চলে যেতে যেতে বলে যাওয়া কিছু কথা
অরক্ষিত অবস্থায় বগা মাহমুদ রাস্তায় খুব একটা বেরোয় না।
কটকটে এই দুপুর বেলায় বেরিয়েছে সে রাস্তার ওপার থেকে সিগারেট কিনবে বলে।
"বাবা একটু রাস্তাটা পার করে দিবে?'
পাশের বৃদ্ধ লোকটির দিকে ভাল করে তাকায় বগা মাহমুদ। হাতে সাদা ছড়ি।
অনীহা সত্তেও অন্ধ লোকটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় বগা মাহমুদ।
সাধারন মানুষজনের সংষ্পর্শে আসার আগ্রহ তার একেবারেই নেই। বৃদ্ধের হাত ধরে সযত্নে রাস্তা পেরোয় সে।
"আমার নাতীটা অসুস্থ, সবসময় ওর হাত ধরেই রাস্তা পেরোই আমি। "
ধন্যবাদ জানিয়ে বৃদ্ধ কথা কয়টি বলেন। কন্ঠের আন্তরিকতার সুরটি বগা মাহমুদকে ছুয়ে যায়।
"আবার ফেরবেন কখন" কোন কিছু না ভেবেই শুধায় বগা মাহমুদ।
"একটা বাচ্চাকে ঘন্টা খানেকের জন্য পড়াবো তারপর এই পথ ধরেই বাসায় ফিরব"
সিগারেট কিনতে কিনতই ভাবান্তর ঘটে নির্মম নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ বগা মাহমুদের মনে। পাশের একটা চায়ের দোকানে পা বাড়ায় সে। চায়ের অর্ডার দিয়ে এমন একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে যেখান থেকে রাস্তার সবটুকুনই দেখা যায়। আশেপাশের সাধারন মানুষজনের মাঝে বসে থাকতে স্বাছ্যন্দবোধ না করলেও মনের জোর খাটিয়ে ঠায় বসে থাকে সে।
ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ করেই তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ায় সে । দৌড়ায় রাস্তার দিকে। ততক্ষনে ছড়ি হাতে বৃদ্ধ অন্ধ লোকটি রাস্তার পাশে এসে দাড়িয়েছেন।
আবার হাত বাড়িয়ে দেয় বগা মাহমুদ। রাস্তা পেরোতে সাহায্য করে বৃদ্ধ লোকটিকে।
"বাবা তুমি আমার জন্য এতক্ষন অপেক্ষা করছিলে, রাস্তা পার করে দিবে বলে?"
কিছু উত্তর না দিয়ে সুবোধ বালকের মত চুপ করে থাকে বগা মাহমুদ।
"বাবা তোমার মনটা খুব সুন্দর এবং ভাল, শুধু তোমার জন্য নয় যে ভাগ্যবান বাবামা তোমায় জন্ম দিয়েছেন তাদের জন্যও মন থেকে দোয়া করছি। "
অন্ধ লোকটি ধীর পায়ে হাটা ধরেন গন্তব্যের দিকে। আর নির্বাক বগা মাহমুদ নির্বাক ঠায় রাস্তার উপর দাড়িয়ে থাকে।
নিজের ফ্লাটের বারান্দায় বসে উদাস মনে দুরে আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে বসে থাকে বগা মাহমুদ।
দশ বছর আগে অন্ধকার অপরাধ জগতে পা ফেলার পর, সে কখনো এতটা বিচলিতবোধ করেনি। তার বাবা আর মা দু:খ আর গ্লানি সইতে না পেরে অভিমানে যখন পৃথীবি ছেড়ে বিদায় নেন তখনও না। একমাত্র সন্তানের অধো:গতিতে তাদের বাচার সব আশা আকাংখা ধুলায় মিশে গিয়েছিল। সারাটি জীবন বাবা মার কষ্টের কারন হয়েই ছিল সে।
মোবাইল ফোন দুবার বেজেই থেমে যায়।
ওর লোকজনেরা আসছে। ধীর পায়ে এগোয় সে দরজার দিকে। ঘন্টাখানেক পর ওদেরকে যখন ও বিদেয় করে ক্লান্তি আর অবসাদে ভেংগে আসছে তার মন এবং শরীর দুটোই। কয়টাদিন ঝামেলায় জড়াতে চায়নি সে। তার সাংগোপাংগোরা চেপে বসেছে কালকের এসাইনমেন্টে তার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন।
নয়ত এলাকার কর্তৃত্ব অন্য দলের কাছে চলে যাবে।
পরেরদিন দুপুরবেলায় একটা মাইক্রো এসে থামে বগা মাহমুদের বাসার সামনে।
গাড়ীতে চড়ে বসে সে গা এলিয়ে দেয় পেছনের একটা আসনে। তাকে দেখে মনে হয় বিকারহীন। খুবই ব্যতিক্রম এটি।
এমনতি যেকোন অভিযানে সে খুবই উদ্দীপ্ত থাকে।
গাড়ী কিছুদুর এগোলে হঠাৎ করেই সামনের একটি গাড়ী বিকট শব্দে ব্রেক কষে। সামনে হূমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। তারপর মানুষের হৈচৈ। জানালা গলে মাথা বের করে বগা মাহমুদ।
কেউ একজন গাড়ী চাপা পড়েছে। একটু সামনেই ছোপ ছোপ রক্ত। ভাল করে তাকাতেই চোখে পড়ে তার সাদা একটি ছড়ি। লাফ দিয়ে গাড়ী থেকে নামে সে। দৌড়ায় সামনের দুর্ঘটনার জায়গাটি লক্ষ্য করে।
বৃদ্ধ অন্ধ মানুষটি রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছেন। ঝুকে পড়ে দুহাতে আকড়ে ধরে তাকে বগা মাহমুদ। কানপাতে বুকের কাছে। এখনও বেচে আছেন তিনি। এমনকি ঠোট নাড়তে দেখে তাকে সে।
কান নিয়ে আসে মুখের কাছে। "বাবা আমাকে শক্ত করে ধরে রাখ" বৃদ্ধকে অস্ফুট উচ্চারনে বলতে শুনে সে কথা কয়টি। সময় নষ্ট না করে বৃদ্ধকে দুহাতে কোলে তুলে দৌড়ায় মাইক্রোর দিকে। তারপর গাড়ী ছুটে চলে হাসপাতালের দিকে। বৃদ্ধের মাথাটি কোলের উপর চেপে বসে থাকে বগা মাহমুদ।
তার দুচোখ বেয়ে অঝোড়ে ধারায় নেমে আসছে চোখের জল। একযুগ পরে কাদছে সে, তাও একজন অজানা অচেনা মানুষের জন্য। যে গাড়ীটি যাত্রা শুরু করেছিল কারো প্রান হরনের উদ্দ্যশে তাই এখন ছুটে চলেছে একজনের প্রান বাচাতে।
পরেরদিন যখন কবর দেয়া হয় বৃদ্ধলোকটিকে, বগা মাহমুদও তাতে অংশগ্রহন করে। পাশাপাশি নিজের পংকিলময় অতীত জীবনটিরও কবর দিয়ে আসে সে।
মনস্থির করে ফেলে সে আর কোন পাপকর্মে নিজেকে জড়াবে না সে।
কিন্তু তার অতীত জীবন তাকে নিষ্কৃতি দিবে কিনা সে ব্যপারে যদিও সে নিশ্চিত নয়।
(রিপোষ্ট)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।