(আপনারা অনেকেই এই অনুবাদ পড়েছেন। কিন্তু মন্তব্য করেছেন মাত্র কয়েকজনই। প্রত্যেকেরই মন্তব্যই আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছি। প্রথমেই বলে রাখি যে পশ্চিমবঙ্গে এই লেখার ২/৩টি অনুবাদ আছে, বাংলাদেশে কেউ করেছেন কি না আমার জানা নাই। আগে যেহেতু অনুবাদ হয়েছে সে কথা মাথায় রেখে আমি অনুবাদটা একটু নূতন ঢংয়ে করতে চেষ্টা করেছি, তা করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যাও হয়েছে।
কেউ বলেছেন ভাষা নিষ্প্রাণ হয়েছে, কেউ বলেছেন কিছুটা জটীল হয়েছে। তবে আপনাদের মনে রাখতে হবে যে জিব্রানের এই লেখাটি একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা এবং কবিতার মধ্যে রহস্যবাদের (mysticism) স্পষ্ট ছোঁয়া আছে। আমি সেই আবহকে ধরার জন্য এই ভাষা ও ছন্দ প্রয়োগ করার প্রয়াস পেয়েছি। কতটা সফল হয়েছি সেই বিচারের দায়িত্ব আপনাদের। যাইহোক্ আপনারা পড়তে থাকুন এবং আপনাদের সুচিন্তিত মন্তব্য প্রকাশ করুন - এই আশা আমার।
)
এইসব বলল সে। না বলা যে রয়ে গেল অনেক কিছুই
হায়! কিছুতেই বলা হ’ল না তার অন্তরাত্মার গভীর গোপন অনেক কিছুই।
যখন প্রবেশ করল সে নগরে
তার দর্শনলাভের ব্যাকুলতায় আবালবৃদ্ধবণিতার আকুল আহ্বান ধ্বনিত হ’ল সমস্বরে।
নগর জনপদবাসী বয়োজ্যেষ্ঠজনরা এগিয়ে এল তার সম্মুখে, তার উদ্দেশ্যে বলল:
তুমি এখনই ছেড়ে চলে যাবে না আমাদের, তুমি বল
তুমি সায়াহ্ণকালের মধ্যাহ্ণজোয়ার, তোমার জীবনযৌবনই স্বপ্ন দান করেছে স্বপ্নদর্শনের আমাদের
তুমি অনাত্মীয় নও অজ্ঞাত অতিথিও নও, তুমি পুত্র তুমি প্রিয়তম আমাদের
তুমি আমাদের চোখের জলে ভাসিয়ে যেও না, তোমারই মুখদর্শনের ক্ষুধার্ততা যে আমাদের।
এবং যাজক যাজিকারা তার উদ্দেশ্যে বলল:
আমাদের যেন বিচ্ছিন্ন না করে সমুদ্রের এই তুফানতরঙ্গ।
জীবনভোর সম্বৎসরকাল কাটিয়েছ আমাদের মাঝে তুমি, তার স্মৃতি যেন স্মরণে বিস্মরণে রয়ে যায় অমলিন, তুমি বল
আমাদের মধ্যে হেঁটে বেড়িয়েছ তুমি তোমার সর্ব্বাত্মায়
আমাদের মুখাবয়ব উজ্জ্বল উচ্ছল আলোকিত হয়েছে তোমার প্রপতিত সেই ছায়া উপচ্ছায়ায়।
কত ভালোবেসেছি আমরা তোমাকে নির্ব্বাক নির্ভাষ ভালোবাসার উপচার অবগুন্ঠনে
এখন তা চিৎকৃত রোদনে বিলাপ করছে তোমার সম্মুখে নিরাবৃত অনবগুন্ঠনে
বিচ্ছেদক্ষণেই কি ভালোবাসা অতলান্ত গভীরতায় বিদিত হয় চিরন্তন,
অলোখনিরঞ্জন কি সেই ভালোবাসা মন্থন?
এবং আরও কতশত জন এল বিনতি করল তাকে। নিরুত্তর রইল সে কোন জবাব এল না তার কাছ থেকে। শুধু সে আনত করল মস্তক তার, সম্মুখে যারা যারা দাঁড়িয়েছিল তারা শুধু লক্ষ্য করল বক্ষ বেয়ে তার প্রবহমান অশ্রুধারা।
সে এবং সমুদয় মানুষজন অগ্রসর হ’ল দেবালয় চত্বরের দিকে, জনে জনে তারা।
এবং উপাসনার অভয়ারণ্য থেকে বেরিয়ে এল রমণী আল্ মিৎরা, সে ভবিষ্যবাদিনী
পরম করুণার দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে দেখল সে। সে-ই প্রথম পরম প্রার্থিতা, নগরের প্রথম দিন থেকেই সে তার একান্ত অনুগামী, সে পরম সম্ভাষিণী
সম্ভাষণ করে সে বলল:
হে পরমপিতার প্রাণিত দরবেশ! সর্ব্বোচ্চ ও সর্ব্বোত্তমের সন্ধানী, জানি জাহাজের প্রতীক্ষায় তুমি কত দীর্ঘ দূরত্ব পাড় হ’য়ে এসেছ কত দীর্ঘকাল হ’ল
তোমার সেই জাহাজ আজ ভিড়েছে বন্দরে, তোমাকে যেতেই হবে এবার
দেশকালের স্মৃতি ও মহোত্তর অভিলাষের কাঙ্খিত আবাসভূমির আকাঙ্খা তোমার, আমাদের প্রতি নির্বিকল্প ভালোবাসা তোমার তোমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না আর, তোমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না আমাদের প্রয়োজনের তাগিদ, তোমাকে যেতেই হবে এবার।
বিদায় ক্ষণে আমাদের প্রার্থনা তাই তুমি ব্যক্ত ও বিদিত কর তোমার উপলদ্ধ সত্য সন্দর্শন, আমাদের জন্য রেখে যাও তা তুমি
আমরা আমাদের সন্তানসন্ততিদের জন্য রেখে যাব, তারা তাদের সন্তানসন্তদিদের জন্য রেখে যাবে তোমার সেই অমর অক্ষর সন্দর্ভ, আমাদের জন্য রেখে যাও তুমি।
আমাদের দিবসরাত্র প্রত্যুতমান তোমার নিভৃত একাকীত্বে, তোমার জাগরণে তুমি শুনেছ আমাদের নিদ্রাঘাত হাসিকান্নার তরঙ্গ নিস্তরঙ্গ
এখন ব্যক্ত কর জীবনমৃত্যুর যা কিছু যত কিছু অভিজ্ঞাত হয়েছ তুমি আমাদের কাছে, তুমি জীবন রণরঙ্গ।
জবাবে বলল সে:
হে অর্ফালিজবাসীগণ! তোমাদের নিবিষ্ট আত্মায় যে সংলাপ ছড়িয়ে আছে তা ছাড়া আর কী-ই বা আমি ব্যক্ত করতে পারি নির্বিশেষে?
তারপর আল্ মিৎরা বলল তাকে, তুমি আমাদের ভালোবাসার কথা বল, ভালাবাসার সেই ভাবমন্ত্র অনুস্বরে।
তার মস্তক উন্নত করল সে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল জনসঙ্গমে, নিরুচ্চার্য্য নীরবতায় আচ্ছন্ন হ’ল তারা। এবং বলল সে মন্দ্রিত কন্ঠস্বরে:
ভালোবাসার ইশারা পেলে তাকে অনুসরণ কর,
তার পথ যদিও দুর্গম ও বন্ধুর বড়,
তার পক্ষপুট প্রসারিত হ’লে তাতে আত্মসমর্পিত হও, তোমরা সমর্পণ কর নিজেদেরকে
তার পক্ষপুটের গুপ্ত গুপ্তি ক্ষতবিক্ষত করতেও পারে বা তোমাদেরকে
তার ব্যক্ত অভিব্যক্তিতে তোমরাি আস্থান্বিত হও অবলীলায়
তার কন্ঠস্বরে স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও পারে বা তোমাদের যেমন উত্তরীয় বাত্যাবহে ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত হয় উদ্যানবাগিচা, হায়!
ভালোবাসা তোমাদেরকে শিরঊষ্ণীষে অভিষেক করবে তোমাদেরকে ক্রশে বিদ্ধ করবে
ভালোবাসা তোমাদেরকে সম্প্রসারিত করবে আবার সঙ্কুচিতও করবে
ভালোবাসা তোমাদের সমুচ্চতায় উঠে তোমাদের রৌদ্রে শিহরিত পেলব শাখাপ্রশাখাকে আলুলায়িত করবে
ভালোবাসা আবার তোমাদের মৃত্তিকামূলে নেমে এসে তাকে মার্তণ্ডে জেরবার করবে।
ভালোবাসা তোমাদের শস্যের আটির মত নিজের হৃদয়বক্ষে ধারণ করবে
তোমাদেরকে মাড়াই করে খোসামুক্ত নিরাবরণ করবে, ঝাড়াই করে তুষ থেকে আলাদা করবে
তোমাদেরকে পেষাই করে শুভ্রতামণ্ডিত করবে
তোমাদেরকে দলাইমলাই করবে আর তোমরা কমনীয় নমনীয় হ’য়ে উঠবে
এবং তারপর ভালোবাসা তোমাদেরকে পূত অগ্নিতে উৎসর্গ করবে আর তোমরা পরমেশ্বরের পবিত্র ভোজনের রুটী হ’য়ে উঠবে।
ভালোবাসা তোমাদের সাথে এইমত আচরণ করবে আর তেমরা তোমাদের গভীরগোপন হৃদয়রহস্য বিদিত হ’য়ে উঠবে
আর সেই অভিজ্ঞানে তোমরা জীবনহৃদয়ের আসঙ্গ সঙ্গী হ’য়ে উঠবে।
কিন্তু ভয়ে শঙ্কায় কাপুরুষতায় যদি তোমরা ভালোবাসার সুখ ও শান্তির সন্ধানী হও
তাহলে বরং তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে নিরাবরণ নিরাবৃতিকে ঢেকে লও, ভালোবাসার পেষণাগার থেকে তোমরা মুক্ত হও
তোমরা ঋতুহীণ নৈঋত পৃথিবীতে ফিরে যাও, সেখানে হাসতে পারবে তবু হাসবে না, কাঁদবে তবু অশ্রুনিপাত হবে না, সেই পৃথিবীতেই তোমরা ফিরে যাও, তোমরা মুক্ত হও।
ভালোবাসা নিজেকে ছাড়া কিছু অর্পণ করে না, নিজের থেকে ছাড়া কিছুই গ্রহণ করে না
ভালোবাসা অধিকার করে না, অধিকৃতও হয় না
ভালোবাসা ভালোবাসাতেই সম্পূর্ণ, আর কিছুতেই সম্পূর্ণ হয় না।
ভালোবাসলে কখনই তোমরা কেউ বোলো না ”আমার হৃদয়ের অধীশ্বর ঈশ্বর”, বরং বোলো ”অধীশ্বর ঈশ্বরের হৃদয়ে আমি অধীস্থ”
এবং কখনই ভেবো না তোমরাই ভালোবাসার পথনির্দ্দেশ, ভালোবাসার যোগ্য হ’লে ভালোবাসাই হবে হবে তোমাদের পথনির্দ্দেশ, তোমরাই হবে ভালোবাসাতে অধীস্থ।
নিজেকে চরিতার্থ করা ছাড়া ভালোবাসার আর কোন কামনা নাই
কিন্তু ভালোবাসলে তোমরা ভালোবাসার কামনানিষিক্ত হও, তোমাদের কামনা ভালোবাসানিষিক্ত হউক্ তাই:
দ্রবণে দ্রবীভূত বহমান স্রোতোধারায় যেমন রাত্রিনিশীথে কলতান মন্ত্রণা
আত্মজ চেতনায় ভালোবাসা মরমী হৃদয়ের আকুতি যন্ত্রণা
এবং সানন্দে আত্মবিদীর্ণ রক্তাক্ততায় ভালোবাসার অভিবাসন।
সুপ্রভাতের পক্ষবিহারী ডানায় হৃদয়ের উন্মেষে অনুবর্তী দিবসরাত্রির কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন, ভালোবাসায় অভিবাসন
দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রান্তে পরমানন্দে ভালোবাসার অনুধ্যান
সায়াহ্ণলগ্নে নিজবাসে আবার নীড়ে ফিরে এসে দিবসান্তের আনন্দধ্যান
এবং তারপর তোমার প্রার্থিত প্রেমাষ্পদের প্রতি আপন ওষ্ঠাধরে নিঃসৃত প্রার্থনা সঙ্কীর্তণে নিদ্রাধ্যান।
(ক্রমশঃ প্রকাশিতব্য...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।