বিজ্ঞান মানুষের উপকারী বন্ধু - একথা সবাই জানি। বিজ্ঞানের কল্যাণেই আজ আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই ব্লগে লিখতে পারছি ! তবে আল্লাহকে, তাঁর অবতীণ পবিত্র গ্রন্থ কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করে যে বিজ্ঞান কিংবা বৈজ্ঞানিক - তাদের সীমাবদ্ধতা কতটুকু, তাদের চিন্তা-চেতনার পরিসর-ই বা কতটুকু সে সম্পর্কে জানাতে আজ পরবর্তী চ্যাপ্টার তুলে ধরছি আপনাদের সামনে :
তথ্যসূত্র : স্টিফেন হকিং, নাস্তিকতা ও ইসলাম
লেখক : মুহাম্মাদ সিদ্দিক
প্রকাশক : মদীনা পাবলিকেশন্স
প্রকাশকাল : ২০০০ সাল
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২৭৬
বিজ্ঞান একটি প্রয়োজনীয় বিদ্যা হলেও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমনি রয়েছে জ্ঞানের অন্যান্য শাখারও। বিশ্বের জ্ঞান একটি নৈর্ব্যক্তিক বিষয় হলেও, ব্যক্তির মন-মগজ দিয়ে তা অনুধাবন করতে হয়। মন-মগজের সীমাবদ্ধতা স্বাভাবিক। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত পদার্থবিদ Charles Eugene guye (চার্লস ইউজিন গাই) মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সম্পর্কে বলেন : ( ভাবানুবাদ : "কোন বস্তুর দৃশ্য সৃষ্টি হয় বৈজ্ঞানিকের পর্যবেক্ষণের স্তর দ্বারা।
পর্যবেক্ষণের স্তর মানব-নির্ভর। মানবই এটা তৈরী করে। কিন্তু প্রকৃতিতে পর্যবেক্ষণের নানা স্তর নেই। প্রকৃতিতে রয়েছে একটি বিরাট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্য এমন একটি স্তর যা মানুষের আয়ত্বের বাইরে। এর কারণ হলো মানুষের মগজের গঠন , যা কোন বস্তুর চিত্রকে তার মগাজে তার ইচ্ছামাফিক কুঠুরিতে বিভক্ত করে এবং বিচ্ছিন্ন টুকরা টুকরা খন্ড বানায়।
" চার্লস ইউজিন গাই বলতে চান যে, কোন বিষয়ের সম্পূর্ণ চিত্র মানুষের মগজ ধারণ করতে অক্ষম। মানুষের মগজ একটি জিনিসকে টুকরা টুকরা করে পর্যবেক্ষণ করে। মানুষের মগজ সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিকভাবে, সামগ্রিকভাবে কোন কিছু পর্যবেক্ষণে অক্ষম।
পদার্থে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী Le comte du Nouy বলেন : (অনুবাদ : 'বৈজ্ঞানিক সত্য ' - এ ধরণের মন্তব্যকে সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করা উচিত এবং আক্ষরিক অর্থে নয়, যা জনসাধারণ সাধারণত করে থাকে। শর্তহীন কোন বৈজ্ঞানিক সত্য নেই।
)
বিজ্ঞানী এডিংটন বলেন যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হলো বহু আয়তনবিশিষ্ট বাস্তবতার চার আয়তনবিশিষ্ট মূর্তি ( সূত্র : সায়েন্স, ফিলোসফি এন্ড রিলিজিওন - মুহাম্মদ রুহুল আমিন, পৃষ্ঠা-২৫)
J.L. Goodall তাঁর " An Introduction to the philosophy of Religion"-গ্রন্থে অন্যগ্রহ থেকে আসা এক কাল্পনিক আগন্তুক কর্তৃক পৃথিবীর রেলওয়ে ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে "The Natural Railway Law" (প্রাকৃতিক রেল মতবাদ) নামক আজগুবি থিওরি প্রদানের হাস্যাস্পদ বর্ণনা করেছেন। বৈজ্ঞানিকগণও একই বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন।
Myerson তাঁর "Introduction to the Reality and Determinism in Quantum Physics" গ্রন্থে লেখেন :
(অনুবাদ : যদিও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অনির্দিষ্টভাবে উন্নতি করতে পারে, তবু এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এটা অবশ্যই হবে সীমাবদ্ধ ও আংশিক )।
আইনস্টাইনও তেমনিভাবে "Out of my later years" লেখায় বলেন, We face, therefore, the limits of a purely rational cpnception of our existence. (অনুবাদ : আমাদের অবস্থানের সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী ধারণার সীমারেখার সম্মুখীন আমরা)।
Hoimer Von Ditfurth নামে এক বৈজ্ঞানিক লেখক লিখেছেন : (অনুবাদ : আইনস্টাইনের সময় থেকে আমাদের মেনে নিতে হবে যে, আমরা কখনোই বিশ্বকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবো না, কারণ আমাদের মগজের সহজাত গঠন অপর্যাপ্ত তা করতে।
... আমরা জানি যে সামগ্রিক প্রকৃতির বিকাশের ধারায় , যা কোটি কোটি বছর ধরে চলছে, আমরা একাধারে স্বল্পায়ুধারী সাক্ষী ও অংশগ্রহণকারী। এভাবে যে জটিলতা ও সৌন্দর্যের মাঝে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা আমাদের মানবিক ধ্যান-ধারণার বোধগম্যতা অতিক্রম করেছে। )
স্যার আর্থার এডিংটন লিখেন -
(অনুবাদ : কয়েক বছর পূর্বে পদার্থবিদগণ যা ভাবত তাকে পরিত্যাগ করে বর্তমানে তারা বহির্বিশ্ব সম্পর্কে যা ধারণা করে, তাকে আমি এভাবে বলতে পারি যে, এটা এখন আরো গূঢ় রহস্যময়। )
A. Cracy Morrison-নামে আমেরিকান বৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেছেন যে, অলংঘনীয় গাণিতিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে, বিশ্ব একজন 'সুপারহিউম্যান ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিয়াস ( প্রকৌশলী প্রতিভাবান অতিমানব) দ্বারা পরিকল্পিত এবং পরিচালিত।
Evidence of god in an expanding universe-গ্রন্থে আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির প্রফেসর Edward Conklin মন্তব্য করেন যে, জীবনের সূত্রপাত হঠাৎ আকস্মিকভাবে কতগুলো বস্তুর সংমিশ্রণে হয়েছে এমন সম্ভাবনা এত কম যেমন কোন মুদ্রণ প্রেসে একটি শব্দ বিস্ফোরণের পরে একটি সুসম্পাদিত ও সংক্ষিপ্ত অভিধান তৈরী দ্রব্য হিসাবে বেরিয়ে আসা।
বিজ্ঞানের গালভরা বুলি সত্ত্বেও অনিশ্চয়তাবাদ (The Uncertainty Principle) বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে রশি টেনে ধরেছে। এখন খোদ ড. হকিং এর চিন্তাতে অনুধাবন করুন। হকিং বলেন- "ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসী বৈজ্ঞানিক মার্কুইস দ্যা লাপ্লাস যুক্তি দেখিয়েছিলেন- মহাবিশ্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণীয় (বৈজ্ঞানিক নিয়তিভিত্তিক- deterministic)। লাপ্লাসের প্রস্তাবনা ছিল, এমন এক গুচ্ছ বৈজ্ঞানিক বিধি থাকা উচিত যার সাহায্যে মহাবিশ্বের যে কোনো এক সময়কার অবস্থা যদি সম্পূর্ণভাবে জানা থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে মহাবিশ্বে কি ঘটবে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হবে। উদাহরণ : সূর্য এবং গ্রহগুলির যে কোনো একসময়কার দ্রুতি ( positions) এবং অবস্থান যদি জানা থাকে, তাহলে নিউটনের বিধিগুলির সাহায্যে সৌরতন্ত্রের অন্য যে কোনো সময়কার অবস্থা গণনা করে বলা সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে নির্ধারণীয়বাদ (determinism) বেশ স্পষ্ট। কিন্তু লাপ্লাস আরো খানিকটা অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর অনুমান ছিল, অন্য সমস্ত বিষয় সম্পর্কে, এমনকি, মানবিক আচরণ সম্পর্কেও এই ধরণের বিধি রয়েছে।
...লাপ্লাসের স্বপ্ন ছিলো বিজ্ঞানের এমন একটি তত্ত্ব - মহাবিশ্বের এমন একটি প্রতিরূপ যা হবে সম্পূর্ণ নির্ধারণযোগ্য ( ceterministic)। মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থান্ যদি নির্ভুলভাবে মাপা সম্ভব না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্ভুলভাবে বলা অসম্ভব।
এই পরিস্থিতি লাপ্লাসের স্বপ্নের অন্তিম অবস্থারই ইঙ্গিত। ... উনিশ শ' কুড়ির দশকে হাইজেনবার্গ, এরভিন শ্রয়েডিংগার এবং পল ডিরাক বলবিদ্যার পুনর্গঠন করে কণাবাদী বলবিদ্যা ( Quantam mechanics) নামক নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন তত্ত্বের ভিত্ত হলো অনিশ্চয়তাবাদ ( uncertainty)।
সাধারণত কণাবাদী বলবিদ্যার ( Quantam mechanics) ভবিষ্যদ্বাণীকে একটি পর্যবেক্ষণের একক সুনিশ্চিত ফল থাকে না। তার বদলে সে ভবিষ্যদ্বাণীতে থাকে অনেকগুলি পৃথক পৃথক ( different) ফলশ্রুতি।
তাছাড়া থাকে ফলগুলির প্রতিটির কতটা সম্ভাব্যতা। অর্থাৎ কেউ যদি বহু সংখ্যক সমরূপতন্ত্রের (Similar system) একই মাপ নেন এবং তাদের প্রতিটি যদি একইভাবে শুরু হয়ে থাকে, তাহলে দেখতে পাবেন বিশেষ সংখ্যক ক্ষেত্রে মাপন ফল হবে ক ভিন্ন আর কিছু ক্ষেত্রে মাপন ফল হবে খ এবং এই রকম (and so on)। কতবার ফল ক কিংবা খ হবে, সে সম্পর্কে একটা আসন্ন ( approximate) সংখ্যা ভবিষ্যদ্বাণীতে থাকতে পারে। কিন্তু একক একটি মাপনের বিশেষ ফল (স্পেসিফিক রেজাল্ট) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। সুতরাং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপস্থিত করেছে ভবিষ্যদ্বাণী করার অসম্ভাব্যতা কিংবা একটা এলোমেলো অনিশ্চিত অবস্থা (randomness)।
" (A BRIEF HISTORY OF TIME, পৃষ্ঠা : ৫৭-৬০)।
বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটা যেমন পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে খাটে, তেমনি জ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কেও। নইলে স্টিফেন হকিংকে ১৯৬৩ সালে তাঁর মোটর নিউরন ব্যধির (যাকে এ. এল. এস ব্যধি বলা হয়) জন্য ডাক্তার বলেছলেন যে, তিনি আর দু'বছর বাঁচবেন। স্টিফেন নিজেই বলেন, "আসলে যে ডাক্তার আমার রোগ নির্ণয় করেছিলেন, তিনি আমার দায়িত্ব ত্যাগ করলেন।
তিনি ভেবেছিলেন করবার মতো আর কিছু নেই। " হকিং বলেন- "কিন্তু আমি মরিনি। " (সূত্র : "কৃষ্ণ গহ্বর, শিশু মহাবিশ্ব ও অন্যান্য রচনা", স্টিফেন ডব্লু হকিং পৃষ্ঠা : ১৫৪ ও ২২)। স্টিফেন হকিং ২০০০ সনে এখনো আরো ৩৭ বছর বেঁচে আছেন। তাঁকে বলা হয়েছিলো যে, তিনি কখনোই জনক হতে পারবেন না।
অথচ তিনি বিবাহ করেছেন ও তিন সন্তানের জনক হন। তিনি প্রথম স্ত্রী পরিত্যাগ করে দ্বিতীয় স্ত্রীও গ্রহণ করেছেন। মাইকেল হোয়াইট ও ড. জন গ্রিবিন লেখেন : (অনুবাদ : বেশীরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে, চিকিৎসা ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক এবং হকিং আর অল্প দিন বাঁচবেন (পৃ:৬৩)। ১৯৮৫ সালে জেনেভার "সার্ন" নামক আণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বেড়াতে যান তিনি। হঠাৎ তার নিউমোনিয়া হরো যা মোটর নিউরন ব্যধিতে হয়ে থাকে ও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
স্টিফেন বলেন, আমার নিউমোনিয়া হলো। ফলে আমাকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। জেনেভার হাসপাতাল আমার স্ত্রীকে বলল, জীবন রক্ষার যন্ত্রটা চালিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু আমার স্ত্রী রাজি হলেন না। আমাকে বিমানে করে কেম্ব্রিজে এ্যাডেন ব্রুকস্ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
সেখানে রজার গ্রে নামক একজন সার্জন আমার উপর ট্রাকিওস্টমি অপারেশন করেন। এই অপারেশনে আমার জীবন বাঁচলো কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর চলে গেল। (সূত্র : কৃষ্ণ গহ্বর এবং শিশু মহাবিশ্ব ও অন্যান্য রচনা, পৃষ্ঠা ১৪৬)
উপরোক্ত তথ্য থেকে কি প্রতিপন্ন হয় ? ডাক্তার বৈজ্ঞানিকগণ হকিং-এর জীবনের আশা ও তাঁর জনক হবার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের কথা কি ঠিক হয়েছে ? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণীর যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, হকিং-এর বেঁচে থাকা ও জনক হওয়া তাই প্রমাণ করে। মানুষ নিজেকে যতবড় জ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক মনে করুক, সে সীমাবদ্ধতার বেড়ায় আটকা। তাহলে আমরাই বা কেন হকিং-এর ঈশ্বর সম্পর্কে সব তথ্য, তত্ত্ব, মন্তব্য ও কটাক্ষ বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করব ?
বর্তমানে পদার্থবিদগণ "Grand Unified Theory" (মহা ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব) আবিষ্কারে রত।
ড. হকিংও সে কোশেশ করে চলেছেন। এটা ভালো কথা। এ আবিষ্কারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হলে কারো আপত্তির কিছু নেই। তবে এটা আবিষ্কার হলে ধর্ম, ঈশ্বর, দর্শন সব শেষ হয়ে যাবে, হকিং ও কোন কোন পদার্থবিদের এ ধরণের ধারণা যথার্থ নয়। তাছাড়া খোদ হকিং তো বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন :
(অনুবাদ : "আমি এখনও জানার চেষ্টা করছি কিভাবে মহাবিশ্ব চলে, কেন মহাবিশ্ব এভাবে চলছে এবং কেন এটা আছে। আমি মনে করি, আমাদের সফলকাম হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে প্রথম দু'টি উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কিন্তু আমি খুব আশাবাদী নই এটা পেতে যে, কেন মহাবিশ্ব আছে"। (মাইকেল হোয়াইট ও জন গ্রিবিন, পৃষ্ঠা-২৯১)।
ভালো কথা, পদার্থবিদগণ চেষ্টা করছেন জানার জন্য যে, কিভাবে মহাবিশ্ব চলে, আর কেন এ ভাবেই চলে।
তবে তৃতীয় উদ্দেশ্য কেন মহাবিশ্ব আছে, কেন এ মহাবিশ্ব, কেন মানুষ, কেন জীবজন্তু, কেন এত সব - এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না বিজ্ঞানের গবেষণাগারে। ড. হকিং নিজেই এ সম্পর্কে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। তাহলে মানুষের কি প্রচেষ্টা থেমে গেছে এ প্রশ্ন জানার। এ প্রশ্নের উত্তর জানতেই তো মানুষ আদিকাল থেকেই আগ্রহী। কেন আমরা এখানে ? কেন এই মহাবিশ্ব ?
পদার্থবিদ্যা যদি এ প্রশ্নের জবাব নাই দিতে পারে, অন্যরা কেন চেষ্টা করবে না।
আমরা যদি এ প্রশ্নের জবাব না জানি, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই তো থাকে না ! আমরা কি গরু-ভেড়ার মতো জীবন যাপন করে মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব, না জীবনের কোন উদ্দেশ্য আছে ?
ড. হকিং যে তৃতীয় প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন তা নিয়ে পদার্থবিদদের চিন্তা-ভাবনায় কোন দোষ নেই। তবে অন্যরা কেন চিন্তা-ভাবনা করবে না ? দর্শন, অধিবিদ্যা (মেটাফিজিক্স), ধর্মতত্ত্ব, ইসলাম, কোরআন-হাদীস, রাসূলগণ, হযরত মুহাম্মদ (স), ড. হকিং-এর তৃতীয় প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। জবাব আমরা পেয়ে গেছি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে।
কোরআন মজীদে আল্লাহ বলেন : "আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং ওদের মাঝে কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি, যদিও অবিশ্বাসীদের ধারণা তাই। " (৩৮ সূরা সোয়াদ : আয়াত ২৭)।
"আকাশ ও পৃথিবী আর ওদের মাঝে কোনো কিছুই আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি যদি ক্রীড়ার উপকরণ চাইতাম তবে আমি আমার কাছে যা আছে তা নিয়েই তা করতাম, আমি তা করিনি। বরং আমি সত্য দিয়ে মিথ্যার ওপর আঘাত হানি; মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেই আর তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। " (২১ সূরা আম্বিয়া : আয়াত ১৬-১৮)।
"আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, আর দিন ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শন রয়েছে সেই বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য।
"
(৩ সূর আলে ইমরান : আয়াত ১৯০)।
"আমার দাসত্বের জন্যই আমি মানুষ ও জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি। "
(৫১ সূরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬)
"স্মরণ কর যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বলেন, 'আমি পৃথিবীতে (আমার) প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি। তারা বলল, 'আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে ? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতি গান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, 'আমি যা জানি তা তোমরা জান না এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন।
" (২ সূরা বাকারা : আয়াত ৩০-৩১)।
মহাবিশ্ব ও মানুষ কেন সৃষ্টি করা হয়েছে তার জবার পুরাপুরি জানা গেছে হযরত মুহাম্মদ (স) এর মাধ্যমে। বিজ্ঞান যা বলতে পারে নাই, তাই আমরা অন্যত্র পেয়েছি। বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বাভাবিক।
"এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যা, টলেমীর জ্যোতির্বিদ্যা বা গ্যালেনের চিকিৎসা শাস্ত্র আজকের বিজ্ঞানের সাথে কতটুকু অংশীদারত্ব দাবি করতে পারে ? এরিস্টটলের দুটি বিজ্ঞান গ্রন্থ (Physics ও On Heaven) সম্পর্কে বার্টান্ড রাসেল বলেছেন - "আধুনিক বিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে এই দুইটি বইয়ের লিখিত একটি বাক্যও আজ আর সময়োপযোগ নয়।
" (আলীয়া আলী ইজেতবেগোভিচ; প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম, রূপান্তর : ইফতেখার ইকবাল, আমান পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৬০)
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল প্রচার করেন, পৃথিবী শক্ত ও মজবুত ভাবে মহাবিশ্বের মাঝখানে স্থির ও অনঢ় হয়ে বসে আছে, আকাশ হলো একটি নিখুঁত, পূর্ণাঙ্গ এবং অপরিবর্তনশীল সৃষ্টি (Perfect sky)। গ্রীক জ্যোতির্বিদ টলেমি (১০০-১৭৮ ঈসায়ী) এর মতেও বিশ্ব সংসারের ক্রেন্দ্রস্থল হলো এই পৃথিবী; স্থির ও অনড়। Ian Radipath বলেন- For nearly 1500 years after ptolemy, astronomy in Europe, entered a period of total eclipse-the Dark age,” (Stars and Planets)
নিকোলাস কোপারনিকাস সূর্যকেন্দ্রিক ধারণা পেশ করলেন। একে বলা হলো হেলিও সেন্ট্রিক তত্ত্ব (Helio-centric theory)। ১৫৪৩ সালে মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পূর্বে প্রকাশিত তার On the Revolution of the Celestial Spheres এ তিনি বলেন, As if seated upon a royal throne, the sun rules the family on planets as they circle round. রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রচারিত পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাটির বিরোধিতা করায় গির্জা অসন্তুষ্ট হল।
মার্টিন লুথার ব্যঙ্গ করে বললেন, The fool wants to turn whole science of Astronomy upside down. ( অনুবাদ : বোকা জ্যোতির্বিদ্যাকে উপুড় করে পেরতে চাইছে। )
টাইকো ব্রাহে (Tycho Brahe 1546-1601) ১৫৭২ সালে বললেন যে, কোপারনিকাস যে বলেছেন - সূর্য স্থির। তা নয়- সূর্যও ঘুরছে। জোহান্স ক্যাপলার (১৫৭১-১৬৩০) যদিও টাইকোকে প্রথম দিকে স্বীকৃতি দিলেন কিন্তু পরে তিনি তাকে বাদ দিয়ে কোপারনিকাসকে সমর্থন করলেন। গ্যালিলিও ১৬০৯ সালে উন্নত টেলিস্কোপ দিয়ে বললেন- মহাবিশ্বে স্থির বলতে কিছুই নেই।
১৬৮৭ সালে নিউটন প্রমাণ করলেন যে সৃষ্টিতে কোথাও কোন বস্তু স্থির নয়, প্রতিটি নিরন্তর গতি নিয়ে চলছে।
উপরে দেখা গেলবিজ্ঞান এক স্থানে বসে থাকে নাই। মত ও তত্ত্বের পরবর্তন হয়েছে। বিজ্ঞানের এই হলো সীমাবদ্ধতা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি যে, কুরআন সেই ৭ম শতাব্দীতে বলছে - "সূর্য তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণে নিরত।
ইহা পরাক্রমশালী মহাজ্ঞানীর নির্ধারিত ব্যবস্থা। " (৩৬ : ৩৮)।
"তিনি (আল্লাহ) চন্দ্র ও সূর্যকে করেছেন নিয়মাধীন, প্রত্যেকেই পরিভ্রমণ করে একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত" (৩১ : ২৯)।
"আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবস; চন্দ্র ও সূর্য; প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে সঞ্চারণশীল। " (২১ : ৩৩)।
"সূর্যের সাধ্য নাই চন্দ্রকে সীমার মধ্যে পায়, রাত্রির সাধ্য নাই দিবসকে অতিক্রম করে। প্রত্যেকে স্ব-স্ব কক্ষপথে পরিভ্রাম্যমান" (৩৬ : ৪০)। ১৩ : ২, ৩৫ : ১৩ ও অন্যান্য আয়াতেও এমনি বক্তব্য রয়েছে।
কুরআন বলে - "এবং সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন জ্যোতির্ময় আর সূর্যকে করেছেন প্রদীপ্ত উজ্জ্বল। " (৭১ : ১৬)।
" "কত মহান তিনি, যিনি আকাশে সংস্থাপন করেছেন দুর্গ এবং ওর মধ্যে স্থাপন করেছেন প্রদীপ সদৃশ্য সূর্য এবং জ্যোতির্ময় চন্দ্র" (২৫ : ৬১)।
একটি বিকিরণ করে অন্যটি প্রতিফলন ঘটায়। এই ধরণের গবেষণার ফল বৈজ্ঞানিকগণ জেনেছে টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর সপ্তদশ শতকের দিকে। Ian Ridpath বলেন – “Astronomers of the time did not know the true nature of the stars nor did they realise that planets are non luminous bodies like the earth that shine by reflecting sunlight. This fact did not emerge until after the invention of telescope in 17th centuries” (Stars and Planets)
সূর্যসহ তারকারাশির মহাযাত্রা সম্পর্কে হ্যান বেস্ট বলেন - “All the local stars, including sun are heading in the direction of the constellation cygnus” (The Frame Work of the stars, Nigel Henbest)
বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে সম্পূর্ণ জ্ঞান আয়ত্তে। এ ক্ষেত্রে কুরআনে এসেছে স্বয়ং স্রষ্ট থেকেই জ্ঞানের কিছু যা মানুষ পূর্বে জানত না।
এটিও স্রষ্টার প্রমাণের একটি দলল ছাড়া আর কি ? নইলে ৭ম শতাব্দীতে একজন নিরক্ষর নবীর (হযরত মুহাম্মদ (স) মুখে এসব জ্ঞানের কথা, এসব বৈজ্ঞানিক তথ্য কোন জায়গা থেকে এল ?
জার্মান বিজ্ঞানী Reinhard Breuer বলেন - To my mind, either god must guide us in accordance wih our laws s that we can understand Him or He must improve our knowledge and make us as wise as He is, so that we can understand Him. We must not think, however, that god shares our views. (কাজী জাহান মিয়া কর্তৃক "আল কুরআন দ্যা চ্যালেঞ্জ / মহাকাশ পর্ব -১, ২৪০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। )
Ian Ridpath লেখেন - "It would be foolish to think that we have final answers to.... questions....of the universe...But, in say 50 years, our ideas may be completely different. In centuries to come, our present views of cosmology may seem as naive as those of the ancient greeks do to us "
(The Stars and Planets)
১৯৪৮ সালে থমাস গোল্ড, হারম্যান বন্ডি, ফ্রেড হোলি প্রমুখ বিজ্ঞানীদের 'স্টেডিস্টেট তত্ত্বে' বলা হয় যে, মহাবিশ্বের কোন আরম্ভ ছিল না, এ শুধু অনাদিকাল থেকে অবস্থান করছে। সময়-এর ব্যাপ্তিতে আপন হতে পদার্থ তৈরী হত এবং তা মহাবিশ্বের শূন্যস্থানকে ভরে দিত। আর এরূপ হত বলেই সকল সময় আমরা সৃষ্টিকে একইরূপে ও অপরিবর্তনশীল দেখতে পাই যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-এর দৃশ্যপটে দৃশ্যত কোন পার্থক্য সৃষ্টি করেনা। ( Ian Ridpath, The Stars and Planets)।
এই তত্ত্ব ১৯৫০ হতে ক্রমে ক্রমে দুর্বল হতে হতে ১৯৬৫ এর দিকে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়। বিজ্ঞানের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করে এই তত্ত্বের করুণ পরিণতি। এই তত্ত্বের লোপাটে এটি এখন স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণের সহায়ক হয়ে পড়েছে। মহাবিশ্ব যে সৃষ্ট বস্তু তা-ই প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু সৃষ্টিটা করল কে ? মহাবিশ্ব তো আর স্বয়ম্ভূ নয় !
-------------------------------------(চ্যাপ্টার এর আরো বাকী আছে।
না পড়ে মন্তব্য না করার অনুরোধ রইলো। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।