অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
বাসা চিনে পৌঁছাতে তেমন সমস্যা হয় নি। বাদ মাগরিব মিলাদ, সিঁড়িতে উঠবার সময়ে আমার সামনে যেই দুজন, তারাই মৌলভি । অর্থ্যাৎ যাকে বলে সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়েছি আসরে।
গিয়ে চুপচাপ বসলাম। ইদানিং নানাবিধ ব্যস্ততায় মানুষ তেমন আনুষ্ঠানিক ভাবে উপাসনাও করতে পারে না।
মিলাদতো তেমন বাধ্যবাধকতামূলক উপাসনা নয়, বরং কোনো একটা বিশেষ উপলক্ষে ইশ্বরের ভজনা। এই কাজে তেমন আগ্রহ থাকবে না বলেই মিলাদের শেষে বিশাল ভুঁড়িভোজের ব্যবস্থা। মানে ইশ্বরের ভজন শুনতে অনিচ্ছুক মানুষ যেনো প্রাপ্তিলোভে হলেও একটু শুভ উদ্দেশ্যে করা এই সম্মেলনে এসে সামান্য অংশগ্রহন করতে পারে।
সর্বসাকুল্যে আমরা বোধ হয় ৬ জন, এবং সাথে ২ জন মৌলভি। পাশের ঘরে জেনানাদের আলাদা ব্যবস্থা তবে পাতলা কাপড়ের আড়ালে জেনানাদের আব্রু রক্ষা হচ্ছে না, আমরা পুরুষের নির্ধারিক কক্ষ থেকেই জেনানা মহলের অধিবাসীদের দেখতে পারছি।
মাঝে মাঝে এই সব ইতরামি দেখে একটু আশ্চর্যই লাগে। পর্দাপ্রথা মানবার ব্যপারে তার কিংবা তাদের তেমন সুনাম নেই, চমৎকার, রুচিশীল শালীন পোশাক পড়ে তারা, তবে কখনও তাদের তথাকথিত পর্দা কিংবা হিজাব কিংবা বোরখাআবৃত দেখি নি। যা কিছু স্বাভাবিক তাই মেনে জীবনযাপন করা ভালো।
এই যে নেটের পর্দা এটাতে তেমন ভাবে আড়াল তৈরি হচ্ছে না তবে মানসিক একটা সান্তনা পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের উপাসনা এবং ইশ্বরনিষ্ঠতা সবই মানসিক সান্তনার বিষয়, আর এর সাথে আমাদের নিজেদের ধোঁকা দেওয়ার চিরন্তন প্রক্রিয়া।
মৌলভি করিতকর্মা, শুরু করে দিলেন বয়ান। কিছু বুঝবার আগেই সুরা বারাকার প্রথম ২ রুকু তেলওয়াত হয়ে গেলো। আলিফ লাম মিম জ্বালিকাল কিতাবুন ................
এরসাথেই মিলাদের চিরন্তন চিরায়ত সুর, ইয়া নবী সালাই মালাইকা। ইয়া হাবীব সালামালাইকা, ইয়া রাসুল সালামালাইকা,
আগরবাতি জ্বলছে, ভারতীয় আগরবাতী, কাফিরদের দেশের আগরবাতি জ্বালিয়ে ইশ্বরের আরাধনা ইশ্বর কি পছন্দ করবেন? কে জানে? হাতে নিয়ে আগরবাতির প্যাকেট হিন্দি লেখা পড়বার চেষ্টা করছি, সে কি হিন্দিতে লেখা আছে মন্দির। যা বাবা কি কেলেংকারী, মন্দিরের আগরবাতিতে আল্লামিয়ার নামজপ হচ্ছে।
ব্যাঙ্গালোরের কোনো এক মন্দিরের অর্থউপার্জন প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই আগরবাতি নির্মিত হয় এবং এর বিক্রয়লব্ধ অর্থও সেই মন্দিরের কাজে লাগে।
আল্লা মিয়া তার সহযোগীদের সাথে তেমন কোনো ঝামেলা কি করবেন? গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানী ফ্রান্স, ভাষার বিভেদ, জাতীয়তার বিভেদ ভুলে সব সময়ই দরিদ্রের পোনমারবার জন্য সদাপ্রস্তুত। আল্লা মিয়া, ইন্দ্র, শংকর দুর্গা কালী এরাও মনে হয় না নিজেদের ভেতরে কোনো বিরোধে জড়াবে।
মিলাদটা তেমন জমছে না, তেলাওয়াত শুনে তেমন আনন্দ পাচ্ছি না, একটু চিবিয়ে চিবিয়ে তেলাওয়াত হচ্ছে। একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে এহেন তেলাওয়াতের।
হুমম, যা ভেবেছিলাম, মৌলভি সাহেব মিলাদের ফাঁকে ফাঁকে তেলাওয়াতের সাথে সাথে হাতের মরা চামড়া তুলছেন, যখনই মরা চামড়া তুলতে একটু বাড়তি শক্তি দিচ্ছেন সেটার প্রভাব পড়ছে তেলাওয়াতে।
আরও কিছুক্ষণ পরে মৌলভি সাহেবের মনে পড়লো এখন বোধ হয় ইশ্বর ভজনার কারণটা উদ্ধার করা প্রয়োজন। তিনি গৃহস্বামীকে বললেন, কেনো এই মিলাদ। গৃহস্বামী এ বাসায় নতুন উঠেছেন, বাসা উদ্বোধনের আগে ইশ্বরের নামস্মরণ করা এই হলো উপলক্ষ্য।
আমার এইসব মানুষদের খুব ভালো লাগে।
তারা সব সময়ই কোনো না কোনো ভাবে ইশ্বরের সাথে সংযুক্ত। সর্বদা নিয়মিত ইশ্বরের নাম স্মরণ না করলেও যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তে তারা ইশ্বরকে স্মরণ করে, ভালো কোনো সংবাদও তারা সুবহানআল্লাহ বলে গ্রহন করে খারাপ কোনো সংবাদও তারা নিশ্চয়ই ইশ্বর ধৈর্য্য ধারণকারীদের সাথে আছেন বলে গ্রহন করে। বড় মাপের পাপের কাজ করতে পারে না, তবে ছোটো ছোটো মানবীয় দুর্বলতার প্রভাব এড়িয়ে চলা সম্ভব না । কোনো মানুষ কি পারে?
মিলাদ চলছে। কোরাণের তেলাওয়াতের পরে মোহাম্মদের জীবন ও কর্ম নিয়ে সামান্য আলোচনা হওয়া মিলাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
অন্তত আমার অংশগ্রহনের সবকটা মিলাদের এই বৈশিষ্ঠ্যটা আমার মাথায় গেঁথে আছে।
উর্দুতে মিলাদ পড়ে ঢাকায়। ঢাকার কুট্টি ভাষাটা খানিকটা ফার্সী খানিকটা উর্দু খানিকটা বাংলার জটিল সংমিশ্রন। নবাবদের নিবাস এবং লেখ্য ভাষার সাথে কথ্য ভাষায় ফার্সী আর উর্দু জবান ছিলো, তাদের সাথে সংযোগ রাখতে গিয়ে এখানে একটা মিশ্র ভাষা তৈরি হয়েছে, সেটাই ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা। সেই ঢাকায় উর্দুতে মিলাদ হওয়াটা দোষনীয় ভাবি না, তবে আমার চিরচেনা মিলাদের স্বাদ পাই না এখানে।
হয়তো ভাষা আন্দোলনের প্রভাবেই কিংবা বিষাদ সিন্ধু আর যে ফুলের সৌরভে দুনিয়া মাতোয়ারার প্রভাবে কিংবা নজরুলে করা বাংলা আমপারার প্রভাবে। সে কারণেই হোক না কেনো আমাদের শহরে যদি বিহারী কেউ মিলাদ না পড়াতো তবে মিলাদের রসুলজীবনী অংশ অবশ্যই বাংলায় বয়ান হতো।
সুরটাও চমৎকার কানে গেঁথে যেতো।
নবী না হয়ে দুনিয়ায় , না হয়ে ফেরেশতার খোদার হয়েছি উম্মতও তোমার তার তরে শোকরা হাজার বার
ইয়া নবী সালাই মালাইকা...........।
আমিনার নয়নের মনি শুনালো তাওহিদের বানী
নবিজীর রওজা মদিনায় তার তরে সালামও জানাই
ইয়া নবী সালাই মালাইকা
এভাবে আসলেই আমরা যারা নিতান্তই মিষ্টির লোভে উপস্থিত তারা বুঝতান মিলাদের শেষ ঘন্টা বাজছে, একটু পরেই দুহাত তুলে মোনাজাত শুরু হবে।
উর্দু জবান আমার খারাপ লাগে এমন না, তবে শৈশবের সেই চিরায়ত মিলাদের বাংলা সুরটা খুঁজে পেলাম না। হুজুর চমৎকার এবং কর্পোরেট। তিনি শুরু করলেন বয়ান, প্রতিটা জিনিষ তৈরির একটা উদ্দেশ্য আছে। আমরা বাসা বানাই, আমরা দোকান বানাই, এমন কি কোম্পানি একটা পন্য তৈরি করে, সেইটারও একটা উদ্দেশ্য আছে। তেমন করেই আল্লা ইরশাদ করেছেন, পৃথিবীতে আমি মানুষ আর জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য।
পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছুই মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য।
যৌবনের ইবাদাত আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
একজন যখন সালাতে সিজদা দেয় তখন আল্লাহ তার ফেরেশতাদের ডেকে বলেন হে ফেরেশতারা তোমরা মানুষ তৈরির বিরোধিতা করেছিলে, এই দেখো মানুষ কিভাবে মাথা নত করে আমাকে স্মরণ করছে।
সালাতের উপকারিতা বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা শেষে মিলাদের বিদায় ঘন্টা বাজছে মনে হয়। মোনাজাত শুরু হলো।
কোনো এক অজানা কারণে মোনাজাতের সময় পুরোনো মৃত মানুষদের স্মরণ করবার চিরায়ত একটা প্রথা আছে। এটা কৌতুকের পাঞ্চ লাইনের মতো, হঠাৎ করেই ভীষণ আবেগী হয়ে মৌলভী সাহেব বলবেন। আল্লাহ তার মৃত বাবা মায়ের আত্মাকে শান্তি দিন, তিনি তাদের বেহেশত নসীব করুন। আমরা পাপী তাপি বান্দা, এই মিলাদ মেহফিলের উছিলায় তুমি তাদের পাপ মাফ করে দাও।
সেই সাথে দোজখের মারাত্মক সব শাস্তির বর্ণনা।
এবং একটু ফুঁপিয়ে কান্না, মিলাদে উপস্থিত একটু বৃদ্ধ মানুষের চোখের কোণ ভিজে উঠবে, তারাও কাঁদবে, ভয়ে কাঁপবে অজানা আশংকায়। দিন তো শেষ হয়ে গেলো। আর মাত্র কদিন আছে, কিছুই তো করলাম না, এখন কি করে মুখ দেখাবো, তাদের সন্তপ্ত কান্নার আবেশে আরও কিছু মানুষের চোখ ভিজে উঠবে। মিলাদটা সফল হয়ে উঠবে এই ভাবেই। তবে আমাদের এই সংক্ষিপ্ত মিলাদে তেমন বৃদ্ধ মানুষেরা নেই।
তাই এই আবেগময় দৃশ্যটা চোখে পড়লো না। একটু আক্ষেপ রয়ে গেলো। চিরায়ত মিলাদের সবটুকু খুঁজে পেলাম না।
মিলাদ শেষ হওয়ার পরে মনে হলো ইদানিং যেভাবে হিন্দি ছবির প্রভাব পড়ছে বাংলা ভাষাভাষীদের উপরে। তাই ইয়া নবী সালা মালাইকা উচ্চারণের সাথে সাথে মালাইকার কোন ভঙ্গি যে দেখবে উপস্থিত মানুষেরা এটা একটা চিন্তার বিষয়।
মালাইকা হয়ে বিপাশা দম মারো দম রিমা সেন রাইমা সেন কারিনা হয়ে হালের গুজব সবই মাথার ভেতরে ঢুকে পড়বে,
এইসব ভেবে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। যুগটাই এমন, ক এ কাক শেখার আগেই কারিনা শিখে ফেলছে শিশুরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।