আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টুকুর দিনরাত্রি

কেবলই নিজেকে খুঁজছি দুই হাঁটু এক জায়গা করে তার ওপর থুতনি, আর হাতদুটো পায়ের পাতার কাছে রেখে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বাঁশের চাঙায় বসে আছে টুকু। আজহারের দোকানের সামনের চাঙা। মুদি দোকান। কিন্তু চা'ও বিক্রি করে আজহার। আজহারের দোকানের পাশেই জাহাঙ্গীরের হোটেল।

তার ওপাশে দিলীপের সেলুন। তিন রাস্তার মোড়ে চার-পাঁচটি দোকান। মাঝ বয়সী হেমন্ত। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই অন্ধকারের সাথে সাথে শীতও পাত পেতে বসে। মোড়ের এই দোকানগুলো ছাড়াও পূর্বদিকে সামান্য দূরে একটি গার্মেন্টস কারখানার ঝকঝকে আলো এসে পড়ে রাস্তার ওপর।

এছাড়া চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পশ্চিমদিকে খানিকটা দূরে একটা শূটিং বাড়ী। চারদিকে উঁচু দেয়াল তোলা। সদর গেটে একটি বাতি জ্বলে। তার আলো এখান থেকে দেখা যায় না।

এছাড়া সীমানা প্রাচীরের ভেতরের বাগান, পুকুরঘাট, ঘরগুলির সামনে অনেকগুলো বাতি জ্বলে। কিন্তু সে আলো বাইরে আসে না। দেয়ালে আটকে যায়। রাতে শূটিং শেষে হই হুল্লোরের শব্দ ভেসে আসে পথ চলতি মানুষের কানে। জড়ানো ভারী গলার গালাগালি, লাস্যময়ী হাসি, ঠাট্টা-তামাশার শব্দ ইট-সিমেন্টের দেয়াল আটকে রাখতে পারে না।

এখানেও ভেসে আসে সেসব। এখানকার লোকেদের মধ্যে সেসব নিয়ে আলোচনা হয়। টুকু গম্ভীর মুখে সেসব গল্প শোনে। তার মনোভাব মুখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় না। রাস্তার অন্ধকার ছিঁড়ে-ফুঁড়ে একজন লোক এসে দশটা বেনসন সিগারেট চাইলো আজহারের কাছে।

টুকু লোকটার দিকে তাকালো। গম্ভীর মুখ। তীক্ষ্ণ চাহনী। যেন তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার ভেতরের যত অলি-গলি সব পড়ে ফেলছে। আজহার দশটা সিগারেট গুনে লোকটার হাতে দিতেই টুকু মুখ ফিরিয়ে নিজের মধ্যে ডুব দিল।

সামনে-পিছনে দুলে দুলে ডান হাতের আঙুলের কড় গুনতে লাগলো। ‘এক, দুই, তিন, চার,.....। ’ ঠিক তখনই লোকটা একটা সিগারেট ধরিয়ে ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। ধোঁয়ার ঝাঁপটা এসে লাগলো টুকুর নাকে-মুখে। আঙুল স্থির।

গণনা থেমে গেল সাতে। বিরক্ত টুকু চোখ-মুখ খিঁচিয়ে, কপাল কুঁচকে তাকালো লোকটার দিকে। ভাংতি টাকাটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লোকটা। লোকটার গমন পথের দিক থেকে টুকুর মুখ ফিরিয়ে আনার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, লোকটা অতি তুচ্ছ! সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে! আবার সচল হলো আঙুল। ‘সাত, আট, নয়....।

’ তখনই তার দুই গালে থাপ্পড় দুটো পড়লো। হেঁচকা টানে তাকে হাত ধরে টেনে নামালো আবিদা। তারপর ডান হাতের মুঠোয় টুকুর হাত চেপে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। মায়ের পাশে হাঁটতে হাঁটতে কাঁদতে লাগলো টুকু। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় পাঁচ বছরের টুকুকে।

চোখের পাতায় ঘুম লেগে থাকে। খুলতে চায় না চোখের পাতা। ভাতের হাঁড়িটা মাটির উনুন থেকে নামিয়ে আবিদা তাকে ডাকতে ডাকতে গোসলে যায়। গোসল থেকে ফিরে এসে আবিদা দেখে টুকু ঘুমিয়েই আছে। তখন পিঠের উপর দেয় দুটো থাপ্পড়।

ধড়মড় করে উঠে বসে টুকু। গম্ভীর মুখে মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হারুনদের টিউবয়েলের দিকে যায়। মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে মায়ের সাথে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ময়লা চিরুনীটা হাতে নিয়ে আঁঠালো চুলে চিরুনীর দাঁত বসায় টুকু। '‘তাড়াতাড়ি কর নবাবের বাচ্চা।

’' বলেই আবিদা আঙুলের ডগায় একটু পেট্রোলিয়াম জেলি নেয়। বামহাতে টুকুর ঘাড়টা ধরে ডান হাত চালায় টুকুর খসখসে মুখে। ঘাড় ধরেই ধাক্কা মেরে বলে, ‘'যা, বাইর হ। '’ ঘরে তালা লাগায় আবিদা। তারপর দুপুরের খাবারের বাটি রাখা ব্যাগটা মাটি থেকে ডান হাতে নিয়ে বাম হাতে টুকুর হাতটা ধরে স্যান্ডেলে পটাত পটাত শব্দ করতে করতে রাস্তায় বের হয়।

গার্মেন্টসে চাকরি করে আবিদা। রোজ সকালে টুকুর হাত ধরে বের হয় সে। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পুবাইলে গার্মেন্টস। টুকুকে নিয়ে সকালে পায়ে হেঁটে গার্মেন্টসে যায়, আবার রাতে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসে। তার স্বামী নজিবর ঢাকায় একটি মোটর গ্যারেজে কাজ করে।

পনের দিন পর পর বাড়ি আসে নজিবর। যদিও গাজীপুরের পুবাইল থেকে ঢাকার দূরত্ব খুব বেশি নয়। তবু সপ্তায় সপ্তায় আসা হয় না। বাড়িতে আর কোন লোকজন না থাকায় আবিদা কাজে যাবার সময় টুকুকে সঙ্গে নিয়ে যায়। গার্মেন্টসের কাছে আজহারের দোকানের সামনের চাঙায় বসিয়ে রাখে।

ব্যাগের মধ্যে যে দুটো প্লাস্টিকের বাটিতে দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে আসে। তার একটা আবিদার নিজের, আরেকটা টুকুর জন্য। টুকুর খাবারের বাটিটা আজহারের দোকানে রেখে যায়। দুপুরে আজহার বাটিটা দেয় টুকুকে। চাঙায় বসে থাকে টুকু।

সারাদিনে কতো রকম লোকজন আসে দোকানে। তারা চাঙায় বসে চা-সিগারেট খায়। দুটো গাল গল্প করে, আবার চলে যায়। টুকু গম্ভীর মুখে তাদেরকে দেখে। কখনও কখনও জাহাঙ্গীরের হোটলে ঢুঁ মারে।

সস্তা হোটেল। পরোটা, চা, সিঙ্গারা, পুড়ি আর দুপুরে সস্তায় ভাত পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীরের হোটেলে ছোট্ট একটা টিভি আছে। সারাদিন বাংলা সিনেমা চালিয়ে রাখে জাহাঙ্গীর। সিনেমা দেখার লোভেই মাঝে মাঝে জাহাঙ্গীরের হোটেলের বেঞ্চে এসে বসে টুকু।

বাংলা সিনেমা দেখে। হোটেলে লোকজনের ভিড় হলেই জাহাঙ্গীর তাড়া দেয়, ‘যা ভাগ!’ আবার মাঝে মাঝে ফরমায়েশও খাটায় জাহাঙ্গীর। ‘'টুকু দুই জগ পানি আইন্যা দে তো। ’' '‘এক গিলাস পানি দে তো ভাইজানরে। '’ টুকু ফরমায়েশ খাটে।

যাতে জাহাঙ্গীরের কাছে ভাল থাকা যায়। তাকে তাড়িয়ে না দেয়। তাহলে অনেকক্ষণ সিনেমা দেখতে পারবে সে। জগতের এই কদাকার চতুরতার দিকটি এই বয়সেই বুঝে গেছে টুকু। আবার জাহাঙ্গীরের মেজাজ ভাল থাকলে কখনও কখনও মাছি ভন ভন করা একটা ঠান্ডা সিঙ্গারা কিংবা পুড়িও জোটে টুকুর কপালে।

সিঙ্গারায় দাঁত বসাতে বসাতে টুকু আবার এসে বসে চাঙায়। মাঝে মাঝে শূটিংয়ের লোকজন আসে এখানে। নাটক-সিনেমার অভিনয় শিল্পীরা এসে চা-সিগারেট খায়। নিজেদের মধ্যে গল্প করে। আবার চলে যায়।

টুকু তাদের দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। কোন উচ্ছাস নেই তার। মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হয় না। শুধু একবার সে অবাক হয়েছিল একজন অভিনেত্রীকে সিগারেট খেতে দেখে। টুকু আগে থেকেই চিনতো সেই অভিনেত্রীকে।

একটা নাটকে মাজা ভাঙা বুড়ি সেজেছিল। অথচ বয়স বেশি না। টুকু কপাল কুঁচকে, ঠোঁট ছুঁছোলো করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সিগারেট খাওয়া দেখেছিল। তারপর পরক্ষণেই আবার গম্ভীর হয়ে যায় সে। সারাদিনে বলতে গেলে টুকু একেবারেই হাসে না।

যেন সে হাসতে জানে না। বাবা পনের দিন পর পর বাড়িতে আসে। মা তাকে এখানে ফেলে ঢুকে যায় গার্মেন্টসে। সারাদিনে আর মায়ের দেখা পায় না। কোন শাসন নেই, বাঁধন নেই।

আদর-স্নেহ নেই। উড়ো খইয়ের মতো দিন কাঁটে তার। জীবনের এই কঠিন রুঢ় বাস্তবতা যেন তার সবটুকু হাসি কেড়ে নিয়ে এতটুকুন মুখে দিয়ে গেছে পাথুরে গাম্ভীর্য। অপরিচিত কোন মানুষ টুকুকে বিস্কুট, চকলেট কিংবা কোন কিছু দিলে সে নেয় না। জোরাজুরি করলে উঠে একদিকে হাঁটা দেয়।

আবার কখনও কখনও নিজেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আজহারের দোকানের বিস্কুটের বয়ামের দিকে। কাঁচের ভেতরের চকলেটের দিকে। কাঁচের বাইরে থেকে সে চকলেটে হাত বোলায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। চকলেটের প্যাকেটের গায়ের কার্টুনের ছবির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে আসে তার শিশুসুলভ আচরণ।

কার্টুনের ছবির দিকে তাকিয়ে জিভ ভ্যাঙায়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ভয় দেখায়। ব্যাঙ্গ করে। চড় দেখায়। আবার আদরও করে।

‘'এই, যা চুপ কইরা বয়!'’ আজহারের ধমক খেয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় টুকু। চুপ করে বসে থাকে চাঙায়। আঙুল দিয়ে চাঙার বাঁশে আঁকি-বুকি করতে থাকে আর থেকে থেকে চকলেটের প্যাকেটের গায়ের কার্টুনের দিকে তাকায়। দুপুরে আজহারের কাছ থেকে খাবারের বাটিটা নিয়ে ভাত খায়। টিউবয়েল থেকে বাটিটা ধুয়ে এনে তৈলাক্ত বাটিটা আজহারের দোকানের একপাশে রেখে আবার চাঙার ওপর বসে টুকু।

ভাত খাওয়ার পর শরীরটা ভারী হয়। মাথা ভারী হয়ে আসে। ঝিমুনি আসে। বুজে আসে চোখের পাতা। ছোট্ট শরীরটা ঘুম চায়।

বসে বসে ঝিমুতে থাকে সে। শূটিংয়ের কয়েকজন অভিনয় শিল্পী আসে আজহারের দোকানে। টুকুর ঝিমুনি কাটে আজহারের ধমকে, ‘'এই হইরা বয়, ওনাগো বইতে দে। ’' টুকু উঠে দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে। শিল্পীদের দিকে তাকায়।

কাউকে সে চিনতে পারে। কাউকে পারে না। চা-সিগারেট খায় তারা। একজন জিজ্ঞাসা করে তাকে, ‘'নাম কি তোর?’' টুকু গম্ভীর মুখে কপাল কুঁচকে তাকায় প্রশ্নকারীর দিকে। পূণঃরায় একই প্রশ্ন, ‘'তোর নাম কি?’' ‘'টুকু।

’' নিচুস্বরে টুকুর জড়ানো উচ্চারণ । ‘'কি?’' ‘'টুকু। ’' একই ভাবে বলে সে। ‘'শুকু?'’ ‘'টুকু। '’ একটু জোর দিয়ে বলে।

এবার বুঝতে পারে প্রশ্নকারী, ‘'ও টুকু। '’ মাথা নাড়ে টুকু। একজন একটা বিস্কুট এগিয়ে দেয় টুকুর দিকে। টুকু দু-দিকে মাথা নাড়ে। লোকটা আবার বলে, ‘'নে নে খা।

’' টুকু গম্ভীর মুখে একই ভাবে মাথা নেড়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে হাঁটা দেয়। একবারও পিছন ফিরে তাকায় না। স্কুল মাঠের একপাশে গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় টুকু। মেহগনি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে। চোখের পাতা আবার ভারী হয়।

ঝিমুনি আসে। চোখ বুজে হারিয়ে যায় টুকু। বেশ কিছুক্ষণ পর টুকু সজাগ হয় পায়ের পাতায় সুরসুরি আর গরম বাতাস অনুভব করে। চোখ খুলে তাকায় সামনে। একটি ছাগলের বাচ্চা তার পায়ের পাতা চাটছে।

বাচ্চাটি চার পায়ে দাঁড়িয়ে টলছে। বোধ হয় দু-তিনদিনের বাচ্চা। সামান্য দূরে মা ছাগলটি ঘাস খাচ্ছে। অন্য একটি বাচ্চা মায়ের পিছন পিছন টলতে টলতে হাঁটছে আর ঘাস শুকছে। টুকু একটি ঘাসের ডগা ছিঁড়ে বাচ্চাটির মুখের কাছে ধরলো।

বাচ্চাটি ঘাসের ডগাটি শুকে কামড়ে মুখের মধ্যে নেবার চেষ্টা করলো। টুকু বললো, ‘'খা, খা। '’ তারপর বাচ্চাটি ঘাসের ডগা ছেড়ে টুকুর হাতের আঙুল চাটতে লাগলো। টুকু আঙুল বাড়িয়ে দিল। একটার পর একটা আঙুল চাটতে লাগলো বাচ্চাটি।

টুকুও বেশ মজা পেয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে আঙুল সরিয়ে আনলো আর বাচ্চাটি এগোতে এগোতে তার কোলের কাছে চলে এলো। আনমনে হাসতে লাগলো টুকু। আজকের দিনে এই প্রথম হাসলো সে। ‘'খেলবি টুকু?'’ তার বয়সী একটি ছেলে তাকে ডাকলো।

সঙ্গে আরো কয়েকটি ছেলে। বিকেলে ওরা মাঠের একপাশে ক্রিকেট খেলে। আর পুরো মাঠ দখল করে খেলে বড়রা। স'’মিল থেকে থেকে কুড়িয়ে আনা এক টুকরো কাঠ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে খেলে ওরা। টুকু মাঝে মাঝেই খেলে ওদের সাথে।

‘'খেলমু। ' বলেই ছাগলের বাচ্চাটির মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে উঠে দৌড় দিল। সন্ধ্যায় আবার দোকানের চাঙায় এসে বসলো টুকু। এতক্ষণ খেলার মাঠে দৌড়-ঝাঁপ করছিল। এখন এসে চাঙায় বসতেই খিদেয় পেটটা চিন চিন করতে শুরু করলো।

সেই সাথে শীতও কামড় বসাচ্ছে শরীরে। হাফ প্যান্ট পরা। গায়ে একটা পাতলা তেল চিটচিটে সোয়েটার। কুয়াশা পড়েছে আজ বেশ, সাথে উত্তর দিক থেকে আসা হালকা বাতাস। টুকু গুটি সুটি মেরে চাঙায় বসে বয়ামের বিস্কুট আর কাঁচের বাক্সের চকলেটের দিকে তাকিয়ে রইলো কপাল কুঁচকে, ছুঁছোলো মুখে।

তারপর খিদেটা যখন একেবারেই অসহ্য বোধ হলো, তখন উঠে গিয়ে জাহাঙ্গীরের হোটেলে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসলো। টিভিতে বাংলা সিনেমা হচ্ছে। সে একবার টিভির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ফুরিয়ে আসা সিঙ্গারা আর পুড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বিকেলে ভাজা সিঙ্গারা আর পুড়ি। ঠান্ডা হয়ে গেছে।

কয়েকটা মাছি ভন ভন করছে। অন্ধকার নামলে খরিদ্দার কমে আসে। দু-চারজন গল্পবাজ লোক অবশ্য থাকে। তারা চা-সিগারেট খায়। রাজনীতির জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

ওসব গল্প টুকুর ছোট মাথায় ঢোকে না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঠান্ডা, মাছি ভনভন করা সিঙ্গারা-পুড়ির দিকে। কিন্তু আজ জাহাঙ্গীরের বেচা-বিক্রি হয়তো ভাল হয়নি। মেজাজটা ভাল নেই। সে টুকুকে খেয়ালই করে না।

হোটেলের কাজের ছেলেটাকে ধমকায় টেবিলে চা দেবার সময় কাপ থেকে চা ফেলার জন্য। টুকু ঘাপটি মেরে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে তাকে দেখে যদি হোটেল থেকে বের করে দেয় জাহাঙ্গীর! পেটের ভেতর মোচড় মারছে। মনে হচ্ছে নাড়ি-ভুড়ি সব যুদ্ধ শুরু করেছে। জাহাঙ্গীরের দিকে তাকালো টুকু।

এক খরিদ্দারের কাছ থেকে টাকা রাখছে জাহাঙ্গীর। সে আস্তে আস্তে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো। পুরো গ্লাস পানি খেলো। তারপর আরো হাফ গ্লাস। পেটের যুদ্ধটা এখন একটু কমেছে।

একটা ঢেঁকুর তুলে আবার টিভি দেখতে লাগলো। দেড় গ্লাস পানি খেয়ে পেটের খিদে একেবারে মরে যায়নি। একজন খরিদ্দার এসে অবশিষ্ট সিঙ্গারা আর পুড়িগুলো নিয়ে গেল। আর আশা নেই। তাই টিভিতে চোখ রাখলো।

কিন্তু টিভির দিকে চোখ থাকলেও মনে মনে অপেক্ষা করতে লাগলো মায়ের জন্য। দুটো থাপ্পড়ের জন্য। আবিদা এসেই টুকুর দুই গালে দুটো থাপ্পড় মারে। কেন মারে তা টুকু জানে না। কেউ-ই জানে না।

হয়তো আবিদাও জানে না। সারাদিন কারখানায় যন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে, যন্ত্রের মতো কাজ করে সমস্ত আবেগ-অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে। বকাঝকা খায়। মনটা হয়তো খিটখিটে হয়ে থাকে। তাই হয়তো কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেই নিজের ছেলেকে মেরে জ্বালা জুড়ায়।

হঠাৎ পূর্বদিক থেকে হইচই আর চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। কেউ একজন চিৎকার করলো, ‘'আগুন! আগুন! আগুন লাগছে!’' হোটেলের ভেতরের সবাই কান খাড়া করলো। কয়েকজন দৌড়ে বের হয়ে গেল। আজহারের গলা পাওয়া গেল, ‘'গার্মেন্টসে আগুন লাগছে। ’' টুকু হোটেল থেকে বের হয়ে অন্য সবার সাথে গার্মেন্টসের সদর গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে গেল। ভেতর থেকে চিৎকার আর কাঁন্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। যারা বেরিয়ে এসেছে তারাও কাঁন্নাকাটি করছে। মুহূর্তের মধ্যে অনেক লোকের ভিড় জমে গেল গার্মেন্টেসের সামনের রাস্তায়।

গার্মেন্টের মেয়েরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মানুষের কাঁন্না, চিৎকার, হই-হট্টগোলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে টুকুর কাঁন্না জড়ানো চিৎকার, ‘'আম্মা, আম্মা...। ’' টুকু নাকের পানি, চোখের পানি সোয়েটারের হাতায় মুছছে আর গার্মেন্টস থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েদের ভিড়ে তার মাকে খুঁজছে। মানুষের ভিড়ের ফাঁক গলে, ছোট্ট দুই হাতে মানুষকে ঠেলে সে খুঁজে চলেছে তার মাকে। অনেক খুঁজেও যখন আর মাকে পেল না।

হয়রান হয়ে গেল। বুকের হাপর ঘন ঘন ওঠা-নামা করতে লাগলো। তখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। কোলাহলরত মানুষের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে আগুনের আভায় ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হতে লাগলো টুকুর অশ্রু“স্নাত মুখমন্ডল। সেই আলোতেই পড়া গেল টুকুর চোখের হাহাকার।

টুকু অসহায় চোখে আগুনের লেলিহান শিখার দিকে মায়ের মুখচ্ছবি দেখতে দেখতে কেঁদেই চললো, ‘'আম্মা....আম্মা....!’' ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.