আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্যরকম খাওয়া দাওয়া

চোখ মেলে পাইনি,চোখ বুজে পেতে তো মানা নেই...

আচ্ছা,খাইতে কেমন লাগে?? নাহ, এই প্রশ্ন বাদ। তারচেয়ে বলেন,খাওয়ার কথা শুনলে প্রথম কিসের কথা মনে পড়ে?? হুম্‌ম... একেক জন নিশ্চয়ই একেকরকম খানাপিনার কথা ভাবতেসেন। কিছু মানুষ আছে যাদের খানাপিনার কথা শুনলে মাথার মধ্যে খালি খাওয়া দাওয়ার ছবিই ঘুরে না, কোত্থেকে জানি সেইসব খাবার এর গন্ধও নাকে এসে ধাক্কা মারে। পারলে তখনই খেতে বসে যায় এমন একটা অবস্থা। খাওয়ার কথা শুনে আপনার কি মনে হয় আমি সেটা বলতে পারবোনা।

গ্যাজ মাইরা কলেজ লাইফে বহুত অবজেক্টিভ প্রশ্ন মিলাইসি। আমার দৌড় ঐ এক্সাম হ্ল পর্যন্তই। সব মানুষের চিন্তাধারাই যদি আর মালেক স্যারের অবজেক্টিভ প্রশ্নের মত প্রেডিক্টেবল হইত!!! যাই হোক... খাবার কথা শুনলে সবার মাথায় যখন পোলাও,কোর্মা,বিরিয়ানি কিংবা আরো হাবিজাবি কত খাবারের চিন্তা আসে আমার মাথায় তখন ঘোরে শরিফুদ্দিন স্যার,নুরুল হক স্যার,দেবব্রত মল্লিক স্যার কিংবা এডজুটেন্ট মামুন আল মাহমুদ স্যারের কথা!!!! তবে খাওয়ার চিন্তায় আমার প্রথম ফেবারিট শরিফউদ্দিন স্যার!! (হে হে হে) ডরাইয়েন না... ভিম পাউডার এর এড এর মত বলতে হয়... জানতে চান শরিফ উদ্দিন স্যার কেন আমার ফেবারিট?? ভেতরে আসুন... (!!#@?!!) আগে আমার ফেবারিট মানুষটার ইন্ট্রো দেই। স্যারকে আমরা ক্লাস সেভেনে কলেজে গিয়েই ফজলুল হক হাউসের হাউস টিউটর হিসেবে পেয়েছিলাম। চুল তার কবেকার অন্ধকারে বিদিশার নিশা,দিনের আলোয় পাইবেন না চুলের কোন দিশা।

স্যারের মাথায় একটা সুন্দর মত টাক ছিল,গোল গোল। স্যারের চোখ দুইটাও ছিল বড় বড় গোল গোল। স্যারের চশমার ফ্রেমটাও ছিল কালো গোল গোল। এতসব গোল আর মাথার টাক মিলিয়ে একটা পারফেক্ট ফুটবল স্টেডিয়াম। আমার কোন এক বিজ্ঞ ক্লাসমেটকে স্যারের এত ফুটবল স্টেডিয়াম সুলভ নিদর্শনও সন্তুষ্ট করতে পারলোনা।

তার মাথায় ফুটবল ছাড়াও আরো কিছু খেলা করতেসে তখন। অবশেষে কোন একদিন তার হাইপোথিসিস ক্লাসে প্রকাশিত হল স্বাড়ম্বরে। স্যারের চেহারার সাথে নাকি ভুতের ছানার বেসম্ভব রকমের মিল আছে। আমরাও গোল গোল মুখ করে ভাবতে বসে দেখলাম,তাইতো!!স্যারের চেহারা তো আসলেই ভুতের ছানার মত। ডেস্ক পিটিয়ে তখনই স্যারের নতুন নামকরণ সর্বস্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল!! অথচ স্যারের চেহারা যার মত অর্থাৎ সেই ভুতের ছানা কয়জন দেখেছে সেই ব্যাপারে আমরা কেউই একবারের জন্যও মাথা ঘামালাম না।

কিসের এত দেখাদেখিরে বাবা, চেহারায় মিল আছে এইটাই তো বড় কথা!! কয়েকদিন পরে আরেকটা ব্যাপার পরিস্কার হয়ে গেল... স্যারের চেহারা ভুতের ছানার মত হলে কি হবে ব্যবহারে সে মোটেই বাচ্চা ভূত না। একেবারে আধুনিক সাইকো টাইপ ভূত। স্যার হঠাৎ হঠাৎ অনেক ছোট খাট কারণে রেগে যেতেন। আমাদের কেমিস্ট্রির ক্লাস নিতেন। যতক্ষণ ক্লাস নিতেন একটা মুহূর্তের জন্যও তার চাঁদপানা গোল মুখটা ছাড়া অন্য কোন দিকে তাকানো যেতনা।

তার যদি কখনো মনে হত আমার কোন ক্লাসমেট তার পড়ায় ঠিক মনযোগ দিচ্ছেনা তাহলে তাকে সাথে সাথে দাঁড় করাতেন। এই ছেলে... তুমি দাঁড়াও...!!ওর অবস্থা কি হত সেটা একটু পরে নিজেই বুঝবেন... আর আমরা বাকী সবাই ঐ ক্লাসমেটটার কথা ভেবে মনে মনে ইন্নালিল্লাহ পড়া স্টার্ট করতাম... ক্লাস সেভেনের একদিনকার কথা। জেনারেল নলেজ পরীক্ষা ছিল সেদিন। এই পরীক্ষার মার্কস হাউস পয়েন্টে যোগ হলেও ব্যাক্তিগত রেজাল্টে তেমন একটা প্রভাব ফেলতোনা। তাই বেশিরভাগ পোলাপানই নিজে পড়ে আসার চেয়ে অন্য কারো পড়ে আসার উপরেই বেশি নির্ভর করতো।

সেদিনও দেখাদেখি করার স্কিল বাড়ানোর জন্য সবাই প্রস্তুত। শুধু অপেক্ষা,গার্ড হিসেবে কে আসে। সবার মুখ কালো করে দিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকলেন আমাদের অতি প্রিয় ভুতের ছানা। কিন্তু মুখ কালো করে থাকাটা কিছুক্ষনের জন্যই। বরং সবাই আরো দ্বিগুন উৎসাহে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত।

স্যারের মত ছোট খাট জিনিসকে বাঁধা মনে করলে সামনে এগোবো কি করে!! যথারীতি পরীক্ষা শুরু হল। কিছুক্ষন এর মধ্যেই মোটামুটি সবাই বুঝে গেল,আর চুপ করে থাকা যায়না। এই প্রশ্নপত্র একা একা উত্তর দেয়া আর এক পায়ে এভারেস্টে উঠা একই কথা। শুরু হল চোরাগোপ্তা আক্রমণ। সাধারণ জ্ঞান এ মোটামুটি ধরনের অসাধারণ ছিলাম বলে বেশির ভাগ আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হলাম আমি।

সবাই আড়চোখে আমার দিকে তাকায়, আর আমি তাকাই স্যারের দিকে। বামের সারির এক ডেস্ক পেছনে বসে মোর্শেদ কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞাসা করছে দোস্ত এইডা কি ঐডা কি...আমি জান বাঁচিয়ে যতক্ষণ পারা যায় রসদ সাপ্লাই দিতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষন বোধহয় আর বাঁচা গেলনা। স্যারকে আমাদের সারির দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই আমি মাথা নিচু করে বিশাল রকমের মনোযোগী ছাত্র হয়ে গেলাম। ভয়ে বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে।

নাহ্‌... স্যার আমার সামনে না থেমে মোর্শেদের ডেস্ক এর সামনে গিয়ে থামলেন। কিছুক্ষণ শুনশান নিরবতা। অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। এর পরেই থেমে থেমে আওয়াজ এলো... টাশ্‌... টাস্‌... টাশ্‌ ... শরিফউদ্দিন স্যারই প্রথম গুলি বর্ষণ শুরু করলেন। আর দিনের প্রথম শাহাদাত বরণ করলো আমার রুমমেট মোর্শেদ।

চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে রনাঙ্গনের বাকি সবাই পিছু হটলো। সবাই পারলে ডেস্কের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে লেখে। কিন্তু আমি একটু বেশি বোকা বলেই কিনা ফ্রন্ট লাইন ছাড়লাম না। স্যার একটু পরেই দূরে সরে যেতেই আমি এইবার মোর্শেদকে একটা প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করলাম। দোস্ত তের নম্বরের উত্তর কী রে?? মোর্শেদ উত্তর দিতে গিয়েও মনে হল ভুত দেখার ভয়ে খোলা মুখ গপ করে বন্ধ করে ফেললো।

বোকা হলেও এত বোকা আমি না। ততক্ষনে বুঝে গেছি মোর্শেদ কি দেখেছে। ভূত না, ভূতের ছানা। গোল গোল চশমার আড়ালের চোখ দুটো ডাইনেও না বায়েও না,সরাসরি এবার আমার দিকেই আসছে। উপায় নাই গোলাম হোসেন।

এইবার... পালাবে কোথায়?? আমি নিজের ইন্নালিল্লাহ নিজেই পড়া স্টার্ট করলাম। স্যারের ছায়া আমার মুখের উপর পড়ে স্থির হলো। বিশাল থাবা দিয়ে আমার চিবুক ধরে টেনে দাঁড় করালেন। কিছুক্ষন এক মনে তাকিয়ে থেকে দেখছেন আমাকে। আর আমি হিপনোটাইজড হয়ে স্যারের গোল গোল চোখ দুটো দেখছি।

শিকারী বাঘও মনে হয় ধরা পড়া হরিণের দিকে এর চেয়ে নরম চোখে তাকায়। স্যার কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, মনে নেই। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। গুনে গুনে চারবার... টাশ্‌ টাশ্‌ টাশ্‌ টাশ্‌... বাম গালে আর কোন অনুভূতি টের পাচ্ছিনা। স্যার এইবার তার বিশাল থাবা দিয়ে বামগাল ধরে ডান গাল খালি করলেন।

- বলতো তোমার এই গাল বড় নাকি আমার এই থাবা বড়?? ডান হাতটা চোখের সামনে এনে স্যার জিজ্ঞেস করলেন। আমি নিরুত্তর। যেইটাই বড় হোক,আমার কি লাভ। ডেস্টিনেশন তো একটাই। -তুমি একটু আগে দেখেছো যে আমি একজনকে মেরেছি।

তারপরেও তোমার কি এমন কাজ করা উচিৎ হয়েছে?? অবজেক্টিভ প্রশ্ন। উত্তর এড়ানোর তো কোন উপায় নেই। - জ্বীনা স্যার। -তাহলে?? হোয়াই? হোয়াই? হোয়াই? ক্লাসের বাকি সবাই তিনটা হোয়াই এর সাথে সাথে তিনবার টাশ টাশ আওয়াজ শুনলো। আর আমি বুঝলাম যে আমার ডান গালটাও বামগালের পথ অনুসরণ করে অবশ হয়ে গেছে।

অপরিসীম সাহসিকতার (নাকি বোকামির) পরিচয় দিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মোর্শেদের পাশে নিজের নামটাও লেখিয়ে ফেল্লাম। বেশি না, সব মিলিয়ে মাত্র সাতবার। সেভেন নাকি লাকি নাম্বার। যে বলছে তারে যদি ঐ সময়ে সামনে পাইতাম... এত কথার সাথে খাওয়া দাওয়ার কি সম্পর্ক? অই যে প্রথমেই বলেছিলাম না সবাই যখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে ভাবতে গেলে কোরমা পোলাও আরো কত হাবিজাবির কথা ভাবে আর আমার কেন জানি সেদিনকার চড় খাওয়ার কথা মনে পড়ে খালি। সেই মনে করার পথ ধরেই আসে শরিফুদ্দিন স্যার।

আমার প্রিয় শরিফুদ্দিন স্যার। স্যার, সেদিন যা খাইয়েছিলেন সেটা আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারবোনা। আমার মত আরো অনেক ক্লাসমেটই পারবেনা। আপনি যেখানেই থাকুন,ভাল থাকুন। এই কামনাই করি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।