জয় বাংলা, জয় বীর জনতা
সকালে আজ শাদা কাপড়ের মুড়ে থাকা নাট্যকার, উপন্যাসিক প্রণব ভট্টকে দ্যাখে আসলাম শ্যাষবারের মত, বাঙলা একাডেমীর নজরুল চত্বরে। চারপাশে বরফে আটকা, ফুলে-ফুলে শোভিত কফিন বাক্স এ হাত রাখলাম কিছুক্ষণ। ভালোবাসায় জড়ালাম নিজেকে। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনূর রশীদ, আবুল হায়াতসহ অনেকেই জড়ো হলেন শ্যাষ দ্যাখাটার জন্যে। শ্রাবণে অমোঘ জলধারায় সিক্ত হলেন তিনি।
অশরীরী প্রণব দা'র কানের কাছে বললাম, প্রণাম আপনাকে। যেখানে তিনি পড়ালেখা করেছেন, শৈশব-যৌবন পার করেছেন সেই নোয়াখালীর মাইজদি বাজারে, অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে তাঁকে রাখা হয়েছে সর্বস্তরের শ্যাষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। সেখানকার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি কবি মিন্টু সারেং এর নেতৃত্বে একদল সংস্কৃতিসেবী, সাহিত্যকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। হাজার মানুষের ভালোবাসায় মধ্যে পৈত্রিক বাড়িতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাহ হলেন তিনি।
তিন সেপ্টেম্বর সন্ধ্যে খবর পেলাম প্রণব দা নেই।
প্রয়াত হলেন। ভাবিনি প্রণব দা এভাবে অ্যাতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে। আমার ভীষণ ঘনিষ্ট মানুষ ছিলেন। অনেক স্মৃতি তাঁর সাথে। আজ সেগুলো বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে আসছে।
বিশ্বাস-ই হতে চায় না প্রণব দা নেই। যখন নোয়াখালী আসতেন সাথে সাক্ষাত হতো । মিস হতো না তাতে। কবিতা জগতে আমি সমর্পিত করি ভয়ে ভয়ে তখন প্রণব দা-ই ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। বলতে আজ দ্বিধা নেই, সঙ্কোচ নেই, আমার কবিতা চেয়ে নিয়ে তিনি নিজ দায়িত্বে দৈনিক জনকন্ঠে ছাঁপিয়েছেন।
সেটি ছিলো কোনো জাতীয় দৈনিকে আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ। তাও বছর পাঁচ/ছয় হবে। প্রণব দা'র অনুপ্রেরণা-ই আমাকে কবিতাচর্চায় অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। কেনো জানি না, প্রায়-ই তিনি আমাকে গল্প লেখার জন্যে প্রণোদিত করতেন। কদ্দিন আগেও দৈনিক যুগান্তর অফিসে দ্যাখা হলে গল্প লেখার জন্যে আবারও তাগিদ দিলেন।
কিন্তু আমি পারলাম না।
ভীষণ অমায়িক-হাস্যময় এ মানুষটি আমাকে স্নেহ করতেন খুউব। কখনো তার মূল্যায়ন করতে পারবো না। আমার (মাইজদি) বাসার পাশে ছিলো প্রণব দা'র পৈত্রিক বাসভবন। পারিবারিকভাবেও আমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো।
যাতায়াত ছিলো অবাধ। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারিতে নোয়াখালী জেলার মাইজদি বাজারে জন্ম নেয়া প্রণব দার বাবা যুধিষ্টির ভট্ট নোয়াখালীর নামকরা উকিল ছিলেন। প্রণব দা'রা ১১ ভাই, এক বোন। সবাই উচ্চশিক্ষিত। নানাদিক দিয়ে এ পরিবারটি নোয়াখালীর একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার।
এখনো এখানে যৌথ পরিবারের নানা আয়োজন উৎসবে পরিণত করে। নোয়াখালী সরকারি কলেজে স্নাতক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর অর্জনের পর প্রণব ভট্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে শুল্ক (কাষ্টমস) কর্মকর্তা ছিলেন। সমপ্রতি সেখান থেকে সহকারী কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। সরকারি চাকুরি করলেও নিয়মিত লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, নাটক। উপন্যাস প্রেয়সী, কাজলকালো চোখ, বাতিল, চাঁদমুখ মেয়ে, ভুতটা বড় বিশ্রী ছিল, সৌমিতা ভালোবেসেছিল, পুতুলের মতো মেয়ে, প্রিয়দর্শিনী ; নাটক সোনার কাঁকন, আংটি, বন্যার চোখে জল, হিয়ার মাঝে, শীর্ষবিন্দু, তথাপি উল্লেখযোগ্য।
সেগুলো ছিলো চলমান জীবনের নানা জটিলতা প্রেম, সামাজিক দ্বন্ধ, ঘাত-প্রতিঘাতের জীবন নিয়ে। মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও অসামপ্রদায়িক চেতনায় সকল মেধাশূণ্য অচেতন অচলায়তনের বিরুদ্ধে পক্ষপাত থাকতো তাঁর লেখায়। যতোদূর জানি এরজন্য তাঁকে চাকুরি জীবনে দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যথেষ্ট। মনে পড়ে আমার, বিটিভিতে প্রচারিত হয় তাঁর একটি জনপ্রিয় নাটক তথাপি।
এ নাটকে উপস্থিত করেছেন সমাজের মুখোশধারী গডফাদারদের। বর্তমান সময়ে এসেও স্পষ্ট হয় গডফাদাররা সমাজবিচু্যত নয়। তাঁর লেখার ভঙ্গি ছিলো, তাঁর গদ্য ছিলো তাঁর একান্তই নিজস্ব। সেগুলো সাবলীল, স্বচ্ছ, গতিময়। চাকুরিজীবনেও তিনি ছিলেন সহকর্মীদের কাছে প্রিয়।
একজন সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন স্বীকৃত। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কাষ্টমস অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।
জন্মভূমি নোয়াখালীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিলো প্রবল। দূর্বলতাও ছিলো ভীষণ, যোগাযোগ ছিলো নিয়মিত। বছর পাঁচেক আগে লক্ষ্মীপুর বার্তা'র নোয়াখালী প্রতিনিধি থাকাকালে প্রণব দা'র একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম আমি।
কতর্ৃপক্ষ সেই সাক্ষাতকারটি হারিয়ে ফেলে, ফলে অপ্রকাশিত থেকে গ্যালো সেই সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকারে নোয়াখালীর প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা বললেন, বললেন আঞ্চলিক নাটক রচনায় ভবিষ্যত ভাবনা। যার সাদৃশ্য মিলে গাঁও গেরামের কিসসা, হ্যালো চেয়ারম্যান সাব নাটক রচনায়। গাঁও গেরামের কিসসা নাটকের মাধ্যমে তিনি নোয়াখালী আঞ্চলিকভাষাকে সবার দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন। দীর্ঘদিন পর টিভিতে সম্পূর্ণভাবে আঞ্চলিক নাটক রচনায় তাঁর একটি অনবদ্য সৃষ্টি, নিশ্চই।
নোয়াখালীতে তিনি একটি বড়ো ধরণের সাংস্কৃতিক উৎসব করতে চেয়েছিলেন। ২০৪ পর্বে একটি মেগাসিরিয়াল ড্রামা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, সম্পূর্ণ নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়, নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পীদের অভিনয়ে। এরই মাধ্যমে নিজেকে নাট্য পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটাতে চেয়েছিলেন। আসন্ন নভেম্বরে শুট্যিং শুরু হওয়ার কথা ছিলো। সবই গুছিয়ে নিয়েছিলেন তার জন্য।
এই মানুষটি এ অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে চলে গ্যালেন পরবাসে।
প্রণব দা'র মহাপ্রয়াণ আমাদের জন্যে পার্থিব অবিনাশী প্রাণ।
হাবীব ইমন, নোয়াখালী মেইল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।