আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিল্পের হাত ধরে সমাজ বদলের আলো



শিল্পের হাত ধরে সমাজ বদলের আলো ফকির ইলিয়াস ------------------------------------------------------------------------------ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সমাজ বদলের কথাটি বিভিন্নভাবে আমরা শুনলেও এর বাস্তবতাটি বড়ো ভিন্ন। অধিকাংশ ক্ষমতাধরই শুধু গ্রাস করতে তৎপর থেকেছেন বিভিন্নভাবে। খাল-বিল-নালা-ঝিল দখল করে কিংবা পাহাড় কেটে হাউজিং প্রকল্প বানাবার নামে ব্যক্তিস্বার্থ যারা হাসিল করেছেন তাদের দলীয় পরিচয় ভিন্ন থাকলেও স্বার্থের আদর্শ কি এক নয়? পাহাড় কেটে, নদী ভরাট করে, গাছ কেটে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই শুধু ডেকে আনা হয়নি, একটি প্রজন্মকে ক্রমশ গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের এ সময়ের বহুল নন্দিত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর একটি বক্তব্য দিয়ে লেখাটি শুরু করি। সম্প্রতি তিনি এক সেমিনারে বলেছেন ‘রাজনীতিবিদরা ফেল মেরেছেন।

সমাজ বদলে শিল্পী-লেখকদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। ’ সমাজ বদলে লেখক-শিল্পীরা অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখতে পারেন। বাংলা শিল্প জগতের দুই মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিত রায়ের কর্মযজ্ঞ এবং বিশালতা লক্ষ্য করলে আমরা সে প্রমাণ পাই। একজন লেখক তার লেখনী দিয়ে জাগিয়ে তোলেন তার জাতিকে। তার স্বদেশকে।

একজন শিল্পী গান গেয়ে ঢেউ তুলেন জাগরণের। শিল্পীর সুললিত কণ্ঠে ঝংকৃত হয় তার জন্মভূমি। ২০০৭ সালে আমরা বেশ কিছু কৃতি ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি। ওয়াহিদুল হক, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, কে এম সোবহান, চিত্তরন্জন সাহা এরা ছিলেন আলোকিত মানুষ। ছিলেন একেকটি প্রতিষ্টান।

আমরা হারিয়েছি ,কবি বিনয় মজুমদার, তারাপদ রায়, কবি শামসুল ইসলাম, কবি মমিনুল মউজদীন, শিল্পী সন্জীব চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়েদ উল হক, সুরকার প্রণব ঘোষ সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কে। এরা সবাই ছিলেন পরিশুদ্ধ সমাজ সংস্কারক। একটি সমাজের প্রকৃত মেরুদণ্ড কারা? কাদের ওপর ভর করে দাঁড়ায় দেশ-রাষ্ট্র-জাতি? এসব প্রশ্নের বিবিধ উত্তর পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আìতর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উত্তরটি হচ্ছে যারা সৎভাবে, যারা রাষ্ট্রীয় নীতিমালা মেনে রাষ্ট্রের, জাতির উন্নয়নে কাজ করেন তারাই জাতির মেরুদণ্ড। যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলি তবে বলতে হবে কৃষক-শ্রমিকই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মেরুদণ্ড।

যারা উন্নয়নের জন্য প্রতিদিন ১২ ঘন্টারও বেশি সময় মাঠে-ঘাটে চাষবাস করে বেড়ান। ভাদ্র কিংবা অগ্রহায়ণ মাসে নিজ মাঠে, নিজ ক্ষেতে ফসলের ঝলকানি দেখে একজন কৃষকই বেশি খুশি হন। রোপিত ধানের চারাগুলো যখন বেড়ে উঠতে থাকে, তখন সেই পরিমাপেই বাড়তে থাকে একজন কৃষকের বুকের স্পর্ধা। হাঁ, সে স্পর্ধা সৃজনের। সেই গরিমা বপনের।

সেই দরিদ্র কৃষকই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অথচ লাঙল-জোয়াল কাঁধে কৃষকই বাংলাদেশের চারণ মাঠের সবচেয়ে বড়ো শিল্পী। যার হাতে ধানী জমি পায় শ্রেষ্ঠ কারুকাজ। একটি ছোট্ট ঘটনা দেশে-বিদেশে বেশ আলোড়িত হয়েছিল। নীলফামারীর বৃদ্ধ কৃষক মনোরঞ্জন রায়।

বয়স ৮৫ বছর। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ৯ হাজার টাকা। দুটি হালের বলদ কেনার জন্য। একটি বলদ মরে যায়। অন্য বলদটি দায়ে পড়ে বিক্রি করে দেন মনোরঞ্জন।

ব্যাংকের দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া রুজু হয়। তার অজান্তেই ছয়মাসের জেল হয়। হঠাৎ পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে। ছবিসহ এই সংবাদটি একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়।

খবরটি আলোচিত হয় দেশে-বিদেশে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জে. মইন উ আহমেদের বদান্যতায় সব ঋণ পরিশোধ করে জামিনে মুক্তি পান মনোরঞ্জন রায়। মাত্র দুদিনের মধ্যেই ঘটে যায় ঘটনাগুলো। এই বৃদ্ধ কৃষক জানেন না তিনি কীভাবে মুক্ত হলেন। জানার পর দরাজ কণ্ঠে বলেন ‘ভগবান তাঁর মঙ্গল করবি।

’ এই হচ্ছে বাংলাদেশের মাঠশিল্পী কৃষকদের চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত কবি মি. অ্যালেন গিনসবার্গকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কবি না হতে পারলে কী হতেন? তিনি সহাস্যে বলেছিলেন­ ‘এ ফার্মার’। বলেছিলেন, কৃষক হতাম। মাঠে চাষ করতাম। কারণ কৃষকের চেয়ে বড়ো কোনো শিল্পী পৃথিবীতে নেই।

বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা ঋণ খেলাপিরা এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে দেশে চালের দাম রাতারাতি বেড়ে যায় , এর কারণ সরকারও জানে না, সে দেশের ভবিষ্যত কি? এই বাহান চলছে ৩৬ বছর থেকেই। সুরাহা হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সমাজ বদলের কথাটি বিভিন্নভাবে আমরা শুনলেও এর বাস্তবতাটি বড়ো ভিন্ন। অধিকাংশ ক্ষমতাধরই শুধু গ্রাস করতে তৎপর থেকেছেন বিভিন্নভাবে।

খাল-বিল-নালা-ঝিল দখল করে কিংবা পাহাড় কেটে হাউজিং প্রকল্প বানাবার নামে ব্যক্তিস্বার্থ যারা হাসিল করেছেন তাদের দলীয় পরিচয় ভিন্ন থাকলেও স্বার্থের আদর্শ কি এক নয়? পাহাড় কেটে, নদী ভরাট করে, গাছ কেটে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই শুধু ডেকে আনা হয়নি, একটি প্রজন্মকে ক্রমশ গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। যা কোনো সুস্খ রাজনীতির রূপরেখা হতে পারে না। আজ বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা বন ও পরিবেশমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন বনরক্ষকরাই। তারা বলছেন, মন্ত্রীদেরকে মাসোহারা দিয়েই বন-বাদাড় গ্রাস করা হয়েছে। একটি সভ্যতাকামী জাতির জন্য এরচেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? আরবি ভাষার বরেণ্য কবি-লেখক নাজিব মাহফুজের একটি কথা আমি সবসময় স্মরণ করি।

তিনি বলেছিলেন, আমি আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা বড়ো কথা নয়। আমি কোন ভাষায় ডাক দিয়ে যাচ্ছি তাও বড়ো বিষয় নয়। প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, আমি আলো জ্বেলে যাচ্ছি। সূর্য যেমন ভূ-মণ্ডলকে আলোকিত করে।

পাকিস্তানের লাল মসজিদে অপারেশনের পরই জংগীদের শিকড় উপড়ে ফেলতে জে মোশাররফ সরকারকে কঠোর হওয়া উচিৎ ছিল। তিনি হন নি। বেনজীর নিহত হলেন নির্মম ভাবে। এখন খবর বেরুচ্ছে পাকিস্তানই বিশ্বের সবচেয়ে বিপদজনক দেশ !! কি ভয়াবহ সংবাদ। প্রশ্ন হচ্ছে, কার বিরুদ্ধে কে যুদ্ধ করছে? কার প্রতিপক্ষ কে? বিশ্বে জঙ্গিবাদ যেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, রাষ্ট্র পরিচালকরাও তেমনি রক্তের হোলি খেলায় হন্যে হয়ে উঠছেন।

বাগদাদ, কাবুল, গাজা, ইসলামাবাদ রক্তাক্ত হচ্ছে প্রতিদিন। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের উৎস সন্ধানে নিউইয়র্ক-লন্ডনের জনজীবন প্রায় প্রতিদিনই থাকছে শঙ্কিত। মানবিক শিল্পবোধ থেকে রাষ্ট্রশাসনই মানুষে মানুষে দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারে। শিল্পচিন্তাই দিতে পারে সমাজ বদলের প্রকৃত আলো। এ সত্যটি কি শাষকশ্রেণী অনুধাবন করতে চেষ্টা করবেন ??


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.