যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
১.
শিল্পোন্নয়ন, কর্পোরেটদের একচেটিয়া বাজারদখল আর উন্নততর জীবনযাত্রার চাহিদাবৃদ্ধির সাথে সাথে ইদানিং একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকে নজর এসেছে মানুষের। কনসেপ্টটিকে বলা হচ্ছে "ফুড মাইল"। ব্যাপারটা খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যায় ম্যাকডোনাল্ডসের উদাহরন দিয়ে।
ম্যাকডোনাল্ডস হচ্ছে সম্ভব্ত বিশ্বের বিশালতম ফাস্টফুড চেইন, কর্পোরেট। পরিবেশিত খাবারের ব্যাপারে তাদের কিছু নীতি আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো সব খাবারের মান একরকম হতে হবে।
কর্পো তাই "খাবারের মান" বলতে এখন শুধু "স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ না" এবিষয়টি নিশ্চিত করা খাবারকেই বোঝাবে না, অথবা শুধু "খাদ্যগুন(ভিটামিন/মিনারেলের পরিমাণ) নিশ্চিত করে" এমনটাও বোঝাবেনা। এখন এসবের সাথে সাথে খাবারের স্বাদও একরকম হতে হবে, যদি নাম এক হয়। অর্থাৎ, ম্যানিলায় বসে আপনি যে চিকেন বার্গারটি চিবুচ্ছেন, সেটা লস এ্যাঞ্জেলসে বসে আপনার বন্ধুর চিবোতে থাকা চিকেন বার্গারের সাথে একদম মিলতে হবে। ম্যাকডোনাল্ডস তাই নিজেদের বার্গারের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে মুর্গী চাষ করে, সম্ভবতঃ মুর্গীর প্রসেসিংও হয় একই ম্যানুয়াল অনুসরন করে; তারপর সেই মুর্গী নানান জায়গায় বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে টোকিওতে বসে আপনি আর টোকিওর মুর্গী খাননা, হয়ত কেনটাকি বা ইন্ডিয়ানার কোন ফার্মে বড় হওয়া মুর্গীর রান চিবোতে থাকেন।
এটা শুধু ম্যাকডোনাল্ডসকে নিয়ে দেয়া উদাহরন। এখন শিল্পোন্নত জাপানের উদাহরন টানা যাক। যে পরিমাণ চিকেনফ্রাই এরা খাচ্ছে বা যে পরিমাণ বিয়ার গিলছে, সে পরিমাণ মুরগীচাষ বা গমচাষ করার মতো লোকও এদের নেই, জমিও নেই। ফলাফল, জাহাজ ভরে অন্যদেশ থেকে আনো। আজ গম চীন থেকে নিচ্ছে, কাল যদি দেখা যায় ভিয়েতনাম আরো সস্তায় দিচ্ছে গম, তাহলে যদি যাতায়াত খরচে পোষায় তাহলে ভিয়েতনাম থেকে নিবে।
এরপর বাংলাদেশ আরো সস্তায় দিতে পারলে বাংলাদেশ থেকে আনবে।
এখন আসা যাক আরেকটি খানদানী উদাহরনে। কোবে বীফ সম্ভবতঃ বিশ্বের সবচেয়ে দামী গরুর মাংস, শুনেছি এই গরুকে পেলেটেলে বড় করার সময় গান শোনানো হয় রীতিমত। তাতে নাকি মাংসের স্বাদ বাড়ে। দুনিয়া শুধু কোবে বীফে থেমে নেই।
এরকম আরো হাজার রকমের স্পেশাল খাবার ( ব্র্যান্ডেড কাঁচামাল ) আছে এখন। এখানকার এটা খেতে সুস্বাদু তো, সেখানকার ওটা খেতে সুস্বাদু। জাপানী খানদানী কুইজিনে দেশী স্যামনে হয়না, নরওয়ের থেকে একটা তৈলাক্ত স্যামন আসে, ওটা এদের খাওয়া চাইই চাই।
ম্যাকডোনাল্ডসের ক্ষেত্রে একবার চিন্তা করুন কি পরিমাণ চিকেন প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সারা পৃথিবীতে যায়। অথবা জাপানে আমদানী করা চাল, দাম পোষালে যতদূর থেকেই হোক আনা হবে।
অথবা কোবে থেকে লন্ডনে বীফ উড়িয়ে এনে বা নরওয়ে থেকে টোকিওতে স্যামন ভাসিয়ে এনে খাবার বিলাসিতা। কি পরিমাণ যাতায়াত হয়, ভেবে দেখেছেন। যাতায়াত যত বেশী, তেলের খরচ তত বেশী।
এখান থেকেই ফুডমাইল কনসেপ্টের আবির্ভাব। একটা খাবার প্রতিপাউন্ড এক মাইল দূর থেকে আসলে সেটাকে এক ফুডমাইল বলা হয় বা প্রতি কেজি এক কি.মি দূরে গেলে এক ফুড-কি.মি. বলা হবে।
যেমন, ধরুন আপনি একশগ্রাম ওজনের বীফ স্টেক খেলেন লস এঞ্জেলসে বসে যেটা টেক্সাস থেকে এসেছে, তাহলে টেক্সাস আর এল.এ'র দূরত্ব যদি পাঁচশ কি.মি (কথার কথা) হয়, তাহলে খাবারটির ফুডমাইল হলো (৫০০x০.১)=৫০ ফুডকি.মি। জাপানের কিছু রেস্টুরেন্ট খাবারের আইটেমের ফুডমাইল হিসেব করে মেন্যুতে সেটা উল্লেখ করার উদ্যোগ নিয়েছে, আর মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে কম ফুডমাইলের খাবার খেতে, যাতে বিক্রেতারা সচেতন হয়। যত কম ফুডমাইলের খাবার বিক্রী বাড়বে, তত যাতায়াতের তেলের ব্যবহার কমবে। উল্লেখ্য, জাপানের মাথাপিছু ফুডমাইল পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, এদের সময় এসেছে আবার কৃষিকাজে মন দেবার।
ফুডমাইল সম্পর্কিত প্ল্যানটা ঠিকভাবে কাজ করলে প্রচুর তেল বেঁচে যাবে পৃথিবীর সন্দেহ নেই।
কোন স্থানে বন্টনব্যাবস্থা যত পরিকল্পিত বা অপটিমাইজড, সেখানে ফুডমাইল তত কম হবে। অর্থাৎ একটা দেশের যে কোন অঞ্চলেই যতদূর সম্ভব সবরকমের জিনিস উৎপাদন সম্ভব হলে সেখানে পরিবহনের লোড সর্বনিন্ম হবে।
২.
যেহেতু কাছ থেকে গার্মেন্টস ব্যাবসা দেখিনি তাই আমার অজ্ঞতার কারণেও এই প্রশ্ন করতে পারি। সেটা হলো ঢাকা শহরে এত এত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী কেন? আমার ধারনা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলো থেকে তৈরী হওয়া কাপর শেষমেষ চট্টগ্রাম বন্দরেই যায়, আবার কাটা কাপড় আসেও সেখান থেকে। পুরো শিল্পকেন্দ্রটাই গড়ে ওঠার কথা ছিল চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে।
তা না হয়ে ঢাকায় এত কারখানা গড়ে ওঠার কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট না।
এখন থেকে যারা গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবসায় নামবেন তাদের জন্য গার্মেন্টস মাইল কনসেপ্ট চালু করলে কেমন হয়? কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চয়ই একটা ভাল সূচক, কে জানে হয়ত শিল্পোদ্যক্তারা এর ব্যবহার অনেক আগে থেকেই করছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।