আমি একজন সাধারন মানুষ। অপ্রতিরোধ্য এক দরবেশ!
সাম্প্রতিক সময়ে দরবেশ নামেই তিনি পরিচিত। হাঁটু অব্দি নামানো দীর্ঘ পাঞ্জাবী-পায়জামা পরা শুভ্র শ্মশ্রুম-িত এই ব্যক্তিটিকে প্রথম দর্শনে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই চেহারার অন্তরালে রয়েছেন, একজন প্রবল পরাক্রমশালী ব্যবসায়ী। যার অঙ্গুলি হেলনে এখনো পর্যন্ত চালিত হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। বরং তাকে দেখে একজন নিরীহ, খোদাভক্ত বুজুর্গ ব্যক্তি বলেই মনে হবে সবার।
হাঁ, সন্দেহাতীত ভাবেই তিনি সালমান এফ রহমান। এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম সমালোচিত এবং বিতর্কিত একটি নাম। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের অন্যতম এক খলনায়ক হিসেবে তদন্ত রিপোর্টে প্রমাণিত হওয়ার পর দেশব্যাপী একটি নিন্দনীয় নামও বটে। তবে এমন একটি সময় ছিল, যখন তার মালিকানাধীন বেঙ্মিকো গ্রুপটি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিল। বেঙ্মিকো ফার্মা এদেশের ওষুধ শিল্পে অন্যতম একটি স্থান দখল করেছিল।
সেই সময় তাকে অনেকটা পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী হিসেবেই চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু যতই দিন গেছে একের পর এক তিনি জড়িয়ে পড়েছেন বিতর্কিত সব ঘটনায়। আরও সম্পদ বাড়িয়ে তোলার নেশায় পা বাড়িয়েছেন ঋণ খেলাপ, জমি জালিয়াতি এবং শেয়ার কেলেঙ্কারি ও প্রতারণার মত অনৈতিক পথে। আর এসবের মাধ্যমে মানুষের অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এসব কারণে অনেককে এমনও বলতে শোনা যায়, একজন মানুষের আর কতটা সম্পদ অর্জিত হলে এই ধরনের অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন বন্ধ হতে পারে?
এক নজরে সালমান এফ রহমান
বাংলাদেশ এঙ্পোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানি বা বেঙ্মিকো তাদের যাত্রা শুরু করেছিলো ১৯৭২ সালে।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেঙ্মিকো উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করে। আশির দশকে ওষুধ শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ হবার পরে বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যালসে বিনিয়োগ করে।
এরপর আসে টেঙ্টাইলসের খাতে বিনিয়োগ। এখন বেঙ্মিকো বিমান পরিবহন খাতকেও তাদের ''কোর বিজনেস"-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু ৯০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সমপ্রসারণের পাশাপাশি সালমান এফ রহমান ঢুকে পড়েন রাজনীতিতে।
প্রথমে 'সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন' নামে একটি দল গঠন করেন। পরে যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। রাজনীতিতে যোগ দেবার ফলে প্রথমদিকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষত ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বেঙ্মিকোকে বেশ খারাপ সময় পার করতে হয়। আর ২০০৭-২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে প্রায় দু'বছর জেলে থাকতে হয়েছে।
কিন্তু এর পরপরই তিনি এই সব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় বসার পর কেবলই তড়তড় করে এগিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হন। এর ফলে ২০০১ থেকে দীর্ঘদিন যে আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে চলছিলেন তা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেন।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি
শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নাম এখন সালমান এফ রহমান।
সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য তো বটেই ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার আগের দফায় ক্ষমতায় আসার চার মাসের মধ্যেই যে বড় শেয়ার কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়, তার সাথেও ছিল এই দরবেশের সরাসরি যোগাযোগ। তখনও কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল সালমান এফ রহমানের বেঙ্মিকো গ্রুপ।
ওই ঘটনায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান ও ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিলো। কিন্তু এই ঘটনার অন্যতম অংশীদার বেঙ্মিকো ও শাইনপুকুরের বিরুদ্ধে মামলার কোনো অভিযোগই গঠন করা সম্ভব হয়নি। মামলা করার পরের দিনই প্রতিষ্ঠান দু'টির ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান।
উচ্চ আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা যাবে না বলে জানানো হয়। পরে আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে এসইসি। কিন্তু তারপরও আজ পর্যন্ত ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। সালমান এফ রহমান এখন বাংলাদেশ লিস্টেড কোম্পানিজ এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হওয়ায় ক্ষমতাবলে এসইসি'র পরামর্শক কমিটিরও সদস্য। একই ক্ষমতাবলে তার পরামর্শ এবং ইশারায় সিদ্ধান্ত নিতে হয় এসইসিকে।
ফলে আগে যেমন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এখনও তা হচ্ছে না।
অথচ ওই সময়ের তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ সরকারের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে। কিছু সুপারিশসহ প্রতারণা ও কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও দর পতনের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দেয়া হয়। কিন্তু তা এই ব্যবসায়ীকে শাস্তি দেয়ার জন্য যথেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
এবারের শেয়ার কেলেঙ্কারি
২০০১ সালে বিএনপি সরকার আসার আগ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গ্রুপ ছিল বেঙ্মিকো।
কিন্তু এই সময় থেকেই মূলত বেশ আর্থিক কষ্টে পড়ে যান তিনি। বিএনপি শাসনামলসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন আকার ধারণ করে যে তিনি তার কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিলেন না। বেঙ্মিকোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে টাকার যোগান দিয়ে কোম্পানিকে কোনভাবে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু এরপর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই রাতারাতি তার সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে।
২০০৯ সাল থেকে বেঙ্মিকোর বিভিন্ন কোম্পানির নামে নেয়া হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করে। এই সময়ের মধ্যে বেঙ্মিকো ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সাত বছর ধরে জমতে থাকা ঋণের বোঝার প্রায় অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি ২০০৯-এর মাঝামাঝি থেকে তারা দেশে একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিতে শুরু করে। এভাবে ঋণের ভারে জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠান রাতারাতি তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে। জিএমজি এয়ারলাইন্স, ওয়েস্টিন হোটেল, বিডিনিউজ২৪-এর মালিকানা, সিঙ্গারের মত একটা বিশাল কোম্পানি, ইউনাইটেড হাসপাতাল, একটা বিখ্যাত স্কুল ইত্যাদি কিনে ফেলে।
হঠাৎ করে এই ব্যবসায়ীর হাতে বিপুল যে ক্যাশ জমা হতে দেখা গেছে- এর পেছনে আছে লাখ লাখ যুবক-যুবতী, গৃহবধূ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সর্বনাশের ইঙ্গিত। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে পুঁজিবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার মাধ্যমে দরবেশ নামে খ্যাত সালমান এফ রহমান তার কয়েক বছরের আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন।
১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারের কেলেঙ্কারিরও অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি তা আগেই বলা হয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান সরকারের বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত থাকায় পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনে আরো বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছেন। দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ভেঙে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেঙ্মিকো গ্রুপ-এর সহযোগী চার প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণের শেয়ার বিক্রি করেছেন।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ এন্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অনুমোদন সাপেক্ষে স্টক এঙ্চেঞ্জের মাধ্যমে ৩০ দিনের আগাম ঘোষণার বিধান রয়েছে। কিন্তু বেঙ্মিকো লিমিটেড, বেঙ্মিকো টেঙ্টাইল (বেঙ্টেঙ্), বেঙ্মিকো ফার্মা, বেঙ্মিকো সিনথেটিকের পরিচালকরা গত দেড় বছরে প্রায় ১৬৫০ কোটি টাকার স্পন্সর শেয়ার বিক্রি করলেও স্টক এঙ্চেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির কোন ঘোষণা দেয়নি। এটি সিকিউরিটিজ আইনে অপরাধ হলেও এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) প্রকাশিত মাসিক রিভিউ ও ওয়েবসাইট সূত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালের মে মাসে বেঙ্মিকো টেঙ্টাইলের পরিচালকদের শেয়ার ৩৯.৪৭ শতাংশ থাকলেও ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তা ২০.১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ উক্ত সময়ের মধ্যে ১৯.৩২ শতাংশ শেয়ার বেঙ্টেঙ্রে পরিচালকরা বিক্রি করেছেন।
উল্লেখিত সময়ে শেয়ারের গড় মূল্য ৮৩ টাকা অনুযায়ী প্রায় ৭৪৯ কোটি ৫২ লাখ টাকার শেয়ার পরিচালকরা বিক্রি করেছেন। কিন্তু ডিএসই'র ওয়েবসাইটে এ শেয়ার বিক্রির কোন ঘোষণা দেখা যায়নি। ২০০৯ সালের মে মাসে বেঙ্মিকো ফার্মার পরিচালকদের শেয়ার ২০.৬৩ শতাংশ থেকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১০.৯১ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়ে কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তাদের হাতে থাকা ৯.৫৮ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন। শেয়ারের গড় মূল্য অনুযায়ী শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এ কোম্পানির পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রায় ৬৮৩ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন।
এক্ষেত্রেও স্পন্সর শেয়ার বিক্রির কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। একই সময়ের মধ্যে বিবিধখাতের বেঙ্মিকো লিমিটেডের পরিচালকদের শেয়ার ২৪.৮৮ থেকে ২১.২৬ শতাংশে নেমে এসেছে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বেঙ্মিকো লিমিটেডের পরিচালকরা বাজার থেকে প্রায় ২১১ কোটি টাকা তুলেছেন। একই সময়ে বেঙ্মিকো সিনথেটিকের পরিচালকরা ৬.৩২ শতাংশ শেয়ার প্রায় ২০ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন। এসব শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রেও কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি।
অপরদিকে স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে বেঙ্মিকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো কোন আগাম ঘোষণা না দিলেও শেয়ারের দরবৃদ্ধিতে উল্লেখিত সময়ে বিভিন্ন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ২০০৯ সালে জুলাই মাসে বেঙ্মিকো লিমিটেড কর্তৃক জিএমজি এয়ারলাইন্সের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয়, আগস্টে বাংলাদেশ অনলাইন অধিগ্রহণের ঘোষণা দেয় বেঙ্মিকো। এছাড়া ২০১০ সালের জুন মাসে ইউনিক হোটেল এন্ড রিসোর্টের ১৬০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা ও জুলাই মাসে ঢাকা-সাংহাই সিরামিক অধিগ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া গত বছরের আগস্ট মাসে বেঙ্মিকো টেঙ্টাইল কর্তৃক নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেডের ৩৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনার ঘোষণা। এসব ঘোষণার মাধ্যমে বেঙ্মিকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বাড়ানোর সুযোগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিচালকরা ঘোষণা ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করেন।
এ বিষয়ে এসইসি'র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এভাবে স্পন্সর শেয়ার বিক্রি সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থী। এ ধরনের কিছু হয়ে থাকলে এসইসি ও ডিএসই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি।
সালমান গংদের নীল নঙ্ায় পুঁজিবাজারে যখন শেয়ারের অতি মূল্যায়ন চলছে ঠিক সে সময় মাত্র দু'টি কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে বাণিজ্য মন্ত্রীর পরিবারও পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কেপিসিএল'র ৫২ কোটি টাকার শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে ১১০০ কোটি টাকা এবং ওসিএল'র ১১.৯ কোটি টাকার শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করে।
অথচ একই সময়ে সালমানের মালিকানাধীন জিএমজি এয়ারলাইন্স সরাসরি তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়। এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করেন সালমান এফ রহমান। এতে দুই পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এর একটি হচ্ছে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়ে পূর্বে কম মূল্যে কেনা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা উপার্জন। অপরটি হচ্ছে- শেয়ারের অতি মূল্যায়নের সময়ে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মাধ্যমে জিএমজি এয়ারলাইন্স, এপোলো হসপিটাল, হোটেল ওয়েস্টিনসহ আরো কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া।
তবে বিতর্ক থাকলেও শেয়ার ছেড়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি জায়েজ করে নেয়া হয়েছে। কেপিসিএল, ওসিএল-এর মাধ্যমেও এভাবে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
সালমান রহমান থেকে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ
পুঁজিবাজারের সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত ব্যক্তি সালমান এফ রহমান-এর বিরুদ্ধে বাজারের উত্থান-পতন এবং বিভিন্ন ধরনের কারসাজির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলেও তদন্ত রিপোর্টে তাকে রেহাই দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। পুঁজিবাজারে ফিঙ্ড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং. সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সকল ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে এবং এর সাথে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কমিটি।
অথচ এতোসব অনিয়মের সাথে সালমান এফ রহমানসহ আরও বেশ কয়েকজন জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্ত কমিটি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কোন সুপারিশ করেনি। বরং সালমানসহ অন্যদের অপরাধ এসইসি'র কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা হিসেবে বেঙ্মিকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও ডিএসই'র সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমানের ব্যাপারে সরকারকে কেবল সতর্ক থাকার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এটি না করলে পুঁজিবাজারে আবারও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে তদন্ত কমিটি।
যদিও শেয়ারবাজারে ব্যাপক কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি)-র নির্বাহি পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়া এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-র সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক কফিল উদ্দিন চৌধুরীর (বর্তমানে হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক) বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি দুর্নীতির মামলা করারও সুপারিশ জানানো হয়েছে।
অথচ বেঙ্মিকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং ডিএসই'র সাবেক প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমানের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সতর্ক থাকাই যথেষ্ট বলে মনে করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির মতে, পুঁজিবাজারে প্রভাব রাখতে সক্ষম এ দু'ব্যক্তি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে এসইসি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এর ফলে আবারও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে শেয়ারবাজারে। জানা গেছে, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত তদন্তকালে কমিটি এ দু'জনের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক মতামত পেয়েছিলেন। এসইসিকে প্রভাবিত করতে দু'জনই সক্রিয় ছিলেন বলে তারা ধারণা পেয়েছেন।
কমিটির মতে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি পরিচালনায় এ দু'জনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ছিল। এ কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও মনে করেছে কমিটি।
এত কিছু প্রমাণ পাওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থার সুপারিশ করার পরিবর্তে সরকারকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এটাই প্রমাণ করা হয়েছে যে, সরকারের চেয়েও অধিক ক্ষমতাশালী এই ব্যবসায়ী।
জমি জালিয়াতি
সালমান এফ রহমানের বিভিন্ন অপকর্মের মধ্যে জমি জালিয়াতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার উপকন্ঠে কালিয়াকৈরে সাধারণ মানুষের প্রায় ২৪১ একর জমির জাল দলিলের মত প্রতারণার সাথে তিনি জড়িত।
২০০০ সালের গোড়ার দিকে বেঙ্মিকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেঙ্মিকো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট লি. এই সব জমির ভুয়া দলিল নিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকে গিয়েছিল, বড় অংকের ঋণের জন্য। ব্যাংক-এর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরবর্তীতে এসব জমির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে যে জমিগুলো আসলে ক্রয়ই হয়নি। কিন্তু বেঙ্মিকো গ্রুপ ব্যাংক কর্মকর্তার মুখ বন্ধ করে দেন বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে। যদিও এসব ঘটনা ততদিনে অনেকেই জেনে যায়। জমির মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে গাজীপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের শরণাপন্ন হলেও অদৃশ্য কারণে তিনি তাদের সেভাবে সাহায্য করেননি।
এরপর তারা তৎকালীন ইউএনও'র কাছে ধর্ণা দিলে তিনি তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ব্যক্তিগতভাবে ইউএনও খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হন যে, প্রকৃত মালিকরা বেঙ্মিকোর কাছে জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। বরং রেজিস্ট্রি অফিসে ভুয়া মালিক সাজিয়ে এসব দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এরপর ইউএনও লিখিতভাবে বেঙ্মিকো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট লি. কে নোটিশ করেন। এই সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ওই ইউএনওকে নানা লোভ এবং ভয়ভীতি দেখিয়েও ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়।
বরং একপর্যায়ে ইউএনও নিজে বাদী হয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। এই জমি জালিয়াতির সঙ্গে সালমান এফ রহমান সরাসরি জড়িত দাবি করে তিনি আরজির সাথে ১০৮ পৃষ্ঠার তথ্য প্রমাণও জুড়ে দেন।
মামলা দায়েরের পর বেঙ্মিকো মরিয়া হয়ে ইউএনও এবং থানার ওসিকে ম্যানেজ করতে সকল চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু ইউএনওকে কোনভাবেই ম্যানেজ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাকে বদলি করিয়ে দেন। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই এই মামলাটিরও কবর রচিত হয়।
থানার তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইউএনও'র সেই মামলাটিকে এমনভাবে ধামাচাপা দিয়ে দেন যে, এ সংক্রান্ত নথিপত্র এখন খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।
শীর্ষ ঋণ খেলাপি
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি। যা দেশে ব্যাংক খাতে সুদের হার চড়া পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। এ ছাড়া এই কারণে হাজার হাজার উদ্যোক্তার ঋণপ্রাপ্তি ও বিনিয়োগে বাধা তৈরি হয়েছে। তাই বলা হয়ে থাকে যে, দেশের ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধির অন্যতম বড় বাধা হলো এই খেলাপি ঋণ।
আর দেশের খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেঙ্মিকো অনেক পুরনো ও শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম। গত দুই দশকে সর্বোচ্চ ঋণখেলাপিদের মধ্যে অন্যতম বেঙ্মিকোর খেলাপি ঋণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সে মতে সালমান এফ রহমান দেশের একজন শীর্ষ ঋণ খেলাপি হিসেবে পরিচিত।
২০০৯ সালের মাঝামাঝি সংসদে শীর্ষ ১০ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রদান করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তালিকাটিতে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম এসেছে সেগুলো হল- ১. বেঙ্মিকো টেঙ্টাইলস লি. ২. পদ্মা টেঙ্টাইল মিলস লি. ৩. বিজেএমসি ৪. বিটিএমসি ৫. এসডিএস ইন্টারন্যাশনাল লি. ৬. শাইনপুকুর হোল্ডিংস লি. ৭. মাগুরা পেপার মিলস লি. ৮. আদমজী জুট মিলস লি. ৯. ফেয়ার এঙ্পো ওয়েভিং মিলস এবং ১০. বেঙ্মিকো নিটিং লি. ইত্যাদি।
দেখা যাচ্ছে ওই সময় পর্যন্ত ঋণ খেলাপি তালিকার শীর্ষে ছিল বেঙ্মিকো টেঙ্টাইলস। এ ছাড়াও শীর্ষ দশের মধ্যে বেঙ্মিকো গ্রুপের আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল। বেঙ্মিকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পদ্মা টেঙ্টাইলের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ষষ্ঠ স্থানেও আছে বেঙ্মিকো গ্রুপের শাইনপুকুর হোল্ডিংস। শাইনপুকুরের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১৩৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
শীর্ষ দশের সর্বশেষ কোম্পানি বেঙ্মিকো নিটিংয়ের মোট খেলাপি ঋণ ৮১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর বাইরে ২১তম স্থানে রয়েছে বেঙ্মিকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেঙ্মিকো ইঞ্জিনিয়ারিং। তাদের খেলাপি ঋণ ৫৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ৫৫তম খেলাপি বেঙ্মিকো ডেনিমস। যার খেলাপির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
তালিকায় ৩২৯ নম্বরে থাকা বেঙ্মিকো কম্পিউটার্সের মোট খেলাপি ঋণ ১১ কোটি দুই লাখ টাকা এবং ৩৬৮তম খেলাপি বেঙ্মিকো ফ্যাশনস লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বেঙ্মিকো গ্রুপের আট প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হল ৯৮১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
অর্থমন্ত্রীর দেয়া হিসাব অনুযায়ী ২০০৯-এর মার্চ শেষে দেশে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৫৮৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা; যা সেই সময় পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা দুই লাখ ১২ হাজার ৪৪ কোটি টাকার ১১ দশমিক ১২ শতাংশ। এর মধ্যে একা বেঙ্মিকো গ্রুপের আট প্রতিষ্ঠানেরই মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৯৮১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
যদিও পরবর্তীতে শেয়ার বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে তিনি এই সব ঋণের অনেকটাই পরিশোধ করেছেন।
তবে বিভিন্ন সময়ে নানা উপায়ে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা দীর্ঘদিন পরিশোধ করেননি। এছাড়া এসব ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি কখনই বৈধ নিয়ম-কানুন মানেননি। বরং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে অবৈধ উপায়ে ঋণ নিয়েছিলেন। যেমন চাকলাদার মনসুরুল আলম নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকাকালীন সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেঙ্মিকো লিমিটেডকে কোনো মর্টগেজ ছাড়াই বিপুল পরিমাণের ঋণ দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন সে ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে খেলাপি হয়েছিল বেঙ্্িমকো।
তবে জানা গেছে, সমপ্রতি সেই ঋণের একটি অংশ পরিশোধ করেছে সালমান এফ রহমান। তারপরও এখনো আইপিডিসি বেঙ্্িমকো লিমিটেডের কাছে সাড়ে তিন কোটি টাকা ঋণ বাবদ পাওনা রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
শুধু তাই নয়, ভুয়া দলিল দেখিয়ে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণের অভিযোগে বেঙ্মিকো হোল্ডিং লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও ওই ব্যাংকের সাবেক দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মোট ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগে বলা হয়েছে, আইএফআইসি ব্যাংকের মৌলভীবাজার, এলিফ্যান্ট রোড শাখা ও মতিঝিল শাখা থেকে বেঙ্মিকো হোল্ডিংসহ মোট ১১২ বেনামি প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে এএসএফ রহমান, সালমান এফ রহমান, ইকবাল আহম্মেদ ও এমএ কাশেম মোট ১৫৮ কোটি ৬৭ লাখ ১ হাজার ২৫ টাকা ঋণ গ্রহণের নামে আত্মসাৎ করেন।
যদিও বর্তমানে পুঁজিবাজার থেকে আত্মসাৎ করা বিপুল ক্যাশ টাকার বদৌলতে তিনি ঋণ খেলাপির তকমা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু তিনি যেভাবে অবৈধ উপায়ে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে দীর্ঘদিন তা পরিশোধ না করার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, এখনও এমন উদাহরণ বিরল।
চেহারা বদল
এক সময় হঠাৎ দেখা গেলো, সালমান এফ রহমান মূলত তার আধুনিক সাজসজ্জা থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ করে এক নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছেন। লম্বা দাড়ি রেখেছেন। আধুনিক পশ্চিমা পোশাক ত্যাগ করে পায়জামা পাঞ্জাবী পরিধান করেছেন। তার এই আকস্মিক বাহ্যিক পরিবর্তনে ওই সময় সবাই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল।
ধারণা করা হয়, তার একমাত্র মেয়ে, বিদেশে অকাল মৃত্যুতে পতিত হওয়ার পর তার এই পরিবর্তন হয়েছে। সেই সময় অনেকেই মনে করেছিলেন, শুধু বসন ভুষণেই নয়, তার মনোজগতেও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনি আর পার্থিব পৃথিবীর লোভ লালসায় নিজেকে জড়িত রাখবেন না। মূলত এই সময় থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে তার দরবেশ নামকরণ হতে দেখা যায়।
সময় পরিক্রমায় এসে দেখা যাচ্ছে, নিজেকে আসলে লোভ-লালসার ঊধর্ে্ব তুলে রাখতে পারেননি সালমান এফ রহমান।
বাহ্যিক পরিবর্তন তার অন্তর্জগতে কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। তাই ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির এই নায়ক ২০১০-এ এসে একই ভূমিকায় শুধু নয়, বরং আরও জালিয়াতি এবং আরও বেশি লুটপাটে নেমে পড়েন। শেয়ারবাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন।
অর্থ পাচার
ওয়ান-ইলেভেনের পর দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য বের করেন যে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ মোট ১৭টি দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে।
পাচার করা এ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে তারেক রহমান ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের রয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। তারেক রহমান ও মামুনের পর বিদেশে সবচেয়ে বেশি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে শীর্ষ ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের। আমেরিকায় সালমান এফ রহমানের রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা রয়েছে। জানা যায়, সালমান এফ রহমানের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও আরও নানা অভিযোগ রয়েছে এই ব্যবসায়ী এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
সালমান এফ রহমান ও তার ভাই সোহেল এফ রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় প্রতারণা ও আত্মসাতের মামলা রয়েছে। এরকম দু'টি অভিযোগে দেখা গেছে সালমান ও সোহেল রহমান শাইনপুকুর হোল্ডিংস লিমিটেডের সানসিটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নামে টাকা নিয়েও গ্রাহকদের তা বুঝিয়ে না দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেন। বাদী মোশারফ হোসেন আহমেদকে এক বছরের মধ্যে সানসিটি-৩ প্রকল্পের ১২ নম্বর প্লট হস্তান্তরের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এটাই শেষ নয়, এ ধরনের আরও বহু অভিযোগ আছে দরবেশ হিসেবে পরিচিত এই ব্যবসায়ীর নামে। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে থাকায়, অসংখ্য অভিযোগের পরও তিনি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন।
অপ্রতিরোধ্য
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সাথে সালমান এফ রহমানের জড়িত থাকার অভিযোগ সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল বৈঠকে সালমান এফ রহমানের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও তা কোন কাজে আসেনি। বরং সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণ ছিল অব্যাহত। এমনকি শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈঠকেও তার ছিল সরব উপস্থিতি। ব্যক্তি হিসেবে সালমান এফ রহমানের উপস্থিতি সেখানে কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুললেও কোন লাভ হয়নি।
সবাই ধারণা করেছিল, নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এই ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে অভিযোগ উত্থাপিত সালমান এফ রহমানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েই তার বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালিত হবে। কিন্তু কারসাজিকারীকে নীতিনির্ধারণে রেখে তদন্ত কমিটি গঠন এবং তদন্ত পরিচালনা সংশ্লিষ্টদের হতাশ করেছে। এরপর সেই তদন্ত কমিটি কোন শাস্তির সুপারিশ না করে সরকারকে সতর্ক থাকার যে পরামর্শ দিয়েছিল, বাস্তবে সেটুকুও পালন করা হয়নি। কারণ, এখনও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদটিসহ বাংলাদেশ লিস্টেড কোম্পানিজ এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান পদে তিনি বহাল আছেন। অথচ এই পদে থেকে এখনও তার পক্ষে পুঁজিবাজারে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব।
কিন্তু সালমান এফ রহমান এখন এতই ক্ষমতাধর এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন যে সরকার এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রতীকী কোন শাস্তির উদাহরণটুকু পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারেননি।
শুধু তাই নয়, এখনো তিনি রয়ে গেছেন নীতি নির্ধারণী পর্যায়েই। কারণ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জের চেয়ারম্যান এবং সদস্য নির্বাচনে তার মতামতকেই আজ অবধি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তিনি চাকলাদার মনসুরুল আলমকে চেয়ারম্যান করার সুপারিশ করেছিলেন, যা প্রায় গৃহীত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর খুনির সাথে চাকলাদারের সংশ্লিষ্টতা এবং হাওয়া ভবনের সাথে তার দহরম মহরমের কথা জানাজানি হয়ে গেলে তার নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।
অথচ এর আগে পর্যন্ত সালমান এফ রহমানের এই সুপারিশ গ্রহণ চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল।
এই চাকলাদারের সাথে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতার কথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিভাবে তিনি মর্টগেজ ছাড়াই তাকে ঋণ দিয়েছিলেন। এখন এসইসি'র চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেলে এই দরবেশের নানা অবৈধ স্বার্থই যে তিনি সংরক্ষণ করতেন, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সিএম আলমের এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বোঝা যায়, সালমান এফ রহমানের ক্ষমতা আসলে কত বেশি!
সূত্র্: সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।