পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে
পর্ব দুই – কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো
======================
১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় তান্ডবের একদিন পর প্রথম পাতা জুড়ে দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোণাম ছিল- ‘কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো’। আমরা তখন চট্টগ্রামে থাকি। হাই স্কুলে উঁচু ক্লাসে যাই। এখনো আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমার স্মরণীয় দিন/রাত কোনটা, এক মূহুর্ত দ্বিধা না করেই বলি ২৯শে এপ্রিলের কথা। আমি জানি, এমন একটা অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর কখনো আসবে না, মৃত্যুকে অমন কাছ থেকেও এত দীর্ঘক্ষণ হয়ত আর কখনো দেখব না।
আমার মনে আছে, ২৯শে এপ্রিলের আগেও চট্টগ্রামে একবার ‘দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত’ দেয়া হয়েছিল। ওটা ছিল ‘ফলস এলার্ম’। তাই ২৯শে এপ্রিল যখন আবার দশ নম্বর সংকেত দেয়া হল, আমি আম্মাকে বল্লাম, ‘দেখো, এবারো কিছুই হবে না’। তখন কি আর জানতাম কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! রাত আটটা/নয়টার দিকে বিটিভি-র নিয়মিত অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে হামদ-নাত পড়া শুরু হয়ে গেল। আম্মা একটু অস্থির হয়ে গেলেন।
বাসায় তখন শুধু আমি আর আম্মা। ভাইয়া ফৌজদারহাটে, আব্বা দেশের বাইরে। আমি আম্মার অস্থিরতা দেখে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগলাম। তারপর রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। বাইরে তখন ঝড়ো বাতাস এবং বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
কিছুক্ষণ পর আমরা কেউই আর রুমে থাকতে পারলাম না। দোতালায় আমাদের বেডরুমগুলোর জানালা ছিল বাইরের দিকে। বাতাসে প্রথম জানালার ছিটকিনি খুলে গেল, তারপর ঝনঝন করে সব কাঁচ ভেঙ্গে পড়ল। রুমের মধ্যেই তখন শুরু হয়েছে তান্ডব। বাতাসে আমার বই-খাতা, জিনিষ-পত্র সব উড়ছে।
বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমরা ড্রইং রুমে এসে জড়ো হলাম। একমাত্র এই ঘরটার বাইরের দিকেই কোন জানালা-দরজা নাই। বাইরে তখন প্রকৃতি প্রচন্ড আক্রোশে গর্জে চলেছে। দরজা-জানালা, বাড়ীটা এমনভাবে কাঁপছে, মনে হচ্ছে উড়ে চলে যাবে যে কোন সময়। আমি আর আম্মা শক্ত করে হাত ধরে বসে আছি।
মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি, এই ঝড় কখন শেষ হবে, আগামী দিনটা কি দেখব?
ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল বাইরেটাকে দেখার। আম্মার নিষেধ অগ্রাহ্য করে দরজাটা খুলে বাইরে যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমি দেখলাম ওই প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে একটা আগুনের কুন্ডলী সাপের মত হিস হিস শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি এটার ব্যাখা আজও পাই নি।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, পরদিন ঝড় থামার পর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, শহরে যে সব গাছ অক্ষত আছে তার প্রায় সবই পুড়ে কালো হয়ে গেছে! এটা নিয়ে আমি অনেক হারিকেন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছি। তারা কেউ এমন কিছু কখনো শুনে নি। হারিকেন হওয়ার সময় কোন এলাকায় গাছ পুড়ে গেছে এমনটা কোন রেকর্ডেও নেই। একজন আমাকে ব্যাখা দিয়েছে বাতাসের ঘর্ষণে হয়ত গাছে আগুন ধরে গিয়েছিল। কিন্তু পুরো শহরের সব গাছ আগুনে পুড়ে গেল, অথচ একটা বাড়ীতেও আগুন লাগল না, এটা কিভাবে সম্ভব! আর ঝড়ের মধ্যে এত বৃষ্টি হল, সেখানে আগুন-ই বা ধরল কিভাবে।
দুঃখের বিষয়, আমার কাছে ওই সময় গাছ পুড়ে যাওয়ার কোন ছবি নেই, তাই এ দাবীটা এখনও অপ্রমাণিত। আসলে মানুষের দুর্দশা তখন এত বেশী হয়েছিল, কেউ আর এটাতে নজর দেয় নি। যদিও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী পরে আমার সাথে একমত হয়েছে, তারাও দেখেছে শহরের সব গাছ পুড়ে যেতে।
একসময় ভোর হল। চট্টগ্রাম তখন এক মৃত নগরী...
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।