www.cameraman-blog.com/
কয়েকদিন আগে ঘুরে এলাম গাইবান্ধা - গোবিন্দগঞ্জ - বগুড়া। বগুড়ায় এসে মহাস্থান গড় দেখবো না তা কি করে হয়। অল্প একটু সময় বের করে ঘুরে এলাম গোকুল মেধ নামের স্তুপটি। যা কিনা বেহুলা - লক্ষিন্দরের বাসর ঘর নামে অধিক পরিচিত। মাটি থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফিট উচুতে একটা ঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
ঘরটির একপাশে আরেকটা ঘরের মতো অংশে আছে একটা কুয়া, কুয়া সহ এই ঘরটিকে বলা হচ্ছে স্নানাগার বা বাথরুম। প্রচলিত ধারণা এটি তৈরী করা হয়েছিল বাসর রাতের পর বেহুলা-লক্ষিন্দরের স্নান করার জন্যে। স্তুপটিকো পাশ থেকে দেখলে আরো অনেকগুলো ঘরের কাঠামো চোখে পড়ে। এরকম নাকি ১৭২ টি ঘর আছে। মজার ব্যাপার হলো সবগুলোই হলো বদ্ধ কুঠুরী, আপাতদৃষ্টিতে ঢোকা বা বের হওয়ার কোন পথ নেই।
এটি তৈরী করা হয়েছিল ৬ষ্ঠ - ৭ম খৃষ্টাব্দের কোন এক সময়। ব্রিটিশরা ১৯৩৪-৩৬ সালের দিকে প্রথম ওখানে খনন কাজ চালায়। এরপর এই স্থানটি অখননকৃত অবস্থায়ই আছে বলা যায়। ফলে এটা যে আসলে কি ছিল তা এখনও অজানা আমাদের কাছে, বেহুলা - লক্ষিন্দরের মিথটাই প্রচলিত হয়ে গেছে এটাকে ঘিরে।
-----------------------------------------------------------------------------
মিথ : বিপ্রদাশ পিপিলাই তার মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলা - লক্ষিন্দরের কাহিনী বণর্না করেছেন এভাবে।
হিন্দু পূরাণ অনুসারে, চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিবের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী, তবে মনসা তাকে নিজস্ব পূজারী করার পরিকল্পনা করে। মনসা তার সকল কলাকৌশল অবলম্বন করে চাঁদ সওদাগরের মত বদলানোর চেষ্টা করলেও চাঁদ সওদাগর শিবের কাছ থেকে দিক্ষা পাওয়া মন্ত্র ও বেদবাক্য দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে। একসময় মনসা চাঁদ সওদাগরের কাছে সুন্দরী নারীর বেশে এসে হাজির হলে চাঁদ সওদাগর তাকে তার গোপন কথা জানিয়ে দেয়। ফলে, চাঁদ তার বেদবাক্যের ফলে প্রাপ্ত অলৌকিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চাঁদ এরপর শঙ্করের সাহায্য গ্রহণ করে।
পূর্ণশক্তির ক্ষমতা চাঁদ সওদাগরের চেয়েও বেশি হলেও মনসা তাকে হত্যা করে চাঁদ সওদাগরকে পুনরায় অসহায় করে ফেলে।
এরপরও চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা করতে অস্বীকৃতি জানালে মনসা সাপ পাঠিয়ে তার ছয় সন্তানকে হত্যা করে। ফলে, চাঁদ সওদাগর হতাশ হয়ে তার ব্যবসা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। প্রতিকূল পরিস্থিত স্বত্ত্বেও চাঁদ ব্যবসার উদ্দেশে আবার সমুদ্র যাত্রা শুরু করে। একটি সফল ব্যবসায়িক অভিযানের পর জাহাজভর্তি সম্পদ নিয়ে চাঁদ ঘরে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করে।
মনসা একটি ঝড় উত্পন্ন করে এবং চাঁদ প্রথমিক পর্যায়ে দূর্গার সাহায্য নিয়ে রক্ষা পেলেও পরবর্তীতে মনসার অনুরোধের প্রেক্ষিতে শিব দূর্গাকে সরে যেতে বলে। এরপর চাঁদ সওদাগরের জাহাজ ডুবে যায় এবং মনসা তাকে একটি দ্বীপে নিয়ে আসে। এই দ্বীপে চাঁদ তার পুরনো বন্ধু চন্দ্রকেতুর দেখা পায়।
চন্দ্রকেতু চাঁদ সওদাগরকে মনসার অনুসারী করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সে দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে। সে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েও কেবল শিব আর দূর্গার পূজা করতে থাকে।
মনসার কাছে মাথা না নোয়াতে চাওয়ায় সে তার স্বর্গের দুই বন্ধু - দু'জন অপ্সরার সাহায্য গ্রহণ করে। তারা পৃথিবীতে মানব হিসেবে জন্ম নিতে রাজি হয়। একজন চাঁদ সওদাগরের পুত্র ও অন্যজন চাঁদের ব্যবসায়িক সতীর্থ সাহার কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করে।
চম্পকনগরে ফিরে এসে চাঁদ সওদাগর তার জীবন নতুন করে গড়তে সমর্থ হয়। তার একটি সন্তান জন্ম লাভ করে।
তারা সন্তানটির নাম রাখে লক্ষিন্দর। কাছাকাছি সময়ে সাহার স্ত্রী একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় যার নাম রাখা হয় বেহুলা। দুটি শিশুই একসাথে বেড়ে ওঠে এবং একে অপরের জন্য সম্পুর্ণ উপযুক্ত বলে গণ্য হয়। তবে যখন তাদের রাশি গণণা করা হয় এবং দেখা যায় যে, বিয়ের রাতে লক্ষিন্দর সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করবে। যেহেতু উভয়ই তখন মনসার অনুসারী এবং তাদের ভেতরে প্রচুর সাদৃশ্য তাই তাদের বিবাহ নির্ধারিত হয়।
চাঁদ সওদাগর অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে এমন বাসর ঘর তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব নয়।
কিন্তু সকল সাবধানতা স্বত্ত্বেও মনসা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমর্থ হয়। তার পাঠানো একটি সাপ লক্ষিন্দরকে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে নিহত হত তাদের সৎকার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে তাদের মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত এ আশায় যে ব্যক্তিটি হয়ত কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে। বেহুলা সবার বাঁধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে।
তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
একসময় ভেলাটি মনসার পালক মাতা নিতার কাছে আসে।
তিনি নদীতীরে ধোপার কাজ করার সময় ভেলাটি ভূমি স্পর্শ করে। তিনি মনসার কাছে বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে বেহুলাকে তার কাছে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লক্ষিন্দরকে স্বর্গে পৌছে দেন। মনসা বলে, তুমি তাকে (লক্ষিন্দরকে) ফিরে পাবার যোগ্য, কিন্তু এটি কেবলি সম্ভব হবে যদি তুমি তোমার শ্বশুর়কে আমার পূজারী করতে পার।
“আমি পারব,” বেহুলা জবাব দেয় এবং সেই সাথেই তার স্বামীর মৃতদেহে জীবন ফিরে আসতে শুরু করে।
তার ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে এবং লক্ষিন্দর তার চোখ মেলে তাকায়। এরপর লক্ষিন্দর বেহুলার দিকে তাকিয়ে হাসে।
তাদের পথপ্রদর্শক নিতাকে নিয়ে তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে। বেহুলা তার শ্বাশুরীর কাছে সবকিছু খুলে বলে। তিনি চাঁদ সওদাগরের কাছে গিয়ে তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করেন।
চাঁদ সওদাগর আর মনসাকে না বলতে পারেনি।
চাঁদ সওদাগর মনসাকে প্রতি মাসের অমাবস্যার এগার তারিখে মনসা পূজা করে। তবে দেবীর দেয়া সকল কষ্টের জন্য তাকে সে ক্ষমা করতে পারে না। সে তার প্রতিকৃতি থেকে মুখ সরিয়ে বাম হাতে তাকে ফুল প্রদান করে। তবে সেজন্য মনসা তার উপর আর কোন আক্রোশ রাখে না।
তখন থেকে চাঁদ সওদাগর ও তার পরিবার সুখে ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করতে থাকে। চাঁদ সওদাগরের মর্যাদা ও সম্মান পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মনসাকে পূজা করা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানীয় বলে বিবেচিত হতে থাকে।
তথ্যসূত্র : মিথ এর অংশটুকু পুরোটাই বাংলা উইকি থেকে নেয়া
ছবি : আমার তোলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।