রাজনৈতিক দখলের দক্ষিণ দরজা
ফকির ইলিয়াস
=========================================
বাংলাদেশে একটি দখলের দক্ষিণ দরজা খুলতে চেয়েছিল তৎকালীন জোট সরকার। তাদের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা। একদিকে ‘হাওয়া ভবন’ আর অন্যদিকে ‘গণভবন’ দুটিই ছিল তাদের দখলে। ইচ্ছে ছিল একটি রাজকীয় লেফাফা নিয়ে তারা শাসন করবে বাংলাদেশ। তারেক রহমান ও তার সহযোগীরা বাংলাদেশে কেমন শাসন কায়েম করতে চেয়েছিলেন তা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে।
পত্রিকায় দেখলাম রাহুল গান্ধী তার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের খরচ নিজেই বহন করেছেন। রাহুলের দল এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র। রাহুল চাইলেও তো তার সব সফরের খরচ রাষ্ট্রের ওপর ফেলে দিতে পারতেন। না, তিনি তা করেননি।
কারণ রাহুল গান্ধী চান না, তার ব্যক্তিগত কাজে রাষ্ট্রের অর্থ খরচ হোক। এটাই হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি রাজনৈতিক সম্মান।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেউ ভোটে জিতে ক্ষমতায় গেলেই কি রাষ্ট্রের কোষাগার তার ব্যক্তিগত হয়ে যায়? বিশ্বে এমন নজির খুব কম। যারা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি করে শুধু তারাই পারে ঢাল হিসেবে ‘খাম্বা প্রকল্প’ তৈরি করে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করতে। বাংলাদেশে যারা রাজনীতির সদর অন্দর দেখেন তাদের অনেকের কথাই মাঝে মাঝে আমাকে হাসায়।
ভেবে অবাক হই; বিদেশে এসেও তারা বাংলাদেশের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির পক্ষে সাফাই গেয়ে বেড়ান। নিউইয়র্কে থাকি বলে এমন অনেক নেতার কথা শুনতে হয় আমার মতো অনেক প্রবাসীকে প্রায় প্রতি মাসেই। সম্প্রতি তেমনি একজন ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে এসে নানা কথা বলেছেন। তিনি মোখলেসুর রহমান চৌধুরী। রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মদের সাবেক প্রেস সচিব।
এটা দেশবাসীর জানা, মোখলেসুর রহমান চৌধুরী দৈনিক দিনকাল পত্রিকার কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলেন। খালেদা জিয়ার তনয় তারেক রহমানের মালিকানায় এই পত্রিকার সেই রিপোর্টারকে বিশেষ উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। সবই ছিল হাওয়া ভবনের ছকে সাজানো-গুছানো। প্রেস সচিব করার মাধ্যমে একটি খুঁটির জোর বাড়িয়েছিল হাওয়া ভবন।
এই প্রেস সচিবকে পরে দ্রুত পদোন্নতিও দিয়েছিলেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি। কেন তিনি করেছিলেন এটা? এর সব কিছুই এখনো রহস্যাবৃত। ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনের মাধ্যমে মোখলেসুর রহমান চৌধুরীর পতন ঘটে। সেই মোখলেস নিউইয়র্কে ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ বির"দ্ধে খুব কটূক্তি করে বেড়াচ্ছেন। তিনি বেশ কটি সমাবেশে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেন ইজ নাথিং’।
তার বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে তিনি পারলে বর্তমান পুরো সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতেন? কেন তার এই ক্ষোভ? বাংলাদেশে এতো জ্ঞানী-গুণী মেধাবী সাংবাদিক থাকার পরও তার মতো জুনিয়র একজন সাংবাদিককে কেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব করা হয়েছিল? কি ছিল নেপথ্য উদ্দেশ্য? আমি বাংলাদেশের সাংবাদিককুলের কাছে বিনীত প্রশ্ন রাখতে চাই -আসলেই কী তার রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হওয়ার মতো কোনো যোগ্যতা ছিল? নাকি হাওয়া ভবনের ‘একান্ত অনুগত’ বলে?
মোখলেস চৌধুরীর মতো ক্ষোভ আছে আরো অনেকেরই। যারা বাংলাদেশকে একটা পারিবারিক রাজতন্ত্রের দক্ষিণ দরজা বানাতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সিটি ও পৌর নির্বাচনে চার দলীয় জোটের চরম ভরাডুবির পর বিএনপি নেতা খন্দকার দেলওয়ারের বক্তব্যটুকু দেখুন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।
মোট কথা বিএনপি ক্রমশ নির্বাচন থেকে দূরে সরার ফন্দিফিকির করছে। কারণ তাদের সাজানো খেলা ব্যর্থ হয়েছে। সিটি ও পৌর নির্বাচনে বিএনপি-জামাতের তৃণমূল নেতারা অংশ নিয়েছে। কিন্তু ভোটের রায়ে তারা চতুর্থ, পঞ্চম হয়েছে। কোনো কোনো সিটি ও পৌর এলাকায় তাদের কিছু কাউন্সিলর পাসও করেছে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে জোট সরকারের ধ্বজাধারীরা জনগণের আস্থা থেকে দূরে সরে গেছে অনেক। জনগণ এদের নামটি পর্যন্ত শুনতে চাননি। বাংলাদেশ এমন কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, যেখানে নেতার বিকল্প নেতা তৈরি করা খুব সহজ কাজ। এ কাজটি খুবই দুঃসাধ্য। তারপরও জনগণ প্রকৃত দুর্নীতিবাজদেরকে চিহ্নিত করতে পারেন, এই দূরদৃষ্টি তাদের রয়েছে।
দখলের দক্ষিণ দরজা তারা এভাবেই ভেঙে দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন একদিন। সেই দক্ষিণপন্থী প্রেতাত্মারা সুযোগ পেলেই পাখনা মেলে বাংলার আকাশে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই , ওয়ান-ইলেভেন এ দেশে একটি স্থায়ী সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠার নীল নকশা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অতীতেও নির্বাচনের আগে আধাসামরিক বাহিনী মাঠে ছিল। তাহলে এখন জরুরি অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে তেমন অসুবিধা কোথায়? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও লালনের জন্য কিছু ছাড় তো দিতেই হয়।
----------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ । ১০ আগষ্ট ২০০৮ রোববার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।