একজন মামুনের কথা
আফরোজা পারভীন
এক সময়ের নিবিড় পাড়াগাঁয়ে এখন শহরের ছোঁয়া লেগেছে। এখন আর কেউ বলবে না ঝুম গ্রাম। সন্ধ্যেবেলায় হারিকেনের হালকা আলোয় যখন আঁধার কাটি কাটি করে কাটবে না, আলোর অন্য পাশে জমাট বাঁধবে অন্ধকার তখনকার সেই দিন এখন আর নেই। এখন গ্রামজুড়ে আলোর বন্যা। বৈদ্যুতিক আলো।
যে আলোর আবাহনে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশি রাশি পোকা। পড়ে আর মরে। মানুষের মতো পোকারাও ঠেকে শেখে। প্রকৃতি তাদের শেখায়। তাই আলো যতোই টানুক এবং তীব্র আলোয় যতোই চোখ ধাঁধাক ও-মুখো আর হয় না আলোপাগল পোকারা।
তাই আলোর চারপাশে দিন দিন পোকার সংখ্যা কমে।
আর আস্তে আস্তে ওরা এ আলোর সঙ্গে মানিয়ে নেয়। যেমন মানিয়ে নেয় গ্রামের লোকরা। ওরা এখন বাইকে করে শহরে যায়। ঘরে বসে টিভিতে সিনেমা দেখে, সিডিতে গান শোনে।
শুধু সন্ধ্যেবেলা হিন্দু বাড়িতে এখনো তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে, শাঁখ বাজে, উলুধ্বনি ওঠে। গ্রামে কারো বাড়িতে ছেলে জন্ম নিলে আজো ধ্বনি ওঠে। ধর্ম আর সংস্কৃতি পাশাপাশি এগিয়ে চলে।
এ গ্রামের ছেলে মামুন শিকদার। দু’বারের চেষ্টায় এইচএসসি পাস করেছে।
বাবা নেই। বড় দুভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। বাবার জমি-জায়গা ভাগ করে নিয়ে দালান উঠিয়েছে তারা। সন্ধ্যাবেলা গায়ে সুগন্ধি পাউডার ঢেলে মাথায় ফুলেল তেল মেখে ভাই বৌ এরা টিভি দেখে।
মামুনের বয়স্ক মা তখন ভাঙা হারিকেনের সলতে জ্বালিয়ে ঘরে সাঁঝবাতি দেয়।
ছোট বলে মামুনকে বড় ঠকিয়েছে ভাইয়েরা। জমিজমার সামান্যই তাকে দিয়েছে। মামুন প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। মা বারণ করেছে।
: তুই ওদের সঙ্গে পারবি না বাবা।
আমার পেটের ছেলে তো, ওদের আমি চিনি। অতো খারাপ ওরা ছিল
না। তবে বৌগুলো ওদের মাথা খেয়েছে। ওদের কিছু বলতে যাসনে। শেষে কোনো তি করে বসবে।
তুই তো দুটো পাস দিয়েছিস। ওরা বকলম।
এবার তুই ভালো দেখে একটা চাকরি জোগাড় করে নে। একটু থেমে মা বলেন, আমার বড় শখ একটা পাকা দালানের। হবে না বাবা? মাকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে নিজেই সন্দিহান হয়ে পড়ে মামুন।
কি করে হবে। আজকাল তো এমএ পাস ছেলেরা রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে।
এতো মানুষ, চাকরি আর কয়টা। তার মতো এইচএসসি ফেলকে কে চাকরি দেবে। তবু গোলার ধান বেচে ঢাকায় আসে মামুন।
দিনের পর দিন ঘোরে শহরের অফিসপাড়াগুলোতে যেনতেন একটা চাকরির আশায়। মাস যায়, বছর যায়। চাকরির দেখা মেলে না। এদিকে বাড়িতে অভাব।
খোরাকির ধান বেচে ঢাকা গিয়েছিল মামুন।
এখন পেট চলবে কি করে? মা তবু মামুনকে কিছু জানান না। এর ওর বাড়ির কাজ করে একটা পেট চলে যায়। মায়ের মনে বড় আশা মামুন চাকরি পাবে, বাড়িতে পাকা দালান উঠবে, টেলিভিশন আসবে, ফ্রিজ আসবে, মামুনকে বিয়ে দেবেন, বৌয়ের কোলজুড়ে নাতি-পুতি আসবে। তাদের সংসারে সুখপাখিরা ঘর বাঁধবে।
মতিঝিলের অফিসপাড়াতেই একদিন লাবলুর সঙ্গে দেখা।
দুজন দুজনের মুখ চেনা। অনেক অফিসে চাকরির সন্ধানে একসঙ্গে গেছে। লাবলুই এগিয়ে এসে কথা বললো,
: ভাই, বাড়ি কোথায় আপনার?
: কুমিল্লার দেবীদ্বারে। আপনার?
: পটুয়াখালী। ভাই, অনেক তো ঘুরলেন।
কোনো আশার আলো দেখেছেন? চাকরি হবে?
: নারে ভাই। চারপাশে ঘোর অন্ধকার। চাকরি হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এদিকে গ্রামে সংসার অচল। একেকবার মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি।
: চাকরি হবে না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না। আবেগের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও চলবে না। আমি মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এখন টাকা জোগাড় হলেই জার্মানি চলে যাবো।
: জার্মানি গেলে কাজ পাওয়া যাবে?
: যাবে। আমার বন্ধুরা অনেকেই গেছে। তেমন ভালো কাজ নয়, বোঝেনই তো যার যেমন যোগ্যতা। তবে না খেয়ে মরতে হবে না।
গ্রামে ফিরে আসে মামুন।
মাকে বোঝায়, ঢাকা শহরে চাকরি নিলে কয় পয়সাই বা পাওয়া যাবে। ও পয়সায় পাকা দালান বানানো কোনোদিনই সম্ভব হবে না। এর চেয়ে একবার যদি বিদেশে মানে জার্মানি যাওয়া যায় তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। বছর না ঘুরতেই পাকা বাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, সিডি প্লেয়ার।
: বিদেশ যাবি? কিন্তু সে যে মেলা টাকার মামলা।
মায়ের কণ্ঠে সংশয়। মামুন আমতা আমতা করে। তারপর এক সময় ঝপ করে বলে ফেলে,
: আমাদের ওই উত্তর ভিটের জমিটা। ওতে তো ধান হয় না, ওটা বিক্রি করে দাও।
: ধান হয় না কিন্তু সরিষা হয়, মরিচ হয়।
আর বাবা সামান্যই জমি আছে। ওতে হাত দিলে তোর যে আর কিছুই থাকবে না।
: বিদেশ গিয়ে চাকরি করতে পারলে অমন অনেক জমি কিনতে পারবো মা। তুমি ভেবো না।
মায়ের তেমন ইচ্ছা ছিল না।
শুধু জমির জন্য নয়। মামুন তার পেটপোছা ছেলে। ওকে নিয়েই থাকেন তিনি। অন্য দুই ছেলে তো মরে গেলেও খবর নেয় না। মামুনকে বিদেশে পাঠিয়ে একা একা কি করে থাকবেন তিনি।
বয়স হয়েছে। শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। তার সুখে-দুঃখে অসুখে-বিসুখে কে দেখবে তাকে?
বুকটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। দেশে যখন কিছুই হচ্ছে না, বিদেশেই যেতে হবে মামুনকে।
কিছু তো করে খেতে হবে ওকে। এখনই সময়। দেরি হলে সবকিছুতে পিছিয়ে যাবে মামুন। বিয়েতে দেরি হবে, নাতি-পুতি হতে দেরি হবে, বাড়িতে ঘরদোর উঠতে দেরি হবে। এর চেয়ে যেতে যখন মনস্থ করেছে আগেভাগে যাওয়াই ভালো।
সুতরাং জমি বিক্রি হয়। আর এক প্রত্যুষে মায়ের চোখের জলমাখা দোয়ায় সিক্ত হয়ে, পাড়া-প্রতিবেশীর ঈর্ষাতুর দৃষ্টি ডিঙ্গিয়ে গ্রামের আলপথ বেয়ে এসে মামুন ওঠে বড় রাস্তায়। তারপর বাস ধরে ঢাকা। দালালের হাতে টাকা গুনে দিয়ে টিকেট-পাসপোর্ট হাতে নিয়ে নিদারুণ উৎকণ্ঠায় হোটেলে রাত কাটায় মামুন। আজকাল প্রায়ই শোনে, বিদেশে গিয়ে কাজ পাওয়া যায় না।
ভাগ্য ভালো থাকলে ফিরতি প্লেনে দেশে পাঠিয়ে দেয়। নইলে নিয়ে ভরে ফেলে বিদেশের জেলখানায়।
হে খোদা, হে মাবুদ, মামুনের ভাগ্যে যেন তেমন না ঘটে। রাত জেগে আল্লাহকে ডাকতে থাকে মামুন। শেষরাতে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে যাত্রা করে সে।
জার্মানিতে পৌঁছে কাজ পেতে কোনো সমস্যা হয়নি মামুনের। কিনারের চাকরি। দেশে এ চাকরির কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
অভাবি মায়ের সন্তান হলেও সে আদরের দুলাল। চাকরিতে বেতন বড় কম।
এ টাকায় সে নিজে কি খাবে, মাকে দেশে কি পাঠাবে, কি করে হবে দালানকোঠা, ঘরদোর? মামুনের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তার এখন শুধু একটাই চিন্তা, যে কোনো উপায়ে বড়লোক হতে হবে।
যতো দ্রুততম সময়ে সম্ভব বড়লোক হতে হবে। কিনারের কাজের পাশাপাশি এক্সট্রা কিছু কাজ করে মামুন। তাতে হাতে কিছু টাকা আসে।
তিন মাস পেরিয়ে গেছে। মাকে টাকা পাঠাতে হবে। হাতে লাখ দেড়েক টাকা। মামুন টাকা পাঠানোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ খোঁজার জন্য এক সন্ধ্যায় তার এক বন্ধুর বাসায় যায়। বন্ধু অনেক আগে থেকে এ দেশে আছে।
সে জানে সব খোঁজ-খবর। সেখানেই চোখে পড়ে সাপ্তাহিক পত্রিকাটা।
দেশের পত্রিকা দেখে অতিআগ্রহে টেনে নিয়ে উল্টাতে থাকে মামুন। আর পত্রিকার কয়েকটা পাতায় তার চোখ আটকে যায়। লটারির বিজ্ঞাপন।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি খানকায়ে দরগাহ শরিফের নামে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে বলা হয়েছে, যদি কেউ এ নম্বরে হুজুরের সঙ্গে কথা বলে তার দোয়া নেয় তাহলে সে অনায়াসে কোটি টাকার লটারি জিততে পারবে।
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে লটারি জিতেছে এমন কয়েকজন বিদেশি পুরুষ-রমণীর ছবিও ছেপে দেয়া হয়েছে। এমন অনেক খানকায়ে দরগাহ শরিফের বিজ্ঞাপন আছে পত্রিকায়। মামুনের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।
সে দ্রুত দু’চারটি দরগা শরিফের নাম আর মোবাইল নম্বর টুকে নেয়।
বন্ধুর কাছে কি জন্য এসেছিল বেমালুম ভুলে যায় মামুন। সে বন্ধুকে সাত-পাঁচ কিছু একটা বলে দ্রুত নিজের বাসায় ফেরে। আসার পথে এক কোটি টাকা পাওয়ার আশায় একটা লটারির টিকেট কেনে। ফিরে এসেই নম্বর ঘোরায়।
টেলিফোন বাজতে থাকে। ওপাশ থেকে সুরা ভেসে আসে। কেউ ফোন ধরে না। ধরে না। অধৈর্য হয়ে ওঠে মামুন।
আর ঠিক তখনই কেউ ফোন ধরে।
: এটা কি রাজমোহন দরবার শরিফ? আমি জার্মানি থেকে বলছি, হুজুরের সঙ্গে কথা বলবো।
মোবাইল হাতবদল হয়। হুজুরের কণ্ঠ ভেসে আসে। মামুন হুজুরকে মনের কথা বলার আগেই হুজুর বলতে থাকে-
: জানতাম, তুই আমাকে ফোন করবি।
সৃষ্টিকুলের অসংখ্য নরনারী, জিন-পরী আমার ভক্ত। আমার দাদা, বাবা ছিলেন এশিয়া মহাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান আধ্যাত্মিক শিরোমণি। যার কথায় নদীর পানি শুকিয়ে যেতো আর মরা গাছ তাজা হয়ে যেতো।
আমি তার ঔরসজাত সন্তান হিসেবে তোকে বলছি, তুই যখন আমাকে ফোন করেছিস তখন তোর মনের সব আশা-আকাঙ্খা ও মনোবাসনা পূরণ হবে। তুই লটারিতে কয়েক কোটি টাকা পুরস্কার পাবি।
এবার বল তুই আমার কাছে কি চাস?
: হুজুর, আমি একটা লটারির টিকেট কিনেছি, তাতে এক কোটি টাকা পুরস্কারের কথা বলা আছে। আমি এক কোটি টাকা পুরস্কার পেতে চাই।
মামুনের কথা শেষ না হতেই হুজুর তাকে জোর ধমক দিয়ে বললো,
: তুই অবশ্যই লটারির টাকা পাবি। বাবা, তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোর চিন্তা এখন থেকে আমার।
তবে তোর ওপরে শনি ও রাহুর কুপ্রভাব আছে। তোকে তিন নদীর মোহনায় একদামের সাতটি কালো গরু কিনে ভোগ দিতে হবে।
প্রতিটি গরু ২২ হাজার ৫০০ টাকা করে সাতটিতে মোট ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা খরচ করতে হবে। তুই কি এই পরিমাণ টাকা খরচ করতে পারবি?
হুজুরের কথা শুনে মামুনের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় মায়ের জন্য পাঠানোর উদ্দেশ্যে জমানো দেড় লাখ টাকার কথা। আর সাত-আট হাজার টাকা ম্যানেজ করা যাবে।
দুদিন পরেই সে বেতন পাবে। দেড় লাখ টাকা খরচ করে যদি এক কোটি টাকা পাওয়া যায় তাহলে তো বাজিমাত।
: কিন্তু হুজুর আমি জার্মানি থেকে কিভাবে ভোগ দেবো?
: তুই সাতটা কালো গরুর দাম অর্থাৎ ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা আমার নামে পাঠিয়ে দে। আমি তোর হয়ে ভোগ দিয়ে দেবো।
মামুন হুজুরের কথামতো ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা হুজুর অর্থাৎ মোঃ রফিকুল ইসলামের নামে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিল।
টাকা হাতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মামুনকে ফোন করলো হুজুর। বললো,
: মামুন তুই সাত দিন পর পড়ন্ত বিকালে আমাকে ফোন করবি। কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মামুনের সাত দিন যেন আর কাটে না। একেকটি দিন যেন এক যুগ। সাত দিন পর পড়ন্ত বিকালে ফোন করলো মামুন।
হুজুর বললো,
: তুই আগামী সাত দিন নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়বি। আর আমি এই পাঁচটি সংখ্যা দিলাম। লটারি খেলার সময় তুই এই পাঁচটি সংখ্যা কাটবি। অবশ্যই তুই লটারিতে পুরস্কার পাবি।
মামুন নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে।
লটারি পাওয়ার ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত। লটারি পেলে কি কি করবে তার একটা ছকও কেটে ফেলেছে মামুন। সামনে তার উজ্জ্বল আলো ঝলমলে বিলাসী জীবন। লটারির দিন এলো। আত্মবিশ্বাসী মামুন হুজুরের দেয়া পাঁচটি সংখ্যা কেটে লটারি খেললো।
কিন্তু কোনো পুরস্কারই সে পেল না। মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো মামুনের। ইতিমধ্যে তার ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা চলে গেছে। মাকে একটা টাকাও পাঠানো হয়নি। মা কি খেয়ে আছে, না কি উপোস কাটছে তার দিন।
এই ফল পাবে বলে কি সে জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিল। টলতে টলতে ঘরে ফিরে এসে হুজুরকে ফোন করলো মামুন। উত্তেজিত কণ্ঠে জানালো লটারি না পাওয়ার কথা।
হুজুর কিছুণ চুপচাপ থেকে বললো,
: তোর ওপর শনি ও রাহুর কুপ্রভাব কাটেনি। তুই আমার গুরুমার সঙ্গে কথা বল।
ফোন হাতবদল হলো। একটি মহিলার কণ্ঠ ভেসে এলো। মহিলা বললো,
: আমি তোর হুজুরের গুরুমা।
মামুন গুরুমাকে আদ্যোপান্ত সব ঘটনা বলে। লটারি পায়নি- এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে।
গুরুমা বলে,
: তোর কিছু ভুলের কারণে তুই লটারিতে পুরস্কারের টাকা জিততে পারিসনি। এই বৎস, তুই এক কাজ কর। আগামী শনিবার ঠিক ১২টা ১ মিনিটে আমাকে ফোন কর। আমি তোর বিষয়টি নিয়ে ধ্যানে বসে দেখবো কি কি ভুলের কারণে তুই লটারিতে পুরস্কারের টাকা জিততে পারিসনি।
উদ্ভ্রান্ত মামুন গুরুমার কথামতো শনিবার ঠিক ১২টা ১ মিনিটে ফোন করলে হুজুর ফোন ধরে ফোনটা গুরুমাকে দেন।
গুরুমা বলেন,
: আমি তোর বিষয়টা নিয়ে ধ্যান করেছি। তুই টাকা পাঠানোর সময় বাম হাত দিয়ে টাকা গুনেছিলি এবং মনে মনে সন্দেহ করেছিলি লটারির টাকা পাবি কি না। বৎস, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। ওই সন্দেহই তোর কাল হলো।
: আমি এখন কি করবো গুরুমা?
: শোন বাবা, আমি তোর মতো আরো ছয়জনের সমস্যা নিয়ে সাত দিনের মধ্যে ১৪ দিনের জন্য আজমির শরিফে যাবো।
এলমে ফরাজের মাধ্যমে জিন-পরী দ্বারা ভক্তদের মনের আশা পূরণের বাধা দূর করতে ধ্যানে বসবো।
তুই যদি কামিয়াবি হতে চাস, সত্যিই যদি তুই আমাকে গুরুমা মনে করে থাকিস তাহলে আগামী তিন দিনের মধ্যে আজমির শরিফে আমার একটা এতিমখানা আছে, সেখানে ৩৭৫ জন এতিম আছে। তুই সেই এতিমদের ১৪ দিনের খাবার খরচ বাবদ ২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা পাঠাবি।
বল, তুই এই খরচ পাঠাবি? যদি তুই এই খরচ পাঠাস তাহলে নিশ্চিত কোটি টাকার লটারি জিতবি। তাছাড়া যদি এতিমদের জন্য এই সামান্য টাকা পাঠাস তাহলে তোর জীবনের গুনাহর খাতা মাফ হয়ে যাবে।
তোর মনের সব বাসনা পূরণ হবে।
এতো টাকা মামুন কোথায় পাবে? কিন্তু টাকা না পাঠালে যে আগের টাকাগুলোও মার যাবে। তাছাড়া কোটি টাকার লটারির হাতছানি। মামুন বন্ধুদের কাছে ধার-দেনা করে গুরুমাকে টাকা পাঠায়। টাকা হাতে পেয়েই মামুনকে ফোন করে গুরুমা।
: মামুন তুই আমার সন্তান। তোর কোনো চিন্তা নেই। আজ থেকে তোর সব চিন্তা আমার। আগামী ১৫ দিনের দিন তুই আমাকে ফোন করবি।
তাই করে মামুন।
গুরুমা হুজুরের মতোই তাকে পাঁচটি নম্বর দেন। বলেন,
: লটারির ড্রর দিন এ পাঁচটি নম্বর কাটবি। তুই অবশ্যই লটারিতে পুরস্কারের এক কোটি টাকা পাবি।
পরপর তিনবার লটারি খেলে মামুন কিন্তু কোনো পুরস্কারই পায় না। দিশেহারা মামুন বারবার ফোন করে গুরুমাকে।
গুরুমা বলেন,
: কে তুই বাবা? তোকে তো চিনলাম না।
কখনো বলে, রং নাম্বার।
মরিয়া মামুন হুজুর রফিকুল ইসলামকে ফোন করে।
: কে তুই? কি চাস?
: আমি জার্মানি থেকে মামুন বলছি। আমি আবার লটারি খেলতে চাই।
আমি গুরুমার সঙ্গে কথা বলবো।
হুজুর গুরুমাকে ফোন দেন। মামুন তার অনেক কষ্টে উপার্জিত টাকা পাঠানোর কথা বলে। বলে, গুরুমা, আমার টাকাগুলো ফেরত দিন।
গুরুমা মামুনের কথা শুনে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে এবং বলে, তুই যদি টাকা ফেরত চাস তাহলে তুই ধ্বংস হয়ে যাবি, তোর বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে।
এছাড়া বিভিন্ন রকম হুমকি দিতে থাকে গুরুমা।
মামুন এখন কি করবে! উদ্ভ্রান্ত মামুন বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে। বন্ধুরা তাকে দেশে গিয়ে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করতে বলে। বন্ধুদের সহযোগিতায় দেশে ফিরে আসে মামুন। দেশে ফিরে প্রথমেই সে সাপ্তাহিক রূপসী কেনে।
যে সংখ্যায় লটারির বিজ্ঞাপন দেখেছিল সে সংখ্যা দেখে হাঁ হয়ে যায়।
কোথায় সেই বিজ্ঞাপন, কোথায় হুজুরের ঠিকানা। দেশের ম্যাগাজিন আর বিদেশে পাঠানো ম্যাগাজিন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। একই সংখ্যার ম্যাগাজিনে একটার মধ্যে প্রতি পাতায় বিজ্ঞাপন, অন্যটার মধ্যে কোনো বিজ্ঞাপনই নেই।
মামুন বুঝতে পারে, সে বড় ধরনের কোনো প্রতারকের পাল্লায় পড়েছে।
সে রাজমোহন দরবার শরিফের ফোন নাম্বারে ফোন করে। দরবার শরিফের ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কয়েক দিন পরে একটা লোক ফোন ধরে বলে, আপনি কাকে চান?
মামুন তাকে অত্যন্ত অনুনয় করে নাম জানতে চাইলো আর জানতে চাইলো ঠিকানা। লোকটা যেন কি মনে করে মামুনকে বললো তার নাম ফারুক, ঠিকানা দিল। মামুন দেরি না করে চলে গেল সেই ঠিকানায়।
সাত-পাঁচ না ভেবেই বললো, আমি হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ফারুক মামুনকে রিসেপশনে বসিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেল। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে বললো,
: হুজুর ভেতরের রুমে ধ্যানে আছেন। এখন হুজুর কারো সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। ৩১ মিনিট পর কথা বলা যাবে।
মামুন অপোয় থাকে। ৩১ মিনিট পর হুজুরের ঘরে ঢুকে দেখে মাথায় বড় বড় চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা চার-পাঁচজন লোক সুন্দর কিন শেভ করা একটা লোককে ঘিরে বসে বিদেশি মদ খাচ্ছে।
লোকটার পাশে ১৮-২০ বছরের সুন্দরী একটা মেয়ে বসা। সে মদ ঢেলে দিচ্ছে আর সবাই মদ খাচ্ছে। মামুনকে দেখে সুন্দরী মেয়েটা বললো,
: এখানে কেন এসেছেন? নিন, মদ খান।
: আমি মদ খাই না। আমি রাজমোহন দরবার শরিফের হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
মাঝে বসা কিন শেভের লোকটা মোটা গলায় বললো,
: আমিই হুজুর। নে, মদ খা। আর কি বলবি বল।
মামুন তখন লটারি সংক্রান্ত সব কথা বলে টাকা ফেরত চায়। একযোগে চিৎকার করে ওঠে সবাই।
: কিসের টাকা? তুই আমার নামে কোনো টাকা পাঠাসনি। আমি জার্মানি থেকে মামুন নামে কোনো লোকের কাছ থেকে টাকা পাইনি।
মামুন তখন রফিকুল ইসলামের নামে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে পাঠানো টাকার কাগজ দেখালে মাস্তান ধরনের চার-পাঁচজন লোক মামুনের হাত থেকে কাগজগুলো ছিনিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।
তারা মামুনকে হুমকি দিতে থাকে, যদি সে তাৎণিকভাবে ওখান থেকে চলে না যায় তাহলে তাকে মেরে রক্তাক্ত করে পুলিশে ধরিয়ে দেবে।
হুজুর বলতে থাকে,
: এখনই চলে যা। নইলে জানে মেরে ফেলবো। তারপর হেসে বলে, অবশ্য একটু বসলে থানার ওসি সাহেব এসে তোকে জামাই আদরে নিয়ে যাবে। মামুন প্রাণভয়ে তাৎণিকভাবে বেরিয়ে আসে।
শুধু বেরুনোর সময় ফারুককে বলে, ভাই তোমার সঙ্গে কথা আছে।
পরে একদিন জীবন হাতে নিয়ে হুজুরের দরবার শরিফে গিয়েছিল মামুন। জেনেছিল থানা-পুলিশ সবই হুজুরের করতলগত। প্রতারণার মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়েছে হুজুর। একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, সুন্দরী রমণী আর অঢেল টাকার মালিক এ হুজুর।
প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারণার ব্যবসা। শুধু মাঝখান থেকে নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে মামুনের মতো গরিব ঘরের ছেলেরা। মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে মামুন। খালি হাতে। রিক্ত, নিঃস্ব সর্বহারা মামুন।
একটা দালানের বড় শখ ছিল মায়ের। দালান না হোক টিনের ছাউনি দেয়া একটা ঘর মাকে সে দিতে পারতো। কিন্তু সর্বনেশে লটারির নেশায় কি থেকে কি হয়ে গেল। মামুন এখন কার কাছে বিচার চাইবে?
থানা, পুলিশ প্রশাসন যাদের হাতের মুঠোয় তাদের বিচার কে করবে? মামুন এখন শুধু একটা কাজ করতে পারে। মায়ের ছেঁড়া আঁচলের আড়ালে ঢাকা বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে অবোধ শিশুর মতো ডুকরে ডুকরে কাঁদতে পারে।
তাতেই যে মামুনের শান্তি। মা, মাগো তোমার অযোগ্য ছেলেটাকে বুকে একটু আশ্রয় দাও মা।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।