আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এনামুল আজিমঃ অকালে ঝরে পড়া একটি প্রতিভা



এনামুল আজিমঃ অকালে ঝরে পড়া একটি প্রতিভা (ভোরের কাগজ, ৩০শে জুন, ২০০৩) ডঃ মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান, বুয়েট সপ্তাহ তিনেক আগে অফিসে বসে আছি। পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্ররা হয় কোর্স না হয় থিসিস রেজিস্ট্রেশন করার জন্য স্বাক্ষর নিয়ে যাচ্ছে। ভালো হোক আর মন্দ হোক এই স্বাক্ষর দেবার ব্যাপারে আমি বরাবরই বেশী নমনীয়। বিগত বছরগুলিতে আমার অভিজ্ঞতা বলে ৫-৭% এর বেশি ছাত্র ডিগ্রি করে না। পোস্ট গ্রাজুয়েট পোগ্রামে একদিকে বৃত্তির পরিমাণ কম অন্যদিকে কম্পিউটারের চাকরি তুলনামুলকভাবে সহজলভ্য।

এই দুইয়ে মিলে ছাত্রদের ডিগ্রি করতে নিরুৎসাহিত করছে। যাহোক, এনামুল আজিম আমাদের বিভাগ থেকে গত বছররের এপ্রিল মাসে পাস করেছে। এসেছে থিসিস রেজিস্ট্রেশন করতে। প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পরপরই ন্যাশনাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের নির্বাচনীতে সে ভালো করেছিল। পরবর্তী সময়ে আর প্রোগ্রামিং নিয়ে ততোটা তৎপর ছিল না।

সেই সুবাদে যোগাযোগ খুব বেশী না থাকলেও তাকে ভালোভাবে চিনি। আমাকে সম্ভাব্য থিসিস সুপারভাইজার হিসাবে থিসিসের রেজিস্ট্রেশনের সাক্ষর করার জন্য অনুরোধ করলো। দুয়েকটি কথা যেমন কোন বিষয়ে থিসিস করবে, প্রকৃত আগ্রহ কোন বিষয়ে এগুলো জিজ্ঞাসা করে সাক্ষরও দিয়েছি। এরমধ্যে ব্রিফকেস থেকে হাতে লেখা কয়েক পৃষ্ঠা বের করে আমাকে দিয়ে বললো," স্যার, আমি এই ধরণের কাজ করি, যদি একটু দেখতেন। " নিজের কাজ দেখিয়ে যোগ্যতার স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা সম্ভবত এটাই প্রথম।

আমি কাগজগুলো পাখির মতো দেখে ফেললাম। প্রত্যেকটি পৃষ্ঠায় নানা ধরণের সিরিজের যোগফল কোনো প্রমাণ ছাড়াই। মুহূর্তের মধ্যে আমার মহাপ্রতিভাধর রামানুজনের কথা মনে পড়ে গেলো। যাহোক, সিরিজগুলো জটিল ছিল বলে আগ্রহ প্রকাশ করার ধৈর্য এবং সাহস আমার মধ্যে ছিল না। ছেলেটি আমার অফিস থেকে বের হবার পর কাগজগুলো আবার আমি উল্টিয়ে দেখলাম।

আমার সাধারণ বুদ্ধিতে সমীকরণগুলো অর্থবোধক এবং সুন্দর মনে হলো। দুয়েকটির বাউম্ডারি কন্ডিশনও মিলিয়ে দেখলাম। ভাবলাম এরকম একটা বিযয়েই তো সে সহজে তার পোস্ট গ্রাজুয়েট থিসিস লিখতে পারে। সপ্তাহ দুয়েক পর এনামুল আজিম আমার বাসায় চলে এসেছে। তখন মনে হলো ছেলেটি বছরের পর বছর এই কাজগুলি করে এসেছে সম্ভবত কারো স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি কিংবা ভাবের বিনিময় ও করতে পারেনি।

ঐ দিন আমার সঙ্গে আলোচনার পর মনে হয়েছে আমার সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যাবে, তারপর বসে তার আবিষ্কৃত সমীকরণ গুলো দেখাতে লাগলো। আমি দুয়েকটি প্রমাণ করতে বলায় প্রমাণ ও করে ফেললো আবার দুয়েকটির ক্ষেত্রে বললো প্রমাণ জটিল ও সময়সাপেক্ষ তবে তা তার আছে। আমাদের দেশে আমরা রেফারেন্সের অভাবে অনেক সময় এমন কাজ করে থাকি যা হয়তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। তখন আমি তাকে বললাম সে ম্যাপল কিংবা ম্যাথমেটিকার মতো সফটওয়্যার দিয়ে এই সিরিজগুলোর যোগফল নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে কিনা। সম্মতিসূচক উত্তর দিয়ে সে আমাকে আরো জানালো, ইন্টারনেটের কোনো কোনো সাইটে সংশ্লিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়।

সেই তথ্যগুলো ডাউনলোডও করে রেখেছে। প্রিন্ট করেছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে বললো, এগুলো গণিতের বিষয় তাই ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এম্ড টেকনোলজি চিটাগাং যেখানে সে কর্মরত সেখান থেকে এগুলি প্রিন্ট করেনি। আমি তাকে সিডি করে দিতে বললাম যা থেকে প্রিন্ট করে দেবো। তার সঙ্গে ঘন্টাখানেক আলোচনায় মনে হলো সিরিজের যোগফল বের করা নিয়ে সে অনেক লেখাপড়া করেছে। সে অবশ্য বললো, তার দুয়েকটি ফলাফল লিটারেচারে পাওয়া গেছে কিন্তু বাকিগুলো এখনো নতুন মনে হচ্ছে।

আমি দুয়েকটি ওয়েব সাইট এবং বইয়ের নাম বললাম যাতে তা দেখার চেষ্টা করে। আমাকে একেকটি সমীকরণ করে তার বর্ণনা দিচ্ছিল কিভাবে সে যোগফল অনুমান করেছে। মোটের উপর সম্ভবত গত ৫-৬ বছর যাবৎ এই সিরিজ যোগফলের ভূবনেই যে তার বিচরণ ছিল এটা অনুধাবন করতে আমার বেগ পেতে হলো না! আমি তাকে ম্যাথ এনালাইসিস ফর কম্পিউটার সায়েন্স পড়িয়েছি। বিভিন্ন সিরিজের যোগফল কিভাবে বের করতে হয় তা এর মধ্যে ছিল। লজ্জাই লাগছিল এই ভেবে যে, এ রকম একজন ছাত্র আমার ক্লাশে ছিল অথচ তার সঙ্গে আমার এ বিষয়ে আলাপ হয়নি।

উপরন্তু আমি ক্লাশে যা শেখানোর চেষ্টা করেছি ওগুলো তার জন্য শেখার বিষয়ও ছিল না। সে কিন্তু কোনোদিন আমাকে বলেনি এই বিষয়গুলো খুবই সহজ কিংবা তার কাছাকাছি যে কাজগুলো করেছে তা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনাও করেনি। নিশ্চয়ই একটি দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে আমাকে বলারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। যাহোক, আমি তাকে খুব উৎসাহিত করলাম।

এও বললাম এসব বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। তাকে দ্রুত এই সমীকরণ গুলোর প্রমাণ করে আনতে বললাম যাতে প্রকাশনায় পাঠানো যায়। এই ফাঁকে সে তার জীবনের উদ্দেশ্যও বলে ফেললো। রামানুজন কিভাবে চিন্তা করেছেন তা বের করাই তার জীবনের উদ্দেশ্য। রামানুজন সম্পর্কেও সে বেশ কিছু পড়ালেখা করেছে।

সে নিজেও কিভাবে কিছু কিছু সমীকরণ অনুমান করেছে তাও বললো। অত্যন্ত সহজ একটি সমীকরণ লিখে তাতে নতুন নতুন প্যারামিটার যোগ করে সমীকরণের শুদ্ধতা নিশ্চিত করা। আমার মনে হলো এই ধরনের করতে পারলে আমি অনেক আগেই প্রকাশনার জন্য পাঠিয়ে দিতাম। এনামুল আজিম আমার বাসা থেকে চলে যাওয়ার আগে আমার ছোট ছেলে সুমিতকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম একজন রামানুজনের সঙ্গে। এনামুল আজিমের এই চলে যাওয়া যে মহাপ্রস্থান হবে তা কখনো আমি ভাবতে পারিনি।

বরং ঐ দিনের আলাপের পর মনে হচ্ছিল আমি দীর্ঘদিন এনামুল আজিমের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারবো, তাকে উৎসাহিত করবো। তার মেধার, দক্ষতার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবো। এর মধ্যে আমার বন্ধু ড. ইফতেখারকেই এই ছেলেটি সম্পর্কে বলেছি, তার প্রশংসা করেছি। কয়েকদিন পর তার মোবাইলে ফোন করেও কাজের তাড়া দিয়েছি। সে আমাকে বলেছে কাজগুলো ঠিকমতো করছে।

আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে এনামুল আসবে। তার প্রমাণ গুলো কেমন হবে, ফলাফলগুলো যদি সত্যিই সব নতুন হয় তাহলে কেমন হবে ইত্যাদি। শুক্রবার সকালে পত্রিকা আসার সঙ্গে সঙ্গেই পড়া শুরু করলাম। প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ ২২ জনের মৃত্যু। একটু ভিতরে ইউএসটিসি-এর শিক্ষক এনামুল আজিমের নাম।

সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বাসায় এই খবরটা কাউকে বলিনি। এনামুল আজিম বাসায় একদিন আসাতে সবাই তাকে চেনে কারণ আমি সবাইকে বলেছি এনামুল আজিম একজন রামানুজন। আমার এই লেখাটি বের হওয়ার পর আমার বাসার সবাই ধরবে কেন এই দুঃসংবাদের কথা তাদের বলিনি। শুক্রবার সন্ধ্যায় অধ্যাপক জাফর ইকবালকে বলেছি।

শনিবার সকালে যখন লিখতে বসেছি এনামুল আজিমের সহপাঠী আমাদের বিভাগের শিক্ষক সোহেলের সাথে কথা বলেছি। তার গণিতপ্রীতি এবং দক্ষতা ক্লাশের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আমাদের শিক্ষক ড. মোস্তফা আকবরকে বলায় তিনিও আফসোস করেছেন। এনামুলকে আমার সঙ্গে থিসিস করার উপদেশ তিনিই দিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাস করা এনামুল আজিম জীবনটাকে মনে হয় কখনো উপভোগ করতে পারেনি।

তার আবিষ্কৃত সমীকরণগুলো নিয়ে হয়তো কারো সঙ্গে তেমন আলাপও করতে পারেনি, মেধার স্বীকৃতির কথা না হয় বাদই দিলাম। পাস করার পর ছাত্ররা সাধারণত চাকরির সুযোগ খোঁজে, জিজ্ঞাসা করে, অনুরোধ করে। এনামুল মনে হয় কাউকেই চাকরির বিষয়ে অনুরোধ করেনি। লোহাগড়া উপজেলার রশিদের ঘোনা গ্রামের ছেলে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম কলেজের ফার্স্ট বয় ছোটবেলা থেকেই কোনো স্বীকৃতির জন্য নয় মনের আনন্দে গণিতের চর্চা করেছে। ঢাকায় ৬ বছরের বিদেশী জীবনযাপন করে চট্টগ্রামে নিজের বাসভবনে চলে গিয়েছিল চিরনিদ্রায় শয়নের জন্য ঠিক যে রকমটি রামানুজন করেছিলেন।

রামানুজনের ক্ষেত্রে হার্ডি বিলাতে থাকতে অনুনয় বিনয় করেছিল। বাংলাদেশে কোনো হার্ডি নেই তাই এনামুল আজিমের পক্ষে নীরবে-নিভৃতে তার বাসস্থানে যাওয়া সম্ভব হলো চিরকালের জন্য। (এনাম আমার ছোট ভাই। ২৬ শে জুন ২০০৩ এ দূর্ঘটনাটি ঘটে। স্যারের এ লেখাটি এখানে দিলাম ওর সহপাঠিদের জন্য যারা দেশে ও দেশের বাইরে আছে।

) (নিউজপেপার ফিড: Click This Link)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.