কখনো চাই নাই দূরে থাকি...তবু দূরগুলো বারে বারে আসে...
রাঙ্গামাটি ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতে গিয়া আমি নিজেই খানিকটা ক্লান্তি অনুভব করতেছিলাম...পাঠকের ক্লান্তিটাও ঠাহর করবার পারি সেই নিরীখে। একই পথের গল্প, স্মৃতির স্পর্শ নিয়া বাঁইচা থাকনের গল্প...এইসব বহুত পুরানা কেচ্ছা...ট্রাভেলগ লিখনের মজাটা তৈরী হয় তখনই, যখন সেইসব বৃত্তান্ত নষ্ট হইয়া যাওয়া স্মৃতি হয়। আমি নিজে এই স্মৃতিকাতরতা উপভোগ করি। যেই কারনে সেই কিশোরকালের ডায়েরীর ক্ষয়াটে চেহারার মাঝেও পুরানা বর্ণমালা খুঁজি। যেইখানে মনে না থাকা চিত্রকল্প দৃশ্যমান হয়।
আজকের এই লেখা আমি যতোবার পড়ি ততোবার বিরক্ত হই বলার বিষয়ের খামতিতে। আপাতঃ চটক থাকে হয়তো অবজার্ভেশনের অভিনবত্বে...কিন্তু এই যুগে অভিনবত্ব পর্যটনের ব্রোশিওরেও পাওন যায়। বরং তারা সচিত্র হয়। যেই ছবি আবার ভিন্ন দুই তিন চোখের অনুসরন।
কিন্তু গজদন্তের কারুশিল্পী বিজয় কেতন চাঙমা'র সাথে দেখা হওয়াটা আমারে আশান্বিত করে।
আমি উপলব্ধ করি, এই যাত্রা বিফলে যায় নাই। এই যাত্রা ঠিক অন্য যেকোন বারের মতোন ঢাকার গতিশীল বিরক্তির শৃঙ্খল কাইটা প্রাকৃতিক পরিসরে নিজেরে ছড়াইয়া দেওনের আয়েশী কিম্বা বিলাসী পদক্ষেপ হয় নাই। সকল ছুটিতেই কোন না কোন ভিন্ন স্থানে যাই...সেই খানে গিয়া বিশেষ স্থান দেখি...স্থানীয় বিখ্যাত খাদ্য খাই। অন্য সংস্কৃতির প্রতি একরম মোহময়তার চোখ মেইলা দেখি...আহা! তারা কতো অপরূপ আছে! সভ্যতা আজো তাগো বিলীন করে নাই...আর আমরা প্রার্থনা করি তারা যেন এইরমই থাকে...পাল্টাইবার দায় সব আমাগো...আমরা নিজেগো সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়া মায়াময় উচ্চতর সাংস্কৃতিক আচার নিয়া থাকুম...অরণ্য আর পাহারের মানুষেরা ক্যান পাল্টাইবো!
সকাল ১০টায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্য দিয়া আমরা যখন কল্পতরুর ঢালুপথ বাইয়া বিজয় বাবুর গৃহের পানে আগাইতেছিলাম, লনের উপর লেখা অনিত্য...যা আসলে কেরম মেটাফিজিক্যাল অনুভূতি তৈরী...যেই অনুভূতির ধর্মীয় কোনোটেশনও থাকে। আমি যেকোন ধরণের ধর্মীয় অনুসঙ্গেই অস্বস্তিতে থাকি...হোক সে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বন...(অনেকেই তারে বস্তুতান্ত্রিক ব্যখ্যার ঝোঁকে থাকে যদিও)।
অনিত্য শব্দের মর্তবা কি ভাবতে ভাবতেই আমরা ঈষিতার পিসেমশাইয়ের অতিথী হইয়া গেলাম। বিজয় কেতন চাঙমা দরজায় দাঁড়াইয়া আমাগো অভ্যর্থনা জানাইলেন...
বিজয়বাবুর সদা হাস্যময়তার সাথে রাকেশ যেই তুলনা করলো প্রথমেই সেইটা আমার রীতিমতো অপমানজনক মনে হইলেও কিছু করনের নাই। ডঃ ইউনুসের সাথে নাকি তার চেহারার মিল আছে...আমি হতভম্ব! পরিতৃপ্তির হাসি আর সরলতার হাসি কেমনে এক হয়!? অভ্যর্থনার পরই সেই প্রশ্ন,"কেমন দেখলেন রাঙ্গামাটি?" তারপর সেই সব উত্তরমালা, যেইসবে আসলেই বিজয়বাবুর সাথে আমার নৈকট্য তৈরী হইলো। আমরা ভিন্ন মতাদর্শ, ভিন্ন জীবন যাপন, ভিন্ন ভাষাগত জাতি, ভিন্ন সময়ের দুইজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কোন ফারাক খুঁইজা পাইনা...বিজয় কেতন বাবু শিল্পী...শিল্পী সমাজের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অপরিসীম। শিল্পী সমাজের সকল ধরণের দম্ভে আমার শ্রদ্ধা আছে...এবং অবশ্যই এই শ্রদ্ধাবোধ প্রশ্নহীনতার না।
সেই ছোটবেলায় বিজয় বাবুর মা মুক্তাবি চাঙমা যখন একা তার দুই সন্তানরে নিয়া অরণ্যের অভ্যন্তরে কোন গ্রামে থাকতেন কারন তার স্বামী গেছেন হাতির দাঁতের খোঁজে...তখন তাগো বাধনহারা জীবনে মায়ের শাসন কেরম লাগতো এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি হাসলেন...কিন্তু শুনাইলেন তার মায়ের শৌর্য্যের কীর্তি...তার মা নাকি একবার এক ওঁত পাইতা থাকা বাঘ মারছিলেন...যার ছাল এখনো তাগো বাঘাইছড়ির গ্রামের বাড়িতে সংরক্ষিত আছে। আরেকবার ডাকাতদলরে দৌড়াইছিলেন বন্দুক হাতে...আমরা মুক্তাবি চাকমার শাসনের ধারা বুইঝা যাই। তাঁর অবশ্য যৌবনের কোন ছবি দেখি নাই...বৃদ্ধ বয়সের সকল বলিরেখা সহই একজন দৃঢ়চেতা মহিলার একটা স্থিরচিত্র আছে বিজয় বাবুর কাছে।
মায়ের এই গল্প করার সময়ে বিজয় বাবুর এক্সপ্রেশনে পরিবর্তন দেখি...মুখে চোখে গর্বের ভাষা...এই মায়ের সন্তানেরাও নিশ্চিত তার মতোন হইবেন...কিন্তু পারিবারিক ধারাবাহিকতায়তো বিজয় বাবুর গজদন্ত শিল্পীর জীবনই বাইছা নিতে হয়...একজন গজদন্ত শিল্পীর জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যতো গজমতি খুঁইজা বেড়ানোর দুরাশায় সীমিত থাকনের কথা...
কিন্তু লংগদু-নানিয়ারচর-মহালছড়িতে পাহাড়ি ভাইয়েরা যে শান্তিতে থাকে না! একের পর এক পাহাড়ি গ্রাম পুড়াইয়া দেয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা! গজমতি তখন তুচ্ছ এক জৈব উপাদান...মানুষের মূল্য তার চাইতে অনেক বেশি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।