পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছিল হরতাল আহ্বানকারীরা, তাই রানা প্লাজা ধসে পড়ে থাকতে পারে!
এই কথা একজন মন্ত্রী বলেছেন। কোন মন্ত্রী বলতে পারেন, শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একবাক্যে বলে উঠবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গদিটা কাঁটায় ভরা, ওই মন্ত্রী পদে বসতে তিনিই রাজি হবেন, কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব এমন কথা বলা! মাটি খুঁড়ে সন্ত্রাসীদের বের করব, আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে, লুকিং ফর শত্রুস থেকে শুরু করে ‘পিলার নাড়ায় ভবন পড়ে’ তত্ত্বের উদ্গাতারা সবাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন! ব্যাপারটা নিয়ে পরিসংখ্যানবিদদের গবেষণা করা উচিত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা সার্টিফিকেট আমিও পেয়েছি। এই লেখাটা আমার শিক্ষক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী কিংবা প্রখ্যাত কাঠামো প্রকৌশলী অধ্যাপক শামীমুজ্জামান বসুনিয়া, যিনি কিনা আবার ইঞ্জিনিয়ারস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের সভাপতি, তিনিও পড়বেন, এই সম্ভাবনা আছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের ট্রাস পড়াতেন, আমি তাঁর বিষয়ে পরীক্ষায় ৪০-এ ৩৯ পেয়েছিলাম, আর বসুনিয়া স্যার পড়াতেন আরসিসি, কংক্রিট; তাঁর পরীক্ষায় কেমন করেছিলাম মনে নেই, কিন্তু প্রথম দিনেই যে তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, রংপুরের ছেলে হলো সবচেয়ে ভালো ছেলে আর বরিশালের মেয়ে হলো সবচেয়ে ভালো মেয়ে, সেটা মনে আছে।
স্যারের বাড়ি রংপুর, শ্বশুরবাড়ি বরিশাল। আমি ছেলে কেমন জানি না, ছাত্র হিসেবে বুয়েটে ভালো ছিলাম না, তবে যত খারাপই হই না কেন, এ-কথা আমি আপনাদের গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, কোনো নয়তলা ভবনের একটা কলাম দশজনে মিলে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলেও কোনো ভবন ভেঙে পড়বে না, তবে এটা বলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হতে হয় না যে এ ধরনের উক্তি করলে সরকার পড়ে যেতে পারে।
রানা প্লাজার ভেঙে পড়া থেকে একটা কথাই বারবার শুধু মনে পড়ছে, ডব্লিউ বি ইয়েটসের কবিতার লাইন থিংস ফল অ্যাপার্ট—সবকিছু ভেঙে পড়ে। চিনুয়া আচেবের একটি বইয়েরও নাম এটি। হুমায়ুন আজাদও সবকিছু ভেঙে পড়ে শিরোনামে বই লিখেছিলেন।
আমি পলায়নবাদী মানুষ। প্রথম দিন ওই দুর্ঘটনার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে শুরু করি। ভবনটিতে পোশাক কারখানা ছিল! হায় হায়, না জানি কত হাজার মানুষ ধুলায় মিশে গেছে রক্ত-মাংস-অস্থিসমেত! তারপর দুশ্চিন্তা, ওই গহ্বরের মধ্যে নড়তে পারছে না, চড়তে পারছে না, হয়তো হাত-পা চাপা পড়ে আছে কংক্রিটের নিচে, এমনভাবে একটা মানুষ অন্ধকারে, আলো-বাতাস, খাদ্য-পানি ছাড়া কেমন করে বেঁচে আছে। আমি নিজেকে ওই জায়গায় ভাবি, একটা বিছানায় ৭২ ঘণ্টা বালিশ চাপা দিয়ে রাখলেই আমি বাঁচব না, কোনো লিফটে আধা ঘণ্টা আটকে থাকলেই আমি আতঙ্কে মরে যাব। আমি ভাবতে পারছি না, ভাবতে গেলেই মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাই, রাস্তায় ছোটাছুটি করি, বিষপান করে মরে যাই।
আমার শোক কোনো সান্ত্বনা মানে না, যখন ভাবি, ভবনটি পতনের আগে সংকেত দেওয়া সত্ত্বেও এতগুলো মানুষকে জোর করে কাজে ডেকে আনা হলো। এ কোন বিশেষজ্ঞ, যিনি বললেন, একটা কলাম ভাঙলে ভবন ভাঙে না। আমার মনে হচ্ছে, আমার শিক্ষক জামিলুর রেজা চৌধুরী, শামীমুজ্জামান বসুনিয়া আমার গালে কষে চড় মারছেন, এই শিখিয়েছি তোমাদের? তোমরা কেন ছুটে গেলে না সাভারে, কেন বললে না খালি করো ওই ভবন! এ আমার পাপ, ও তোমার পাপ।
কার জমি কে দখল করেছিল? কে পুকুর ভরাট করেছিল কী দিয়ে? জলাশয় ভরাট করা না বেআইনি? কে তাদের ভবন বানানোর অনুমতি দিল? কোন স্থপতি তার নকশা করল? কোন কাঠামো প্রকৌশলী তার কাঠামোর নকশা করল? কে তার নিরীক্ষা করে দিল? ওই ভবন বানানো হয়েছিল কোন উদ্দেশ্যে? কেন একটা দাপ্তরিক ভবনে কারখানা বসানো হবে? তাও এই রকম শ্রমঘন ও অত্যন্ত তাপ-উৎপাদনকারী কারখানা? শ্রম মন্ত্রণালয় কী করল? রাজউক কী করল? আমি আমার কলামে বহুবার লিখেছি, ঢাকা বা তার আশপাশে জমি যেখানে সোনার চেয়ে দামি, জীবনযাত্রা যেখানে ব্যয়বহুল, সেখানে কেন বহুতল ভবনে পোশাক কারখানা হবে? পোশাক কারখানার কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে, পণ্য চলেও যায় বিদেশে, তাহলে কেন এটা সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি এলাকাজুড়ে আনুভূমিকভাবে বেড়ে উঠবে না? এত টাকা আয় হচ্ছে, আপনারা ঢাকা শহর থেকে, বাণিজ্যিক ভবন থেকে, আবাসিক এলাকা থেকে পোশাকশিল্প সরিয়ে নিয়ে যান। কে শুনবে কার কথা? সোনার ডিম পাড়া হাঁস, একে মারা যাবে না।
এখন লোভ আর পাপ নিজেই নিজের সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে জবাই করে চলেছে।
আর বলি হচ্ছে গরিব শ্রমিকেরা। আহা রে আমার শ্রমিক ভাইয়েরা, শ্রমিক বোনেরা। কৈশোর-তারুণ্য-যৌবন তিলে তিলে বিসর্জন দিচ্ছে প্রচণ্ড আলোর নিচে, অহোরাত্র একাগ্র পরিশ্রম, কয় টাকা বেতন তাদের, কোথায় থাকে তারা, কী খায়, স্বাস্থ্যসুবিধা কতটুকু পায়? আমরা কোনো দিন খোঁজ নিতে যাইনি, শুধু চাকা ঘুরেছে, ববিন ঘুরেছে, সুচ ওঠানামা করেছে, বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে, আমরা ঢাকার রাস্তায় মার্সিডিজ দেখি, বিএমডব্লিউ দেখি, আর যেসব গাড়ির নাম জানি না, সেসব দেখি। তারই চুয়ে পড়া টাকার ভাগ পাই।
নিজেও গাড়ি চড়ি। বৈষম্য বড় বেশি। অবহেলা, অন্যায়, অনৈতিকতা বড় বেশি। আমরা বারুদের স্তূপের ওপরে বসে আছি। পোশাকশ্রমিকেরা একযোগে বেরিয়ে এসে এত দিনের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে চাইলে সেদিনই আমাদের সাজানো বাগান শেষ হয়ে যাবে।
তেমনি করে এতিম গরিব শিশুদের আমরা পাঠিয়েছি কওমি মাদ্রাসায়। তারা কেমন আছে, কোনো দিন জানতে চাইনি। তারা কী পড়ে, তাদের মনোজগতে কী আছে, আমরা খবর রাখিনি। তারা আজ লাখ লাখ বেরিয়ে আসার পর আমাদের টনক খানিকটা নড়েছে, কিংবা আদৌ নড়েনি।
আর সবকিছুর মূলে দেখতে পাই দলীয় রাজনীতি, গণতন্ত্রের পরিণত হওয়া লুণ্ঠনতন্ত্রে, আইনের শাসনের চির-অবসান, সীমাহীন লোভ, অর্থগৃধ্নুতা, মানবিক মায়া-মমতার অবলোপ, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা, এককথায় নৈরাজ্য!
এই চাপ আর নিতে পারছি না।
যে মায়ের কাছে ফোন এসেছে—‘মা, আমরা চারজন চাপা পড়ে আছি, আমাদের উদ্ধার করো’—তাঁর কেমন লাগছে? এসব খবর আর পড়তে চাই না, টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নিই। আর কত কাঁদব! আর কত চুল ছিঁড়ব! অনেক কেঁদেছি, আর কাঁদতেও পারছি না।
এই যখন দেশের সব মানুষের অবস্থা, তখন আসছে অমৃতবচন, খুঁটি ধরে ঝাঁকানোর অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক তথ্য, যা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মহা মহা আবিষ্কার হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তবু আশা দেখি, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঢুকছেন সুড়ঙ্গে, ঢুকছেন সাধারণ মিস্ত্রিমানুষ! বের করে আনছেন জীবিত মানুষকে! কতজন রক্ত নিয়ে, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে বা ওষুধযন্ত্র নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন ওখানে। কতজন অর্থসাহায্য করার জন্য সূত্র খুঁজছেন!
এই মানবিক বোধটুকু এখনো সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে উবে যায়নি বলেই হয়তো এখনো সূর্য ওঠে, এখনো ভোর হয়, পাখি ডাকে!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।