আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত বিজিএমইএ

তাজরীন ফ্যাশনসে গত নভেম্বর মাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছিল তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ভবন পরিদর্শনের জন্য গঠন করা হয়েছিল একটি টাস্কফোর্সও। ঢাকঢোল পিটিয়ে, সাংবাদিক ডেকে মাত্র চারটি কারখানা পরিদর্শন করেই শেষ হয়ে যায় সেই টাস্কফোর্সের কাজ। সবার আশঙ্কা, এবার সাভারে ভবনধসের ক্ষেত্রেও তাই হবে।
বড় কোনো ঘটনা ঘটলে বিজিএমইএর অধিকাংশ কার্যক্রমই হয়ে যায় মূলত লোক দেখানো।

নানা দিক থেকে চাপ আসে বলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পছন্দের কিছু শ্রমিকনেতাকে ডেকে আনা হয় সমিতির কার্যালয়ে। আসেন সরকারের মন্ত্রী ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদেরা। যৌথ ঘোষণা তৈরি হয়। সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি, টাস্কফোর্স ও কমিটি গঠন করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হন মালিক নেতরা।


কয়েক দিন পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। বিজিএমইএ এবং সরকারের তৎপরতাও অন্তরালে চলে যায়। নতুন ঘটনা ঘটলে আবারও দেখা যায় একই চিত্র। এর মধ্যেই পার পেয়ে যান দায়ী পোশাকমালিকেরা।
এসব পদক্ষেপ ও কর্মসূচি নেওয়া হয় মূলত নিজেদের রক্ষার জন্য।

কেননা, বিদেশে অর্থাৎ বিদেশি ক্রেতারা ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েন। রপ্তানি কমার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই চাপ থেকে রক্ষা পাওয়াই হয়ে পড়ে বিজিএমইএর মূল কাজ।
টাস্কফোর্স কাহিনি: ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। এরপর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ দেখার জন্য বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

সে সময় বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, পর্যায়ক্রমে সব কারখানায় যাবেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। অগ্নিকাণ্ডের কারণ চিহ্নিত করে সুপারিশ করবেন। পোশাকমালিকদের সেই সব সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেওয়া হবে। বলা হয়েছিল, এতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক হয়েছিলেন বিজিএমইএর তৎকালীন সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।

তিনি সে সময় বলেছিলেন, পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হিসেবে ১০টি কারখানা পরিদর্শন করবেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। তারপর একটা মানদণ্ড নির্ধারণ করা হবে। সেই মানদণ্ড অনুসারে বাকি কারখানাগুলো পরিদর্শন করে যেখানে যতটুকু ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করা হবে। তারপর সময় নির্ধারণ করে কর্মপরিবেশের মান নিশ্চিত করা হবে সব পোশাক কারখানায়।
কর্মযজ্ঞ দেখাতে গত ২৩ ডিসেম্বর গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট বা শ্রমিকদের কর্মপরিবেশসম্পন্ন চারটি কারখানা পরিদর্শন করেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।

বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক কিছু সুপারিশও করেছিলেন তাঁরা। তারপর আরও চার মাস চলে গেলেও সেই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি।
যদিও এর মধ্যে বিজিএমইএর নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু কাজের ধারা একই রকম আছে। গত বৃহস্পতিবার সাভার বিপর্যয়ের পর অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির নতুন সহসভাপতি রিয়াজ-বিন-মাহমুদ বলেন, ‘১০টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। তবে আমরা এখনো প্রশ্নমালা নির্ধারণ করতে পারি নাই।


১০টির কথা বলা হলেও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে, টাস্কফোর্স চারটি ছাড়া আর কোনো কারখানা পরিদর্শন করেনি। এ বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে আর কোনো বৈঠকও হয়নি। টাস্কফোর্সের প্রাথমিক সদস্য ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষক দিনমনি শর্মা। তিনি প্রথম দিনের পরিদর্শন দলেও ছিলেন। গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলোকে দিনমনি শর্ম বলেছিলেন, ‘আমরা প্রস্তুত ছিলাম।

কিন্তু প্রথম দিনের পর বিজিএমইএ আমাদের আর ডাকেনি। ’ একই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গত রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম দিনের পর আর কোনো কারখানা পরিদর্শন করা হয়নি। আর এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। ’
টাস্কফোর্সে থাকা বুয়েট অ্যালামনাইয়ের প্রতিনিধি স্থপতি শাহ আলম জহির উদ্দিনও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম, ১০টি কারখানা পরিদর্শন করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেব।

কিন্তু হরতাল, অবরোধ আর রাজনৈতিক সহিংসতায় সেটি হয়ে ওঠেনি। ’
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, শুরুতেই বিতর্কের মুখে পড়েছিল টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও কখনো করা হয়নি। প্রথম দিনের লোক দেখানো কর্মসূচিতে সংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে বেছে বেছে চারটি ভালো মানের কারখানা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেছিল বিজিএমইএ। এই কারখানাগুলোর মালিক হচ্ছেন বর্তমান সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সমিতির সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম ও সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।


ভালো মানের এসব কারখানা পরিদর্শনে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ করেন ফায়ার সার্ভিস ও বুয়েটের প্রতিনিধিরা। তবে সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।
অতীতেও এ রকম হয়েছে: একইভাবে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে ২০০৬ সালে পোশাক খাতে মালিক-শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে কিছু সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে বড় দাগে ছিল কারখানায় শ্রমিকদের সংঘ করার অধিকার, নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেওয়া, মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু আজও সেই সব চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।


সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার গতকাল এ বিষয়ে বলেন, বড় কারখানাগুলোতে নামমাত্র কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। ছোট ও মাঝারিগুলোতে হয়নি।
আবারও লোক দেখানো কর্মসূচি: সাভার বিপর্যয়ের পর এবার বিজিএমইএর সঙ্গে যোগ দিয়েছে নিট পোশাক কারখানার মালিক সমিতি বিকেএমইএ। গত শনিবার তাদের যৌথ বিশেষ সাধারণ সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী এক মাসের মধ্যে সমিতির প্রত্যেক সদস্যকে সব কারখানার কাঠামোগত নকশা এবং এগুলো কতটা ভার বহন করতে সক্ষম, তার হিসাব জমা দিতে হবে। এসব নকশা জমা হলে সেগুলো পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।

কোনো কারখানায় গরমিল পাওয়া গেলে তার লাইসেন্স স্থগিত করা হবে। এ ছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে যেসব কারখানা ভবনের ভেতরে জেনারেটর আছে, তা এক মাসের মধ্যে নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
নতুন করে নেওয়া এসব কর্মসূচির বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে। এবারও লোক দেখানো কর্মসূচি বলে সমালোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এবারের ঘটনা ভিন্ন।

সাভারের ভবনধস তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছে। নিবেদিত ব্যবসায়ীদের জন্য এটি খুবই কষ্টকর। তিনি বলেন, ‘কঠিন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় খোলা নেই। খারাপ ব্যবসায়ীদের অবশ্যই এই খাত থেকে বের করে আনতে হবে। ’ এ জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্ববান হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১৮ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.