জ্বালানী নিরাপত্তা নামের একটা শব্দ জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। যন্ত্রযুগ টিকিয়ে রাখবার জন্য জ্বালানীর বিকল্প নেই। আমাদের শক্তির উৎসগুলো সীমিত। এবং এই সীমিত শক্তির উৎসগুলো অন্বেষণ করে উত্তোলন করা বিশেষণ খনিজ সম্পদ আহরণের কাজে নিয়োজিত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য পৃথিবী গর্ভে এখনও অনেক তরল সোনা লুকিয়ে আছে। এবং হতাশা এবং নৈরাশ্যবাদী মানুষেরা তরল সোনা এবং কয়লা কিংবা গ্যাস উত্তোলন করে পৃথিবীকে আর দুষণে কলুষিত করতে নারাজ, তারা আরও পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর সন্ধান করতে অর্থ বিনিয়োগের দাবী জানাচ্ছেন।
তারা ইঞ্জিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধির পক্ষে, তারা ইঞ্জিনে জৈব জ্বালানী ব্যবহার উৎসাহিত করছেন।
তেল এবং গ্যাসচালিত যানবাহনের বিকল্প বৈদ্যুতিক গাড়ী নির্মিত হয়েছে অনেক দিন আগেই। তবে সেই গাড়ী জনপ্রিয়তা লাভ করে নি। সৈরবিদ্যুত চালিত গাড়ীগুলোও তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি। এর কাঠামো এবং এর গতি কোনোটাই মতপুত হয় নি গতিদানবদের।
তারা আরও দ্রুতগামী বিদ্যুতচালিত গাড়ী চান। সৌরবিদ্যুতচালিত অধিকাংশ গাড়ীই ঘন্টায় ৬০ মাইল বেগে ছুটতে পারে, তেমন ভাবে যদি আমরা পরিবর্তিত করি গাড়ীর কাঠামো তবে সেটা সর্বোচ্চ ঘন্টায় ২০০ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
মূলত বিদ্যুতচালিত গাড়ীগুলো হালকা এবং এসইউভির মতো মাল্টিফাংশনাল নয়। হাইব্রীড গাড়ী এসেছে বাজারে। এসব গাড়ীর ইঞ্জিন তেলের ব্যবহার কমিয়ে ফেলেছে।
তারা গাড়ীর প্রথমিক শক্তিকে রুপান্তরিত করে গাড়ীর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পক্ষে।
তাপগতিবিদ্যার দ্বীতিয় সুত্র পৃথিবীর ভবিষ্যত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। এই তাপগতিবিদ্যার দ্বীতিয় সূত্র সাধারণ ভাবে বলছে পৃথিবীতে কোনো পরিবর্তনই শক্তিক্ষয় ব্যতিত সম্ভব নয়। বিষয়টা অদ্ভুত। যদি আমরা বাতাস বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা না রেখে ঘরের ভেতরে এয়ার কুলার চালু রাখি তবে কোনো ভাবেই আমি ঘরের তাপমাত্রা কমাতে পারবো না।
যদিও এয়ারকুলার সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘরের বাতাস ঠান্ডা করার চেষ্টা করবে তবে এই কাজের জন্য তার বাড়তি শক্তি ক্ষয় করে গরম বাতাসকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। যদি এটা করা সম্ভব না হয় তবে ঠান্ডা বাতাস গরম বাতাসের সংস্পর্শ্বে এসে ঘরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিবে।
এই যে কাজটা, বস্তুর স্বাভাবিক প্রবনতার বিরুদ্ধচারণ, সেটা করতে হলে আমাদের শক্তি ব্যয় করতে হবে। এবং এই শক্তি ব্যয়ের সময় আমাদের কিছু পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হবে। সুতরাং আমাদের যে যন্ত্রই দেওয়া হোক না কেনো আমাদের প্রদত্ত শক্তি এবং আমাদের প্রাপ্ত রুপান্তরিত শক্তির ভেতরে সামান্য ফারাক থাকবে।
এই ফারাকটার অনুপাত যেকোনো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনে শতকরা ৩০ ভাগ থেকে শতকরা ৮৫ ভাগ। অর্থ্যাৎ আমাদের ইঞ্জিনগুলো সর্বনিম্ন প্রদত্ত শক্তির ৩০ শতাংশকে অন্য কোনো কার্যকরি শক্তিতে রুপান্তরিত করতে পারে। এবং সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ শক্তির সফল রুপান্তর সম্ভব।
জ্বালানী নিরাপত্ত শব্দটি এই শক্তির সফল রুপান্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমাদের যন্ত্রযুগে হয়তো পরবর্তীতে বিদ্যুতচালিত যানের কদর বাড়বে।
গাড়ীর ইঞ্জিনে দেওয়ার মতো বায়োফুয়েল না থাকলেও আমরা প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদন করে সেই বিদ্যুতে গাড়ী চালাতে পারবো।
আমরা যে বাতি জ্বালাই সেই বাতি জ্বালাতে আমাদের যে পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হয় তার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ আমরা আলো পাই। তবে যদি আমরা প্রাচীন হলদে আলোর বাতি মানে ৬০ ওয়াট, ৪০ ওয়াট, ১০০ ওয়াট বাতি ব্যবহার করি তবে আমাদের প্রাপ্ত আলোর পরিমাণ ১০ শতাংশের কম। সুতরাং আমরা যখন ১০০০ জুল শক্তি ব্যবহার করি তখন আদতে আমরা হলদে বাতিতে পাই ৮০ থেকে ৯০ জুল পরিমাণ আলো। আমরা টিউব লাইট ব্যবহার করলে প্রতি ১০০০ জুলের জন্য পাই ২০০ থেকে ২৫০ জুল আলো, এবং এনার্জি লাইট ব্যবহার করলে আমরা পাবো ১০০০ জুল শক্তির বিনিময়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জুল আলো।
এটা আরও বাড়ানো যায়। আমরা যদি সলিড ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করি তবে আমরা এই শক্তিকে সফল রুপান্তরের হার বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশের উপরে নিয়ে যেতে পারবো। বিশেষত আমাদের এই শক্তি অপচয়ের হার কমিয়ে ফেলানো আমাদের সাফল্য হবে।
বিশেষত আমরা যেই শক্তিটা অপচয় করি সেটা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে ফেলছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কুফল আমরা যোগ করছি, পৃথিবী জুড়ে প্রাক্বতিক বিপর্যয় কিংবা পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে।
কোথাও পৃথিবী অধিকতর উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কোথাও পৃথিবী খরায় ভুগছে। পৃথিবীর দুই শীর্ষ বিন্দুতে জমে থাকা বরফ গলছে। এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বাড়ছে।
বিদ্যুতচালিত যন্ত্রগুলোতে শক্তি অপচয়ের হার কম, তবে বিদ্যুত উৎপাদন কাজে শক্তির অপচয় অনেক, সব মিলিয়ে কার্যকরি শক্তি রুপান্তরের হারটা ৬০ শতাংশের বেশী নয়।
এই ৬০ শতাংশ সফল শক্তির রুপান্তরের জন্য আমরা খনিজ জ্বালানী ব্যবহার করছি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে। সেখানে মূলত ২টি প্রক্রিয়ায় বিদ্যুত উৎপাদিত হয়।
প্রক্রিয়াটি খুবই সাধারণ অন্তত প্রাযুক্তিক দিকটা বিবেচনা করলে। যেকোনো জেনারেটরে যা থাকে একটা বড় মাপের বিদ্যুত কেন্দ্রেও ঠিক তাই থাকে। মূলত পরিচলণ ব্যয় অনেক কম হওয়ায় আমরা প্রতিবর্তী বিদ্যুত কিংবা এসি বিদ্যুত ব্যবহার করি।
মাঝে ট্রান্সফর্মার এবং অন্যন্য যন্ত্র বসিয়ে শক্তি অপচয়ের হার কমিয়ে সুলভে অনেক দুর পর্যন্ত বিদ্যুত সঞ্চালনের সুবিধার জন্যই এসি বিদ্যুত জনপ্রিয়।
সেখানে আবেশ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুত উৎপাদিত হয়। একটি কয়েল একটু চুম্বকক্ষেত্রের ভেতরে ঘুরালে সেখানে বিদ্যুত উৎপাদিত হয়। মূলত এই কয়েলটা ঘুরানোর জন্যই জ্বালানী প্রয়োজন। এই কয়েল যত জোড়ে ঘুরবে তত বেশী বিদ্যুত উৎপাদিত হবে, উৎপাদিত বিদ্যুতের শক্তি বেশী হলে সেটা অনেকদুর পর্যন্ত পাঠানো সহজ হবে।
কয়েল ঘুরানোর জন্য টারবাইনের ব্যবস্থা আছে। সুতরাং আমাদের বিদ্যুত উৎপাদন যন্ত্রে যা যা থাকে সেগুলোর তালিকা মোটামুটি এ রকমই।
একটা চুম্বক, যার মাঝে কয়েল ঘুরবার মতো ফাঁকা জায়গা আছে।
একটা কয়েল, সেটার পাঁক সংখ্যার উপরে নির্ভর করবে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ, এবং এই কয়েলের সাথে যুক্ত টারবাইন বা রোটর, যা এই কয়েলটাকে চুম্বকের ভেতরে ঘুরাবে।
টারবাইন বা রোটর ঘুরানোর প্রয়োজনীয় শক্তি আমরা দেই যদি ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করি তবে ডিজেল জ্বালিয়ে, গ্যাস জেনারেটরে গ্যাস জ্বালিয়ে এই টারবাইন ঘুরাই।
বাসা কিংবা দোকানে ব্যবহৃত জেনারেটরের উৎপাদন ক্ষমতা কয়েক কিলো ভোল্ট- কিংবা কয়েক হাজার ওয়াট। মেগা ওয়াট জেনারেটরের দাম বেশী এবং কাঠামোও আলাদা। আমরা মূলত ৩ থেকে ৪ ভাগে ভাগ করে ফেলি বিদ্যুত উৎপাদনের যন্ত্রগুলোকে।
গেরোস্থালী কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুত উৎপাদক, ক্ষমতা কয়েক হাজার ওয়াট থেকে শুরু করে কয়েক লক্ষ ওয়াট
১ থেকে ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ক্ষুদ্র বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র।
৫০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন মাঝারি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র।
১৫০ থেকে ৫০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন বৃহৎ বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র।
৫০০ মেগা থেকে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন সুবিশাল বিদ্যুত উৎপাদনকেন্দ্র।
টারবাইন ঘোরানোর জন্য আমরা কি কি পদ্ধতি ব্যবহার করি। মূলত পানি ফুটিয়ে বাস্প বানিয়ে সেই বাষ্পশক্তিতে টারবাইন ঘুরাই। অপচয়ের পরিমাণ অনেক বেশী এই পদ্ধতিতে।
অর্থ্যাৎ শক্তি রুপান্তরের হারটা কম।
অন্যটা হচ্ছে কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন, এই পদ্ধতিতে শক্তি রুপান্তরের হারটা অনেক সময় ৬০ শতাংশের বেশী। মূলত গাড়ীর ইঞ্জিন যেভাবে চলে এটাও প্রাথমিকভাবে সেই পদ্ধতিতেই কাজ করে। পেট্রোল কিংবা ডিজেলের বাষ্পকে সংকুচিত করে এটাকে জ্বালানো হয়, এই বিষ্ফোরণের ফলে হঠাৎ করেই সম্প্রসারিত হয় গ্যাস।
এই সম্প্রসারিত গ্যাসের চাপে টারবাইন ঘুরে।
কম্বাইন্ড সাইকেল জেনারেটরে গ্যাস টারবাইনে ব্যবহৃত শক্তির অপচয় রোধ করবার জন্য এই সম্প্রসারিত গ্যাসের উত্তাপকে ব্যবহার করে পুনরায় পানিকে বাস্পে রুপান্তরিত করা হয়। এই বাস্প দিয়ে আরও একটা টারবাইন ঘুরানো হয়। ব্যয়িত শক্তির কৌশলী ব্যবহারের জন্যই মূলত গ্যাস টারবাইনে শক্তি রুপান্তরের হার বেশী। অর্থ্যাৎ এর দক্ষতা বেশী।
আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত গ্যাসের পরিমাণ ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কাছাকাছি, এর ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহৃত হয় বিদ্যুত উৎপাদনের কাজে।
২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহৃত হয় সার কারখানায়, এর পরে আছে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত গ্যাস। কল কারখানা এবং গেরোস্থালী কাজে এর অধিকাংশই ব্যয় হয়।
সুতরাং আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমাদের প্রাক্কলিত প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার সময় সীমা কত। প্রতিবছর যে হারে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে তাতে এই গ্যাস বর্তমানের হারে ব্যবহার করলে শেষ হতে সময় লাগবে প্রায় ৩৫ বছর। তবে আমাদের গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে বছরে ১২ শতাংশ হারে, এই হার বিবেচনা করলে আমাদের প্রাক্কলিত মজুত শেষ হতে লাগবে ২০ বছরের মতো।
আমাদের প্রায় সবগুলো বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রে সময়ের সাথে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, সেগুলোকে রক্ষনাবেক্ষণ করা এবং পরিবর্তন করবার জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে। আমাদের সনাতন পানি ফুটিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন ব্যবস্থাকে বদলে আরও বেশী গ্যাস টারবাইনভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র নির্মান করতে হবে। আমাদের প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে আমাদের শক্তি রুপান্তরে কৌশলী হতে হবে। এর বিকল্প নেই মোটেও।
আমাদের কয়লা পুড়িয়ে পানিকে বাস্পে রুপান্তরিত করবার জন্য একটা বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
সেটার উৎপাদন ক্ষমতা আরও বাড়ানো যায় কি না এটাও ভেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে আরও কৌশলী হয়ে সিলেটের পাহাড়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প স্থাপন করতে হবে।
এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা হবে আরও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।