হিজিবিজি
আস্তে আস্তে আমাদের client-এর আমার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে চাপ - কাজের এবং অফিস রাজনীতির। আমি আসি মুক্তির জায়গায়। আগে বুঝিনি এটা একটা বিরাট রাজনীতির ফল। আর আমি সেই দাবা খেলার একটা বোড়ে মাত্র।
এখানে এসে বুঝলাম আমাদের দেশের অফিস ও আমেরিকার অফিসের বড়কর্তাদের মধ্যে বেশ একটা ক্ষমতার ঠান্ডা লড়াই চলে।
মুক্তি এখানে থাকতে চেয়েছিল - যদ্দিন পারা যায়। তাই সে এখানকার বড়কর্তাদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক রাখত। এভাবেই হয়ত চলে যেত; বাদ সাধল দেশের অফিস। হঠাৎ তাদের মনে হল - বাঃ এই ছেলেটা তো অনেক দিন আমেরিকাতে আছে! ব্যাস শুরু হল চাপ দেওয়া।
প্রথম সমস্যা হল, দেশে এই কর্মসূচিতে ওর উপযুক্ত পরিবর্ত পাওয়া। শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরে আনা হল অন্য কর্মসূচি থেকে।
তাই আমি এসে দেখি মুক্তি তো বটেই উর্ধঃতন কর্মচারীরা পর্যন্ত আমার প্রতি যারপরনাই বিরক্ত। মুক্তি নানা অছিলায় তার কাজ আমায় বুঝিয়ে দেওয়া থেকে এড়িয়ে যেত। ভাল করে কথা বলত না।
একদিন বসলাম ওর সাথে। প্রথমে তো কিছুতেই বসবেনা। তারপর কফি খাবার অছিলায় শান্তিনিকেতন নিয়ে গেলাম।
আমাদের অফিস বাড়িটা ইংরাজি "C" আকৃতির। আর ঐ মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় একটা সুন্দর বাগান আছে,যত্নে লালিত।
আমরা নাম দিয়েছি শান্তিনিকেতন।
কোন ভনিতা না করে সোজা আসল কথায় গেলাম। বললাম, "দেখ তোমাকে এখান থেকে সরানোটা কর্ত্বপক্ষের সিদ্ধান্ত। সেখানে আমি নিমিত্ত মাত্র। আমার আমেরিকা আসার কোনো উদগ্র বাসনা ছিলনা।
আমি না এলে অন্য কেউ আসত। কারন যে ভাবেই হোক তোমায় ফেরত পাঠাতই। মানে, আমি আসতে চেয়েছিলাম বলে তোমায় ফেরত পাঠাচ্ছে না। বরং তোমায় ফেরত পাঠাচ্ছে বলেই আমায় আসতে হয়েছে। এখন তোমার রাগের চোটে আমায় ভুগতে হবে তুমি চলে গেলে।
এটা তোমার মত একজন অভিজ্ঞ পেশাদারের মানায় না। " কপাল ভাল ছিল এই যুক্তিটা মুক্তির ভাল লেগেছিল। এরপর থেকে সেভাবে আর ঝামেলা করত না। অন্ততঃ কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিত।
সমস্যা শুরু হল মুক্তি চলে যাবার পর।
দুদিক থেকেই চাপ ছিল - আমার সংস্থার উর্দ্ধতন এবং আমার client-এর থেকে। প্রাথমিক চাপটা ছিল client-এর থেকে। আসলে দোষ আমারই। আমি এই application-টা দেখছি ৩-৪মাস। সেখানে মুক্তি দেখছে ৩-৪বছর।
আমায় কাজ বুঝিয়ে দিলেও অভিজ্ঞতা কি করে শেখাবে! ওর সব জিনিস মুখস্থ ছিল। আমায় সেখানে দেখতে হচ্ছে। Meeting-এ গিয়ে যেখানে মুক্তি যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে আসত; সেখানে আমাকে গিয়ে বলতে হচ্ছে, "সব দেখে জানাবো। " সমস্যা শুধু সেখানে নয়, কাজের ধরণেও আমেরিকানদের সাথে তাল মেলাতে অসুবিধা হচ্ছিল। এখানে দুটো উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা।
১। একদিন একজন আমাকে mail করে জানাল যে সে একটা কাজ করতে চলেছে যাতে আমার application-জড়িত। আমি উত্তরে জানাতে চাইলাম যে ঠিক আছে আমি খেয়াল রাখব। এই উত্তর দিতে আমি ভাবলাম একটু আমেরিকান হওয়া যাক। লিখলাম, "Roger that." অনেক সিনেমায় এই কথাটা শুনেছি; মানে, ঠিক আছে।
তৎক্ষনাৎ Karen নিরিহ ভাবে Sametime-এ লিখল, "Roger that কি জিনিস? কোত্থেকে শিখলে এসব? তোমাদের দেশে কি এই ভাবে লোকে কথা বলে?" দ্রুত ক্ষমা চাইলাম এজাতীয় চলিত কথা ব্যবহারের জন্য। এদেশে এই একটা জিনিস তদ্দিনে জেনে গেছি ভুল করলে ক্ষমা চাইলে এরা মাফ করে দেয়। বরং ওপরচালাকের কোন ক্ষমা নেই। Karenবোঝালো, "দেখ, এই সব প্রথাগত mail অনেক লোকের কাছে যায়। সবাইতো আর সমান হয় না, কারুর খারাপ লাগতেই পারে।
সুতরাং সাধারণ ভাষায় mail লেখার চেষ্টা কর। " খুব শিক্ষা হল।
২। প্রথম প্রথম কেউ আমাকে কোন কাজ mail-এ করতে বললে আমি কাজটা শেষ করে তারপর তাকে mail করে জানাতাম। এ ব্যপারটাও যে সমস্যা সৃষ্টি করবে কে জানত! David আমার বিরূদ্ধে Karen-এর কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করল।
Karen একদিন এসে আমাকে ডেকে আলাদা ঘরে নিয়ে গেল। ঝাড়ল না কিন্তু; বরং ভদ্রভাবে বলল, "তোমাকে কেউ কোনো কাজের জন্য mail করলে সাথে সাথে উত্তর দিয়ে বোলো যে তুমি ব্যাপারটা দেখছ। নয়ত ঐ ব্যক্তি যে অন্ধকারে থেকে যাবে! কেউ বলছে না তুমি কাজ করছ না; কিন্তু কেউ বুঝছেও না যে তুমি কাজ করছ, যতক্ষণ না তুমি উত্তর দিচ্ছ। " খুব ভাল লাগল। এই ভাবে কেউ কোনদিন আমাকে কাজের ক্ষেত্রে শেখায়নি।
এবার চাপটা হল এই সমস্যা গুলোর কিছু কিছু আমার সংস্থার এই অফিসে উপস্থিত উর্দ্ধতনদের কাছে চলে গেছিল। ব্যস আর যায় কোথায়! উঠতে বসতে শুনতে থাকলাম, "তুই মনে হচ্ছে আমেরিকায় কাজের জন্য উপযুক্ত নোস। কিছুই পারিস না। " কি ভীষণ পার্থক্য। আমার আমেরিকান ওপরওয়ালা চাইছে আমি যেন সবকিছু শিখে নেই; আর আমার দেশি ওপরওয়ালা চাইছে আমি কেন সবকিছু শিখে নেই!
একদিন সবার সামনে ঘোড়াদা (ওনার গলাটা ঘোড়ার মত লম্বা বলে আমরা আড়ালে ঐ নামে ডাকতাম) এক meeting-এর মাঝে হঠাৎ করে বলল,"তোকে নিয়ে এসে কি ফেঁসে গেছি দেখ।
আমাদের তরফ থেকেই মুক্তিকে ফেরৎ পাঠাবার কথা client-কে বলা হয়েছিল। এখন তুই যা শুরু করেছিস তাতে তোকে ফেরৎ পাঠাতে পারলেই ভাল হত, কিন্তু client-কে কি মুখে এত তাড়াতাড়ি বলি বল তো!"
এত খারাপ লেগেছিল কি বলব! ভেবেছিলাম বলি,"আপনার এত মুক্তিকে পছন্দ তো ওকে রেখে দিলেই পারতেন। আমি তো আমেরিকা এখন আসতে চাইনি। প্রায় জোর করেই তো পাঠানো হয়েছে আমাকে। " একটা কথা ভেবেই মুখবুজে রইলাম - আগে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।
গোদের ওপর বিষফোঁড় হল আমার application-এ আমি ছাড়া আমার সংস্থা থেকে আমেরিকাতে আর কেউ নেই। একা হাতে সামলাতে হয়, মানে আমি যদি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ি তো সামাল দেবার কেউ নেই। অন্যদিকে কাজের ব্যাপারে কোন সমস্যা থাকলে কারুর সাথে আলোচনা করার উপায় নেই - কেউ জানে না যে!!
সব ঠেকে শেখা ছাড়া উপায় ছিল না। আস্তে আস্তে ছন্দ পেতে থাকলাম। Client-ও একটা দুটো করে প্রসংসাসূচক mail করতে থাকল।
আমি সেগুলো জমিয়ে যেতে থাকলাম। ঘোড়াদা আর কোনদিন ওভাবে কথা বললে mail-গুলো মুখের সামনে ধরব। Catherine, David আর Karen-এর সাথে একটা সুন্দর team গড়ে উঠতে থাকল। খাঁটি পরিশ্রমের বিকল্প নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।