আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হারিকেন - দ্য ডিভাইন উইন্ড (৩)

পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে

পর্ব দুই - কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো ====================== (পূর্ব প্রকাশিতের পর) যুদ্ধের পর একটা শহর যেমন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, ২৯ শে এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ের পর চট্টগ্রাম শহর ঠিক তাই ছিল। পথের পাশে পড়েছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লাশ, রাস্তা জুড়ে ছিল উপড়ে পড়া গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, ঘর-বাড়িগুলো দুমড়ানো-মুচরানো, আর লাশের পচা গন্ধ থেকে থেকে বাতাসটাকে ভারী করে তুলছিল। মানুষ যত না ঝড়ে মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী মরেছিল জলোচ্ছ্বাসে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে ৪-৫ মাইল অভ্যন্তরের প্রায় সব মানুষই বোধহয় নিহত হয়েছিল ২৫-২৬ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে। মানুষ তিনতলায় আশ্রয় নিয়েও পানির হাত থেকে বাঁচতে পারে নি।

প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল উপকূলবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চলগুলো। কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী এসব এলাকায় অনেক জনবসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বাঁশখালীতে আমাদের দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয় পরিবারের সবাই নিহত হয়েছিলেন। ঝড়ের পর অনেক দিন চট্টগ্রাম শহরে কোন বিদ্যুত ছিল না।

রাত নামলে শহরটা হয়ে যেত এক ভূতের নগরী। অন্ধকারে হেঁটে বেড়াতাম এ-গলি, ও-গলি। শহরটাকে মনে হত শয্যাশায়ী, মূমুর্ষ কোন আপনজন প্রচন্ড ব্যথায় ছটফট করছে। মানুষের লাশগুলো দু’একদিনের মধ্যেই সৎকার করা হয়েছিল। কিন্তু গরু-ছাগলের মত অবলা জীবগুলোর সৎকারের ভার কেউ নেয় নি।

লাশগুলো পথের পাশেই ফুলে-ফেঁপে উঠছিল। কে করবে ওদের জন্য, মানুষ বাঁচানোই তখন দায় হয়ে পড়েছে। স্বজনহারা গৃহহীন, খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন নর-নারী তখন পিলপিল করে আসছে ফুটপাতে, রেলস্টেশনে। কাঁদো মানুষ কাঁদো। একদিকে দেখছি নির্লজ্জ কিছু সাংবাদিক আব্রুহীন নারীর ছবি তুলছে তাদের চমৎকার রিপোর্টের সাবজেক্ট হিসেবে, অন্যদিকে কিছু মানুষ অবলীলায় গায়ের জামা, মানিব্যাগ তুলে দিচ্ছে মায়ের সম্মান রক্ষার্থে।

পতেংগায় শুনলাম ঢাকা থেকে তামাশা দেখতে আসা কিছু মানুষকে স্থানীয় লোকেরা তাড়া করেছিল। ছবি চাই না, ত্রাণ চাই। মাঝে মাঝে কর্ণফুলী ব্রীজের পিলারের নীচে গিয়ে বসে থাকতাম। কর্ণফুলীর ঢেউ তখনও প্রমত্তা সমুদ্রের মত। ঝড়ের সময় কোটি টাকা দামের ক্রেন ‘শক্তিমান’ নোংগর ছিঁড়ে ব্রীজটাকে আঘাত করে দুই ভাগ করে ফেলেছে।

ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ। ক্রেনটাও একপাশে অনেকদিন ডুবে ছিল। দুঃখের মধ্যেও সবচেয়ে মজার ঘটনা ছিল ঝড়ের সময় বিমান বাহিনীর কিছু দামী ফাইটার প্লেন বাইরে রাখা ছিল, ঝড়ের পর ওগুলোকে খেলনা প্নেনের মত দুমরানো-মুচড়ানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। হায় রে বিমান বাহিনী! এইটুকু কমন সেন্সও নাই। এত দুর্যোগের মাঝেও যাদের কথা না বললেই নয়, তারা ছিল ভিনদেশী।

গালফ ওয়ার থেকে দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ ৭ হাজার সৈন্যের বিশাল একটা মার্কিন বাহিনীকে আমেরিকার বদলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হল দুর্গতদের সাহায্যের জন্য। ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ হয়ে গেল ‘অপারেশন সী এঞ্জেল’। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ একটি ত্রাণ কার্যক্রম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরী স্ট্যাকপোল জাপানের ওকিনাওয়া থেকে এসে যোগ দিলেন অপারেশন কমান্ডার হিসেবে। আসলেই দেবদূত ছিল ঐ সেনাগুলো।

আমাদের মত স্কুল ছাত্রদের যাদের পড়াশোনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের কাজ ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রায় প্রতিদিন ঐ সেনাদের কাজ-কর্ম দেখা। তখন বিশুদ্ধ পানির খুব অভাব ছিল। সাগরের পানি এসে পুকুর, জলাশয়ের সব পানি দূষিত করে ফেলেছিল। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, সেনারা পুকুরের ময়লা পানি একটা বিশাল যন্ত্র দিয়ে সাকশন করে আবার কিছুক্ষণ পরেই পরিষ্কার পানি পুকুরে ফেলত। মানুষ খালি তাজ্জব হয়েই দেবদূত-দের কাজ-কর্ম দেখত।

আমার এখনো মনে হয়, ঐ সময় মার্কিন সৈন্যরা না আসলে এত তাড়াতাড়ি দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ২৯ শে এপ্রিলের ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জেনারেল স্ট্যাকপোল ২০০৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঝড়ে যে গাছের পাতাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, আমার জানালা দিয়ে সে গাছ গুলো দেখতাম, আর ভাবতাম এ শহর কি আবার আগের মত সেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে? একদিন বিস্মিত হয়ে দেখলাম মরা গাছে আবার সবুজ, কচি পাতা ধরেছে। তিন মাসের মধ্যেই গাছগুলো সতেজ হওয়া শুরু করল, প্রকৃতি তার ক্ষতে নিপুণ হাতে প্রলেপ লাগিয়ে দিল। ছয় মাস পর এ শহরকে দেখে আর বোঝার উপায় রইল না এর উপর দিয়ে কি ঘটে গিয়েছে।

আমরাও স্বজন হারানোর বেদনা, দুর্যোগ সব কিছু ভুলে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। প্রকৃতি এক বিশাল বিস্ময়, তার চেয়েও বোধহয় বেশী বিস্ময়কর আমাদের জীবন! (দ্বিতীয় পর্ব শেষ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.