে অন্যতম দাবি ছিলো একটা যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রনয়ন এবং এর বাস্তবায়ন। এমন একটা নীতিমালার খসরা দেওয়া হয়েছে একযুগ হয়ে গেলো।

ধুলো জমছে স্মৃতিতে- যৌন নীপিড়ন বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই আজ জাহাঙ্গীরনগরের নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের ভেতরে স্বর জন্মেছে, সম্মিলিত জনসচেতনতায় ভাষা পেয়েছে মুক- তারা আজ বলতে পারে অবলীলায় তাদের উপরে নির্যাতনের যাতনা। তারা অপমান- অবমাননার প্রতিকার চাইতে পারে। তারা নিজস্ব যন্ত্রনার বিষ পান করেও ভবিষ্যত নারীদের জন্য নিরাপদ শিক্ষাঙ্গনের দাবিতে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা বাস্তবায়নের মিছিলে যুক্ত হয়। তবে যৌন নীপিড়ন বিরোধী নীতিমালার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি এমন - নির্যাতিত ছাত্রী সব সময়ই নিজের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারছেন না, তাদের নিজের উপরে নির্যাতনের গল্প সবাইকে মাইক লাগিয়ে শোনাতে হচ্ছে, সভ্য সমাজে এটা কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না। মানবাধিকার সনদ, নারী সনদ সবখানেই একটা বিধি বিদ্যমান, পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীদের উপরে সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়নের বাস্তবতা ভুলে না গিয়ে তারা একটা চমৎকার বিধিমালা যুক্ত করেছে, নির্যাতিত নিজের অভিজ্ঞতা এবং অভিযোগ নির্দিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করবে এবং এই গোপনীয়তা এবং অভিযোগ তদন্ত চালাকালীন সময়ে এবং পরবর্তীতেও যদি নির্যাতিতের আইনী প্রতিরক্ষা এবং শাররীক নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় রাষ্ট্র এই কাঠামো প্রদান করতে আইনগত ভাবে বাধ্য।

বাংলাদেশ এই সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে, আমি এখনও বিশ্বাস করি যুথবদ্ধ প্রতিরোধব্যতীত নিপীড়িত মানুষের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই, কখনই ছিলো না আদতে। সামাজিক ক্ষমতায়নের নিয়মটাই এমন ক্ষমতার কানা গলি আর অন্ধ করিডোরে নিপীড়িত মানুষ বিচ্ছিন্ন নিজের যাতনা পান করে। সব সময়ই কোনো না কোনো উপায়ে তাদের নির্বাসিত দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন রাখবার প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকে ক্ষমতাসীন মানুষেরা। সামাজিক ক্ষমতার কারণেই সম্ভবত অধস্তনকে নির্বিচার নিপীড়ণের অধিকার জন্মে যায় বাংলাদেশে। আমাদের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতায় আমরা মধ্যযুগের ইউরোপের তুলনায় খুব বেশী এগিয়েছি এমনও না।

বস্তুত একজন সানোয়ার পর্যাপ্ত অকাট্য প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেলে এমন হতাশা তৈরি হয় না, বরং একটা শঙ্কা তৈরি হয়। এই দানবকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি, কোনো না কোনো কারণে, যদিও ধর্ষিত হওয়ার ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা ধর্ষিতার পক্ষে সম্ভব হয় না, যদিও যৌন হয়রানির চলচিত্র তৈরি করবে এমন মানসিকতা নিয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করে না, এমন কি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো একটা না একটা অজুহাত তৈরি করেই রাখে সব সময়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পন্থাটা নিয়মতান্ত্রিক হওয়া উচিত। নিপীড়ক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে নিয়ম, নিয়মের ফাঁক ফোকর দিয়েই নিপীড়ক মুক্তি পায়। আমাদের করনীয়: যৌন নীপিড়ন বিরোধী নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না, এক যুগের পুরোনো দাবি বাস্তবায়নের জন্য এখনও সময় ক্ষেপন শুধুমাত্র আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর নির্যাতনের সহায়ক হয়ে উঠবে।

নির্যাতিত শিক্ষার্থী বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, যদি আজ আমরা আওয়াজ না তুলি তবে পরবর্তীতে এমনই কোনো শিশ্নবাজ শিক্ষকের হাতে নির্যাতিত হবে আমাদের পরিচিত জন, আগুণ নিয়ন্ত্রনযোগ্য থাকতে থাকতেই সেটা নেভানোর ব্যবস্থা করা উচিত, নইলে সে আগুণে ঘর পুড়বে, হয়তো পরবর্তী নির্যাতিত শিক্ষার্থী হতে পারে আপনার মেয়ে, আপনার প্রিয় ছোটো বোন। আমরা যতটুকু করতে পারি, যে যার নিজস্ব অবস্থানে থেকেই সামাজিক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে পারি। এটার শুধুমাত্র একজন ছাত্রীকে আহত করে না, এটার প্রভাব সামাজিক। শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ আক্রান্ত হয় না যৌন নিপীড়নে বরং এর অভিঘাত ছড়িয়ে যায় সম্পূর্ণ সমাজে। যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালার খসরা তৈরি করা আছে, সেটা প্রচারের ব্যবস্থা নিতে পারি আমরা।

আমরা একই সাথে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান, ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আবেদন করতে পারি, তারা যেনো নিজের অবস্থানে থেকে জোর দাবি জানান যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা বাস্তবায়নের। আমরা বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের কর্মীদের কাছে যেতে পারি। আমরা সবাই মিলে উচ্চকিত হলে এই দাবি বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন নির্মান সম্ভব হবে। যদি আমরা আজ প্রতিরোধ না করি তবে ভবিষ্যতে আমাদের কন্যার নির্যাতিত অস্তিত্বের শব বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের কাঁধে। আমাদের পালানোর পথ নেই, আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।