এক বন্ধুর ভাগ্য বিপর্যয়ের গল্প শুনুন। ছুটির দিনে বাসায় বসে সাত-সতেরো ভাবছিলাম। হঠাৎ সেই বন্ধুটির ফোন-‘তুই কোথায় ? এখনি জাভেদ চত্বরে চলে আয়। ’বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে কলাভবনের উল্টো দিকের গেটকে নাম দিয়েছিলাম ‘জাভেদ চত্বর। ’ সেই জাভেদ এখনও বসত করে আমার বল্পব্দুভাগ্যের ঝুলিতে।
তাই স্মৃতির ভাঁড়ারে রেখে আসা জায়গাটি ফের রোমন্থনের সুযোগ নষ্ট করতে চাইলাম না। বিধায়,ছয় নম্বরের পা দানিতে ঝুলে, দে ছুট। গিয়ে দেখি চোখে দুশ্চিন্তার কাজল মেখে বন্ধুটি বসে আছে। ভাবেই বুঝলাম,ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। জিজ্ঞেস করতেই সে হেঁচকি মেরে উঠলো-‘আর বলিস না।
বাসায় কাজের ছেলেটাকে নিয়ে খুব বিপদে আছি। আমি আটটা-পাঁচটা অফিস করি। তোর ভাবী একা বাসায় থাকে। সে বাথরুমে গেলেই দরজার ফুটোয় তাকিয়ে থাকে কাজের ছেলেটি !’ চোখ কপালে তুলে বললাম-‘সে কি ! ছেলেটার বয়স তো মাত্র বারো বছর। ’চোখে একরাশ হতাশা নিয়ে বন্ধুটি বললো‘বোঝ তাহলে।
’
হতভাগ্য বল্পব্দুটিকে কৌতুক করে বলতে পারিনি-‘দরজার ফুটোয় চুইংগামের আঠা মার,কিংবা অকাল পক্ককে দু ঘা দিয়ে বিদায় কর। ’ছেলেটির হাতে গাঁটছড়া বেঁধে দিলেই কি সমস্যার সমাধা হয়ে যেত ? তার জবাব পেয়েছি সেদিন রাতেই,বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। রাত বারোটা পর্যন্ত স্মৃতির জাবর কাটার পর দুজন সিদ্ধান্ত নেই, মিতালি রেষ্টুরেন্টে একবার যাওয়া দরকার। কালাভুনার স্বাদটা চেখে দেখা হয়না অনেকদিন। তাই রসনার অভাব মিটিয়ে আমরা ফের রিকশা নিলাম রাজু চত্বরের পানে।
তখন রাত প্রায় একটা। দোয়েল চত্বর দিয়ে পরমানু শক্তি কমিশনের সামনে আসতেই দেখলাম কিছু রিকশার ভিড়। পাশের ফুটপাতেই ২০/৩০ টাকা মজুরীতে চলছে দেহবিক্রির আদিম সুখ-সম্ভোগ। রিকশাওয়ালারাই সেসবের মুল ভোক্তা। কিন্তু বিষ্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো যখন দেখলাম-‘কর্মযজ্ঞটির পাশে দাঁড়িয়ে ছটফট করছেন এক দাঁড়িওয়ালা চাচা।
শতচ্ছিন্ন লুঙ্গির ভেতরে কর্মব্যস্ত সময় পার করছিল তার বাঁ হাত (মাফ করবেন)।
আড়চোখে বন্ধুটির দিকে তাকাতেই সে মনের কথা বুঝে নিল। তারপর বললো‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে। ’ আমি বললাম,‘ঢেঁকির বয়স কোন সমস্যা নয়। ’
জানোয়ারদের প্রসববেদনা মেনে জন্ম হলেও জন্তু থেকে মানুষ হওয়ার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে দো-পেয়ে সমাজ।
কিন্তু মনুষ্যত্বের লেবাস তো লাগেইনি, উল্টো জন্তু থাকার যে কয়েকটা প্রাথমিক শর্ত সেগুলোও হারাতে বসেছি। তার মধ্যে একটা বড় জিনিস হল নিজের শরীরটার স্বীকৃতি। এখন যা বয়স তাতে রাস্তায় মেয়ে দেখাটা খুবই গা ঘিনঘিনে বিষয়। তারপরও দেখে যাই আর দশজনের মতো বেহায়া চোখে। শুধু মেয়েই দেখি না ছেলেদেরও দেখি।
তারা সবাই একরকম। সবারই প্যান্টালুন,পাতলুন,প্রসাধন, জিম, প্রায় একই রকম। ভুল বাংলা ও ইংরেজি তাদের মুখে সমানে খৈ হয়ে ফুটছে। খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ সচরাচর ঘটে না, তবে কাছে গেলে টের পাই তাদের শরীরের গল্পব্দরাজিতেও কোন পার্থক্য নেই। মনের মধ্যে তখন খুব অস্থির লাগে, কারণ কারোর শরীরকে ভালোবাসার একটা বড় শর্ত হলো তার শরীরের গন্ধকেও ভালোবাসা।
আমাদের সভ্যতা আবার লাজ-লজ্জার ভয়ে এই গল্পব্দগুলো গোপনফাইলে বন্দি রেখেছে। অফিস ফেরত জামাইয়ের জামার গন্ধ একটু শুঁকে রাখা যে রাতের আহ্লাদ প্রস্তুতিকে সাহায্য করতে পারে কিংবা স্ত্রীর শরীরের গোপন ভাঁজের তীব্র গন্ধ যে তার বাইরের ‘বৌমাসুলভ’ সুসভ্য চেহারা পেরিয়ে এক অন্য অবিস্মরণীয় আদিমতার সন্ধান দিতে পারে, এই সব কথা নিয়ে ভাবাও এখন পাপের সমতুল্য।
দয়া করে ভাববেন না আমি জন সমাজে খারাপ গন্ধের ক্যানভাস করছি। ভিড় বাসে মাথায় সরষের তেল মাখা উদাসীন মহিলার পাশে বাধ্যতামূলক ভাবে চেপটে থাকার কষ্ট আমি জানি। আমি জানি লম্বা লোকের বগলে নাক গুঁজে ছয় নম্বর বাসে বাড্ডা থেকে ফার্মগেট যাওয়ার দুঃখ।
সন্তানকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে গিয়ে কোন উর্বশীর ফিনফিনে জামার তলে রঙ্গীন ‘চশমা’ দেখার যন্ত্রনাও আমার অজানা নয়। গরিব মানুষের অন্যতম প্রধান পরিচয় তার দারিদ্রের গন্ধ। গরীবের গোসল জলে স্যাভলন কিংবা স্যান্ডালিনার অভাব তার বড় কারণ হতে পারে। আবার, পাগলদের গায়ের পোশাকে লাগা বহু দিনের জলবিয়োগ, কিংবা তাদের মুখের দুর্গন্ধ দুনিয়ার সব জায়গাতেই একইরকম। কাওরান বাজারের ফুটপাত থেকে নিউইয়র্কের রাস্তা পর্যন্ত এসবে কোনও তফাৎ নেই।
দুর্গন্ধের ফলে আর সবার মতো আমারো ‘শোকাহত’ ভাব হয়। কিন্তু আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। এক তো, আমাদের সমাজ শরীরটাকে লুকিয়ে রেখে সন্তান উৎপাদনের বাইরে সব রকমের আহ্লাদকে নোংরা বলে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তার ওপর আমাদের নিজেদের গন্ধকেও বাজারে চলতি চরিত্রহীন ব্র্যান্ডের গন্ধে ঢাকতে প্রলোভিত করছে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে,প্রেম-ভালোবাসা, আকর্ষণ ক্রমশ লোক থেকে লোকে অতি সহজেই ‘বিনিময় যোগ্য’ পণ্য হয়ে উঠছে।
অবশ্য এমন না হওয়ার কোন কারণও নেই।
বইয়ে পড়েছি, বাঘ না বাঘিনী নাকি কাম হলে গায়ে নিজের মেখে গন্ধ রেখে আসে। তার টার্গেটটি সেই গন্ধ শুঁকে তার কাছে পৌঁছায়। এখন আপনি যদি অ্যাক্সি,ওল্ডস্পাইস,জাতক বা জভেন সেক্স অ্যাপিলের মতো কিছু একটা মেখে আসেন, তখন সেটা শুঁকে আপনার টার্গেট আপনাকে চিনবে কীভাবে? বাজারে তো হাজার হাজার অ্যাক্সিওয়ালা বাঘ-বাঘিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওল্ড স্পাইসও কম নেই। মুখে কৌতুকের হাসি এঁকে বলবেন, ‘সমস্যা কি ? তাদের যে কোনও একজনকে চাটলেই হল।
’ কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করবেন না-‘সমস্ত ব্যাপারেই ধীরে ধীরে আমরা নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছি। ’
ইদানিং শুনছি হালের প্রজন্মের কাছে বিছানার ক্রিয়া-কর্মটি একটি ফালতু ব্যাপার। হতেই পারে। আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি তো আর প্লে-বয়ের মালিক নই, যে এই শুনে ব্যবসা-পাতি লাটে উঠবে।
কেউ কোনকিছুর নিন্দে করলেই গায়ে চুলকানি ওঠে না,তবে শুধু একটা কথাই মনে হয়, ‘আরে বুঝলাম খারাপ, তা ওটা ফেলে এখন তুই কী করছিস। ’
করার মধ্যে যেটুকু দেখছি তা হলো, হালের প্রজন্ম টক-টাইম, ডাউন লোড,ব্লাকবেরির কী মেসেজ সার্ভিস না কী, তারপর নতুন কী সব আই প্যাড আর ট্যাবলেট এই সব নিয়ে পড়ে আছে। এই ট্যাবলেটই নাকি এখনকার সময়ে যৌন হাভাতেপনার একেবারে অব্যর্থ নিরোধক। খুব ভালো কথা। শুনি আর মুচকি মুচকি হাসি।
এই যদি আগামী পৃথীবির চেহারা হয় তবে আমি যে দু সেকেন্ড থেকে বড় জোর দশ বছরের মধ্যে এই পৃথীবি ছেড়ে চলে যাব, তাতে আমার আর কোনও দুঃখ নেই। এই শিশুদের জন্য বাসযোগ্য ভূমি তৈরির কোন উৎসাহও আমার নেই।
এখন চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। প্রথম যৌবনের ইচ্ছেঘুড়িও কাটা পড়েছে। শুধু রয়ে গেছে কিছু টাটকা স্মৃতির ফসিল।
আজরাইল কড়া নাড়ার আগ পর্যন্ত তা টিকে থাকবে এবং ডুকরে কেঁদে কেঁদে বলবে-দাও ফিরিয়ে সেই নীল-সাদা ফ্রকের হাওয়া, লহ এ ট্যাবলেট। দাও ফিরিয়ে শরীরকে না বোঝার সেই দিনগুলো। সেই বিকেলে ছাদের কোনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা, যখন সে ফিরবে স্কুল থেকে। সাদা জামা। নীল স্কার্ট।
আমাকে সে চেনে না। আমি যে রোজ মুদি দোকানের সামনে কেঠো টুল পেতে তার জন্যে বসে থাকি, সে জানে না। বাতাস তাকে ঠেলে। স্কার্টের অদৃশ্য পেন্সিলে তার অবয়বের রূপরেখা জ্বলে। আমার চোখ ওঠে তার লাউ ডগা পা বেয়ে, হারিয়ে যায় নীলচে সর্বনাশের ঘেরে।
সেখানেই তো আকাশের শুরু। তার ওপরে সাদা জামার মেঘ। পরিষ্কার বুঝতে পারি সম্পুর্ন নতুন একটি গন্ধ জাগছে আমার গায়ে। নিজেকে তখন বাঘের মত লাগে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।