পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে
(আগের পোস্টের পর)
স্বদেশ পর্ব
============================
অনেক সময় পরিস্থিতি কিছু কিছু শব্দের অর্থ উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। ‘নির্জন জনারণ্যে’ কথাটার মানে আগে বুঝতাম না। এখন বুঝি। আপনার চারপাশে অনেক মানুষ, তবু মনে হবে আপনি একা। কারণ, প্রবাসে আপনি যাদের পাশে চান, সেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, স্তাবককূল- কেউ আপনার পাশে নেই।
‘বিদেশে থাকা’ মানে তাই একপ্রকার ‘নির্জন জনারণ্যে’ থাকা। এ অরণ্য থেকে বাঙ্গালী তাহলে দেশে ফিরে যায় না কেন?
শুরুতে (আগের পোস্টে) বলেছিলাম, যারা দেশে আছেন তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া প্রায় সবাই বলবেন, দেশে কেউ ভাল নেই। দেশে আমরা অনেক দিন থেকেই ভাল নেই। কবে ভাল ছিলাম, সেটাও আমার মনে পড়ে না। যখন দেশে ছিলাম, শুধু মনে হত কবে এখান থেকে বেরিয়ে যাব।
যারা এখন ছাত্র, তাদের হয়ত এখন এটা আরো বেশী করে মনে হয়।
এখানে অনেককে জিজ্ঞেস করি, কেন দেশে ফিরে যান না? তারা উত্তরে বলেন, দেশে কোন কিছুর নিরাপত্তা নেই- জীবনের নিরাপত্তা, আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা। আপনি ঘর থেকে বের হবেন, জীবিত ফিরতে পারবেন কি না, কোন গ্যারান্টি নেই। বাসে চড়ে যদি যান, জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যেতে পারেন। দরগায় জিয়ারত করতে যান, পহেলা বৈশাখে আনন্দ করতে যান- বোমায় উড়ে যেতে পারেন।
এছাড়া চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ক্যাম্পাসে গোলাগুলি- এসব তো আছেই। আর আপনি যদি কারো শত্রু হোন, তবে খুন হয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। খুন হয়েও রেহাই নেই। বিচারের বাণী এখানে নিরবে-নিভৃতে কাঁদে।
আর্থিক নিরাপত্তার কথা বলতে গেলে বলা যায়, যারা দেশে ছিল দরিদ্র, কোন কাজ পেত না, বিদেশে গিয়ে শ্রম দিয়ে আজ তারা অর্থের মুখ দেখছে।
প্রবাসী অনেক বাংলাদেশী নির্মাণ কাজে, গ্যাস স্টেশনে অমানুষিক পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন। মাঝে মাঝে ভাবি, এ শ্রমটুকু তারা দেশে দিলে অনেক উন্নতি করতে পারতেন। কিন্তু দেশে সে সুযোগটুকুও তো তারা পান নি। আর দেশে চাকরি-বাকরি তো মামা-চাচা, অসৎ পথ ছাড়া সাধারণত হয় না। বিদেশে কোন মামার প্রয়োজন নেই (প্রফেশনাল জবে রেফারেন্স অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ)।
আপনার যোগ্যতাই সব কিছু।
সামাজিক নিরাপত্তার অবস্থাও করূণ। শ্রমের কোন মর্যাদা নেই। নিম্ন আয় ও নিম্ন পেশার লোকদের প্রতি কোন সম্মান নেই। বিদেশে সব পেশাই মর্যাদার, সব মানুষই সম্মানের যোগ্য।
যিনি আজ প্রবাসে নির্মাণ শ্রমিক, তিনি কেন দেশে ফিরে যাবেন- যেখানে তার কোন মর্যাদা নেই।
অন্যদিকে আপনি যদি দেশে ওপরতলার মানুষ হন, মান- মর্যাদা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনার মাস্তান ছাত্রের হাতে যে কোনদিন অপমানিত হতে পারেন, জীবনও বিপন্ন হতে পারে (কিংবা জলপাই এসে ধরে নিয়ে যেতে পারে )। আপনি কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, ইউনিয়নের নেতা মালীর হাতে যে কোনদিন চড় খেয়ে যেতে পারেন। আপনি সরকারের মাননীয় সচিব, যে কোনদিন আপনাকে ঘুষখোর, চোর বানানো হতে পারে।
যে মর্যাদা আপনি তিলতিল করে গড়ে তুলেছিলেন, একদিনেই তা সব শেষ হয়ে যেতে পারে। আপনার-আমার চরিত্র এখানে অন্যের হাতে ভাঙ্গে-গড়ে; আমরা দর্শকমাত্র।
তবে, এ কোন দেশে আমরা থাকি? এ কোন দেশে আমরা ফিরে যাব? তাই হয়ত অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্বেও দেশে ফিরে যান না। বেছে নেন প্রবাসের এই ‘নির্জন জনারণ্য’। দেশ যখন দুর্বৃত্বের কবলে, তখন অরণ্যবাসই তো শ্রেয়।
(শেষ)
বিঃদ্রঃ- দেশের কোন এক অস্থির সময়ে লেখা। এখনও অবস্থা তার চেয়ে খুব বেশী পরিবর্তন হয় নি। কিছুটা সংশোধিত আকারে ব্লগে তুলে দিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।