চেনা দুঃখ চেনা সুখ চেনা চেনা হাসি মুখ ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দী
হস্তিশিশু আদরিণী। মায়ের সাথে বনবাদাড় ভেঙে চষে বেড়ায় মুক্তির আনন্দে। এ আনন্দে ছেদ পড়ল একদিন। শিকারিদের হাতে ধরা পড়ল সে। পায়ে শক্ত শিকল পরিয়ে বিক্রি করে দেয়া হলো সার্কাস পার্টির কাছে।
সার্কাসের পশুপালক তাকে ছ’ফুট লম্বা লোহার শিকল দিয়ে বিরাট থামের সাথে বেঁধে রাখল।
বনের মুক্ত প্রাণী আদরিণী বন্দী হয়ে গেল ছ’ফুট ব্যাসার্ধের বৃত্তের মাঝে। কিশোরী আদরিণীর কাছে এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। বারবার জোরে টান মেরে শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করতে থাকে। চেষ্টায় লাভ হয় না কিছুই।
শুধু পা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। ব্যথা ও যন্ত্রণায় কাতরাতে হয়। রক্তাক্ত পায়ে টান পড়লে ব্যথা আরও বাড়ে। শিকল ছেঁড়ে না। মুক্তিও মেলে না।
আস্তে আস্তে তার বিশ্বাস জন্মাতে লাগল, এ শিকল ভাঙা যাবে না। ভাঙতে গেলে ব্যর্থতাই আসবে, ব্যথাই বাড়বে।
আদরিণী বড় হতে লাগল। কিন্ত শিকল সে ভাঙতে পারল না। আস্তে আস্তে তার মুক্তির আকাঙক্ষাও মন থেকে বিলীন হয়ে গেল।
তার পৃথিবী সীমিত হয়ে গেল ছ’ফুট কত ধরণের ভ্রান্ত বিশ্বাস যে আমাদের মাঝে রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। যেমন : আমার পোড়া কপাল...., এত দায়িত্ব পালনের যোগ্য আমি নই...., সে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেছে, তার সাথে প্রতিযোগিতায় আমি পারব না....., এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো মুশকিল...., জীবনটা আমার দুঃখে-দুঃখেই যাবে...., বড় কিছু করা আমার কপালে নেই...., আমার কপালে সুখ সয় না......, আমার এই অসুখ ভাল হবে না.... এরকম হাজারও নেতিবাচক ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের নিগড়ে আমরা বন্দী জীবন যাপন করছি।
বিশ্বাস ভ্রান্ত হোক বা সঠিক হোক, তার একটি সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে। ডা.ম্যাক্সওয়েল মলজ বিশ্বাসকে এক ধরনের আত্মসম্মোহন বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিটি মানুষই কোন না কোনভাবে কিছুটা হলেও সম্মোহিত হয়ে থাকে।
সে কখনও নিজের অজ্ঞাতসারে অন্যের ধারণা গ্রহণ করে সম্মোহিত হয়, বা নিজের সম্পর্কে বারবার কোন ধারণা ব্যক্ত করে তা বিশ্বাস করে সম্মোহিত হয়। একজন সম্মোহনকারী সম্মোহিত ব্যক্তির মনে কোন নেতিবাচক ধারণা ঢুকিয়ে দিলে যে প্রভাব সৃষ্টি করবে ঠিক সেই একই ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে এই নেতিবাচক বিশ্বাস বা ধারণা। আমরা জানি, সম্মোহিত অবস্থা হচ্ছে মনোযোগ প্রক্ষেপণের ফলে সৃষ্ট সংকীর্ণ পরিধিতে চেতনার এক তুঙ্গ অবস্থা। চেতনার এই পরিধিতে মস্তিষ্কের ডান বলয়ের চিত্রকল্প সুস্পষ্ট প্রক্ষেপণের ক্ষমতা ব্যবহৃত হয় এবং এ ক্ষমতা বাম বলয়ের সকল প্রতিবন্ধকতা, অর্থাৎ যুক্তিগত বাধাকে পাশে সরিয়ে দেয়। আর আপনারা সবাই জানেন, সম্মোহিত অবস্থায় একজন মানুষ যে অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করে তা তার মাঝে আগে থেকেই সুপ্ত ছিল।
কিন্তু সে এ ব্যাপারে সচেতন ছিল না বলে আগে এ ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে নি। যারা ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দী তারা সবসময় নিজের অজ্ঞাতসারেই নিজের শক্তি ও ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলে নিজের মধ্যে সুপ্ত অফুরন্ত সম্ভাবনা সম্পর্কে বেখবর থেকে যায়। পারিপার্শ্বিক ব্যর্থতা ও নির্জীবতায় আক্রান্ত হয়।
ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ডক্টর ম্যাক্সওয়েল মলজের সাইকোকেবারনিটক্স পদ্ধতিতে বেশ সহজ কিছু উপায় বাতলানো হয়েছে। আপনি অনায়াসে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারেন।
ভ্রান্ত বিশ্বাস চিহ্নিত করার উপায়
আপনি কি কোন ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দী হয়ে আছেন? খুব সহজেই তা খুঁজে বের করতে পারেন। হাতে কাগজ-কলম নিন। নিচের প্রশ্নগুলো পড়ুন এবং জবাব লিখুন।
১. বাস্তবে আপনার প্রতি হুমকি নয় এমন কোন পরিস্থিতিতেও কি আপনি ভীত-সন্ত্রস্ত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন? এই পরিস্থিতিগুলো কী কী? অচেনা লোককে টেলিফোন করা? মিস্ত্রির সাথে মেরামতি কাজের বিল নিয়ে আলোচনা বা পদস্থ কারও সাথে সাক্ষাৎ করা? কেন আপনি মনে করেন যে এ ধরনের পরিস্থিতি আপনার শরীর-মনের জন্যে ক্ষতিকর?
২. আপনি কি মনে করেন যে, আপনা-আপনিই এমন সব ঘটনা ঘটে যা আপনার সাফল্যের পথে অন্তরায়? আপনি কী পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছেন? সুনির্দিষ্ট কী পরিস্থিতি আপনার জন্যে বাধা সৃষ্টি করছে? নিম্নোক্তভাবে আপনার জবাব লিখুন : আমি... হতাম, যদি না..... ঘটনা অন্তরায় সৃষ্টি করতো।
৩. লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে, ‘আমি পারব না,’ ‘আমি ভাল নই’, ‘আমি যোগ্য নই’, ‘আমি এর উপযুক্ত নই.....? এ ধরনের চিন্তা কী পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে? আপনি নিজেকে কী বলেছেন? আপনার লক্ষ্য কী ছিল? নিজের উত্তর এভাবে লিখুন : আমি মনে করি যে...আমি পারব না, কারণ..........।
৪. আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে, আপনি আপনার কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার পথে এক ধরনের দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে যাচ্ছেন? এক ধরনের অপবাদে জড়িয়ে পড়ছেন? কী চেয়েছিলেন আপনি? পেশা বা চাকরি পরিবর্তন? সম্পর্ক উন্নয়ন? ব্যক্তিগত কোন উদ্যোগ? কী অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে আপনি পরিকল্পনা করেছেন? সুনির্দিষ্টভাবে লিখুন।
সব লেখা শেষ করেছেন? আপনার ব্যর্থতার জন্যে যে কারণগুলো বের করেছেন সেগুলো ভালভাবে দেখুন। ভয়, সংশয় বা আত্মধিক্কার- যা-ই আপনি বর্ণনা করেছেন তার সবটাই ভ্রান্ত বিশ্বাসে নিজের অজ্ঞাতে সম্মোহিত হওয়ারই পরিণাম। অবচেতন মনের কাছে বারবার একই পুরানো ভাঙা রেকর্ড বাজানোর ফলশ্রুতি।
আপনি এখনও এ কথাগুলো হয়তো মানতে পারছেন না।
আপনি এখনও হয়তো বলছেন, এ ধারণা বা বিশ্বাসগুলো তো মিথ্যা নয়। আমি তো অপমানিত হয়েছি! আমি তো এ কাজের যোগ্য নই! অন্যকে আকৃষ্ট করার কোন গুণাবলি তো আমার নেই!
যদি তাই হয় তবে আপনাকে আরও গভীরে যেতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে আপনার ভ্রান্ত বিশ্বাসের উৎস। কাগজ-কলম নিন। নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব লিখুন :
১. বুঝতে শেখার পর আপনার প্রথম স্মৃতি কী?
-ঘটনাটি কী ছিল?
- বয়স কত ছিল?
-আপনার সাথে কে ছিল?
- কী অনুভূতি মনে পড়ছে?
২. ছোট শিশু হিসেবে আপনি কেমন ছিলেন?
- আপনার ব্যাপারে পরিবারে কোন্ গল্প প্রচলিত?
-আপনি কি মনে করেন যে, আপনি পরিবারের কাঙিক্ষত সন্তান?
হ্যাঁ
না
আপনার এই ধারণার সমর্থনে কোন্ ঘটনা কাজ করছে?
-আপনার ডাক নাম কী?
-আপনি কি পরিবারের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন?
হ্যাঁ
না
উত্তর যদি ‘না’ হয় তবে এর সমর্থনে কোন ঘটনা রয়েছে কি?
-স্কুলে পড়াশোনা শুরু করার আগের সময়কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
৩. প্রাইমারি স্কুলে আপনার জীবন কেমন ছিল?
-কোন্ কোন্ ঘটনা আপনার বেশ মনে আছে?
-আপনার শিক্ষকরা আপনার সম্পর্কে কী বলতেন?
-আপনার প্রগ্রেস রিপোর্টে সাধারণভাবে কী লেখা হতো?
-ছোটবেলায় বন্ধুত্ব কতটুকু করতে পারতেন?
খুব সহজে
কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল
তেমন কোন বন্ধু ছিল না
-আপনার সহপাঠীদের আপনার সম্পর্কে কেমন ধারণা ছিল?
ভাল
বেশ ভাল
সাদামাটা
এই উত্তরগুলোর সাথে আগের প্রশ্নের উত্তরগুলো মিলিয়ে দেখুন।
আপনার ভ্রান্ত বিশ্বাসের উৎসগুলো খুঁজে পাবেন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুর নিজের সম্পর্কে ধারণা জন্মে পারিবারিক পরিমণ্ডলে তার সম্পর্কিত কথাবার্তা ও আলাপ-গল্প থেকে। স্কুলে যাওয়ার পর বাইরের প্রভাব ঘরে অর্জিত নিজ সম্পর্কিত যোগ্যতা বা অযোগ্যতার ধারণাকে জোরদার করে।
ছোটবেলার স্মৃতিই আপনার ভ্রান্ত বিশ্বাসের উৎস খুঁজে বের করতে সক্ষম। বাবা/মা/ভাই/বোন বা আত্মীয়দের আপনার সম্পর্কিত নেতিবাচক কথার ক্রমাগত প্রভাবই আপনার অসীম শক্তিকে সীমিত করে ফেলে।
নিজের অসীম শক্তি আপনার অগোচরেই বন্দী হয়ে পড়ে।
এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? উপায় খুবই সহজ। আপনি জানেন আপনার এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। কিছু অযৌক্তিক নেতিবাচক কথার বারবার পুনরাবৃত্তি আপনার আসল শক্তিকে শৃঙ্খলিত করে ফেলেছে। আর আপনার এই ভ্রান্ত বিশ্বাস এখন আপনার দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে কোন অভ্যাস বদলানো যায়। একটু সচেতন প্রচেষ্টা চালালেই এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দীদশা থেকে আপনি মুক্তি পেতে পারেন। কারণ মানুষ হিসেবে আপনি অনন্য। পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষের কেউই আপনার মত নয়। সবার মত আপনিও অনন্য কিছু গুণাবলি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন।
এই গুণাবলিকে আপনিও বিকশিত করতে পারেন। কারণ সভ্যতার সব কিছু মানুষের সৃষ্টি। আর আপনিও মানুষ।
কোয়ান্টাম মেথড অনুসারে আপনি নেতিবাচক চিন্তা ও কথা তথা ভ্রান্ত বিশ্বাসের বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় আলফা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে সকল নেতিবাচক চিন্তা ও ধারণাকে এক এক করে লিখে তা ক্রস চিহ্ন দিয়ে বাতিল করে দিন। বাস্তবে কোন নেতিবাচক চিন্তা এলে সাথে সাথে ‘তওবা, তওবা’ বা ‘বাতিল, বাতিল’ বলে তার প্রভাব নষ্ট করে দিন।
আর মনের বাড়িতে বসে সবসময় আত্মশক্তি জাগ্রত হওয়ার অটোসাজেশন দিন বা বারবার ইতিবাচক প্রত্যয়ন করুন। আত্মপ্রত্যয়নের পুনরাবৃত্তি করুন। দেখবেন ভ্রান্ত বিশ্বাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে অসীম সম্ভাবনার আকাশে আপন মহিমায় বিচরণ করছেন আপনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।