"‘কবর তো ইহকাল-পরকালের মাঝে একটা পর্দা মাত্র
অন্তত আশীর্বাদের ফোয়ারা।
তোমরা অবতরণ দেখেছ এবার চেয়ে দেখ আমার আরোহণ।
চন্দ্র-সূর্যের অসত্মাগমন কি বিপজ্জনক?
তোমাদের কাছে যেটা অসত্মাগমন, আসলে সেটাই উদয়ন। "
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি,কিন্তু বিশ্ব তাকে সংক্ষেপে রুমি নামে জানে। তিনি ত্রয়োদশ শতকের একজন ফারসি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক ছিলেন।
রুমি যে যুগে জন্মগ্রহন করেন তখন ভয়াবহ এক আলোড়ন চলছিল । কাব্য-সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি গদ্যও রচনা করেছেন। রুমির মাহাত্ম্য এখানেই নিহিত যে, তিনি অত্যন্ত সরাসরি দৈনন্দিন জীবনাচরণ থেকে উদাহরণ টেনে মহাসত্যকে জীবন্তভাবে উপস্খাপন করতে পেরেছেন। উন্মোচন করেছেন মানবাত্মার রহস্য। রুমি বিশ্বাস করেন, সৌন্দর্য মানব মনের চিরন্তন কাম্য।
কেননা আল্লাহ নিজেই সুন্দর এবং তিনি সব সৌন্দর্যের উৎস। আর মানবাত্মার প্রকৃত চাহিদা হচ্ছে খোদ আল্লাহ পাক।
যেদিন আমি মরে যাব, আমার কফিন এগিয়ে যাবে
সেদিন ভেবো না আমার অন্তর এই ধরাধামে রয়ে গেছে!
তোমরা অযথা অশ্রু বিসর্জন দিও না, হাহুতাশ করো না
‘হায়রে লোকটা চলে গেল’ এই বলে বিলাপ করো না।
আমার সমাধিকে অশ্রুজলে কর্দমাক্ত করে দিও না।
আমিতো মহামিলনের মহাযাত্রার অভিযাত্রী।
আমায় কবরে শোয়ালে ‘বিদায়’ জানাবে না,
কবরতো ইহকাল-পরকালের মাঝে একটা পর্দা মাত্র
অনন্ত আশীর্বাদের ফোয়ারা।
তোমরা অবতরণ দেখেছ এবার চেয়ে দেখ আমার আরোহণ।
চন্দ্র-সূর্যের অস্তাগমন কি বিপজ্জনক?
তোমাদের কাছে যেটা অস্তাগমন, আসলে সেটাই উদয়ন।
( জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি )
জালালউদ্দিন রুমি ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের বালাখে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বাহা ওয়ালাদ ছিলেন সর্বজনবিদিত পণ্ডিত ও সুফি।
বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর ভালোবাসা কিভাবে হাসিল করা যায় তার ওপর অনেক চিত্তাকর্ষক লেখা তিনি লিখেছেন। রুমি ৩ হাজার গজল (প্রেমের গান) রচনা করেছেন। আর এসব গজলের অনেকগুলোর সাথেই শামসের নাম বিজড়িত। ২৫ হাজার শ্লোক নিয়ে রচিত তার সঙ্কলনের নাম মসনবি। মসনবি হচ্ছে শিক্ষামূলক নীতিবাক্যের সমাহার।
এবং মানুষকে নীতিবোধে উজ্জীবিত করাই এর একমাত্র লক্ষ্য। আজ বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ম্যাডোনা ও তার মতো আরো অনেকে রুমির কবিতাকে গানে রূপ দিয়ে গেয়ে বিশ্বের দরবারে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করার প্রয়াস পাচ্ছেন।
"বন্ধু আমাদের ঘনিষ্টতা হচ্ছে
যেখানেই তুমি তোমার পা রাখবে
পদতলে দৃঢ়তার মাঝে
আমাকেই অনুভব করবে। "
( জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি )
রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে, অর্থাৎ তার বয়স যখন ৪০ বছর। এ বছর তিনি কনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন।
তার নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। তারা দু’জন নিষ্কাম প্রেমের বìধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিক প্রেমের ব্যাপারে এমন উৎকৃষ্ট সবক দিলেন যা তিনি ইত:পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি। এ অবস্খায় রুমির কাছে শামস যেন সৌন্দর্য ও মহত্বের মূর্ত প্রতিক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন, তিনি যেন আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় পাচ্ছেন।
এমতাবস্খায় এক দিন শামস নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শামস নিহত হয়েছেন বলে গুজব শোনা গেলেও রুমি নিজে তা বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। তবে এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, শামসের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরই রুমির কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে। রুমি অবশ্য তার অনেক লেখার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
"সমস্ত দিনমান ভেবে ভেবে আকুল আমি এখন রাত্রে বলছি শোনো,
কোথা থেকে এসেছি আর কেনই বা
আমি তার কিছুই জানি না
আমার আত্মা এসেছে অন্য কোথাও থেকে, হ্যাঁ আমি নিশ্চিত
এবং আখেরে সেখানেই ফিরতে চাই ।
"
( জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি )
তিনি ছিলেন প্রখ্যাত সাধক শামস-ই তাবরিজির শিষ্য। মনে করা হয়, খোরাসানের গোত্রীয় বিরোধ কিংবা মঙ্গোলীয় মহাপ্লাবনের কারণে রুমির বাবা খোরাসান থেকে দক্ষিণে কোনিয়ায় চলে যান। সেখানেই রুমির জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে। ফার্সি সাহিত্যের অন্য মরমী কবিদের মতো রুমিও তার রচনায় একত্ববাদ বা 'তাওহীদ'বাদকে তুলে ধরেছেন। তার বিশ্বাস_ সংগীত ও কবিতার মধ্যেও স্রষ্টার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সম্ভব।
বহু ভাষাতেই তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। বাবার কবরের পাশে তাকে কোনিয়ায় সমাধিস্থ করা হয়। তার সমাধিটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে পারস্য সাম্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ছিল। এর বিস্মৃত ছিল বিশাল ভূখণ্ডজুড়ে।
আফগানিসত্মান, ইরাক, তুরস্ক এবং উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চল পারস্যের সাথে একীভূত ছিল। ইসলামের দ্রুত প্রসারের ফলে পারস্য ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা দেখা যায়, পৃথিবীর জ্ঞানী গুণীদের একটি বড় অংশের জন্ম হয়েছে এ অঞ্চলে। ইবরাহীম আদহাম, শাকীক বালখী, ফাজেল ইবনে আয়াজ, বায়েজীদ বোসত্মামী, হুসাইন, ইবনে মনসুর হাললাজ, আবু আলী ইবনে সিনা, আবু নাসর শিরাজ তুসী, উসমান হিজভিরী গাজনাভী, ইমাম আবু হামেদ গাজ্জালী , আবদুর কাদের জিলানী, শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তার নিশাপুরী, মাওলানা জালালউদ্দীন রম্নমী, খাজা হাফেজ শিরাজী, আবদুর রহমান জামী প্রমুখ অন্যতম। তারা তাদের মহৎ কাজ ও সৃষ্টির মাঝে আজো বেঁচে আছেন।
এই মহা মনীষীদেরই একজন ফারসি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।